কুকুরছানার সঙ্গে শ্রীলেখা মিত্র
কলকাতাতেও বৃষ্টি হচ্ছে শুনলাম। সুইৎজারল্যান্ডেও একই আবহাওয়া। বৃষ্টিভেজা ঠান্ডা। গত কয়েক দিন হোটেলেই বসে ছিলাম। হোটেলের নীচ থেকে বিস্কুট কিনে খাচ্ছিলাম। সদ্যই বেরোনো শুরু করলাম আবার। রাইনফলস দেখলাম। খুব ভাল লাগল।
সত্যিই খুব ভাল আছি? নিজের সন্তানদের কথা খুব মনে পড়ছে। আমাকে ছাড়া কী ভাবে রয়েছে ওরা? আদর, কর্ণ এবং চিন্তামণি। আর আমার মেয়ে? এই চার জনের মধ্যে ভেদ করে না শ্রীলেখা মিত্র। প্রথম তিন জন কুকুর বটে, কিন্তু সব সন্তানই আমার চোখের মণি। কিন্তু এই ভালবাসাটাকে কেউ কেউ আবার ‘নাটক’ বলে আখ্যা দেন। এদের ভালবেসেছি বলেই আমাকে ‘স্ক্র্যাপ মেটেরিয়াল’ বলা শুরু করেছেন অনেকে। এঁরাই আসলে কুকুরকে ‘কুত্তা’ বলে ডাকেন। আর আমার বিশ্বাস, এই মানুষগুলি কোনও দিন এই ভালবাসার মূল্য বুঝবেন না। সিপিএম পার্টিকে সমর্থন করি, তাও বলছি, সেই দলেও এমন অনেকে আছেন, যাঁরা কুকুরকে ‘কুত্তা’ বলেন। সেই মানুষদের ধারে কাছেও ঘেঁষতে চাই না আমি। কিন্তু সিপিএমেরই কিছু মানুষ ভুলে গিয়েছেন, যখন ওঁদের পাশে কেউ ছিল না, আমি দাঁড়িয়েছিলাম একা। আমি তো বিজেপি-তে গিয়ে নিজের প্রচার করে বা টাকা রোজগার করে আসতে পারতাম। করলাম না। বামদলের আদর্শে ভরসা রাখি বলেই। আজ যারা বলছেন, আমি প্রচারে হেঁটেছি বলেই নাকি নির্বাচনে দল হেরে গিয়েছে, আজ থেকে এক বছর আগে তাঁদের চেহারাগুলো পুরো অন্য রকম ছিল। মনে পড়ছে সে সব কথা…
নেতাজি নগরে ডিওয়াইএফআই একটি শ্রমজীবী ক্যান্টিন খুলেছিল। প্রথম বার ওখানে ডাক পাই। যাই। ছবি তোলা হল, সেগুলো পোস্ট করি আমার ফেসবুকে। সিপিএমের সমর্থক ও কর্মীরা আমাকে ‘নায়ক’ বানাতে শুরু করলেন সেই থেকে। আমার কিন্তু ‘নায়ক’ হওয়ার কোনও ইচ্ছে ছিল না। তাঁদের ‘কমরেড’ বানালেন আমায়। তার পর থেকে একাধিক রক্তদান শিবির, ত্রাণ ইত্যাদিতে যাওয়া শুরু করলাম। কিন্তু সিপিএমের প্রার্থী হতে চাইনি কোনও দিন। আর দলের তরফেও আমাকে প্রার্থী বানানোর জন্য উঠেপড়ে লাগেননি কেউ। সেটা আমাকে আরও মুগ্ধ করেছে। তার পর আমাকে রাজনৈতিক মঞ্চে ডাকলেন ওঁরা। সেই মঞ্চে সুজন চক্রবর্তী, বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্রর মতো তাবড় তাবড় রাজনৈতিক নেতার সামনে তো আমি নগণ্য! আমি গাঁইগুঁই করছিলাম। কিন্তু ওঁরা বললেন, ‘‘তোমাকে দরকার শ্রীলেখাদি, সাধারণ মানুষ তোমাকে দেখতে চাইছে। তুমি একমাত্র, যে এই সময়ে আমাদের পাশে আছ।’’
সেই মঞ্চ থেকে পার্টির সঙ্গে আমার যাত্রা শুরু। তাও কোনও দিন কর্মী হিসেবে যোগদান করিনি। সমর্থকই ছিলাম।
এ বারে আসি শশাঙ্ক ভাভসরের প্রসঙ্গে। রেড ভলান্টিয়ার্সের কাজে মুগ্ধ ছিলাম আমি। গর্বিত ছিলাম তরুণ প্রজন্মের জন্য। শুরু থেকেই নেটমাধ্যমে তাঁদের প্রশংসা করেছি আমি। নিজে পিপিই কিট দান করেছি। সর্বক্ষণ পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। মানেকা গাঁধীর ফাউন্ডেশন ‘পিএফএ’ থেকে এক পশুপ্রেমী দময়ন্তী সেন (আমি কিন্তু জানি না, তিনি কোন দলের সমর্থক। এ ক্ষেত্রে আমার কাছে সে তথ্যটা গুরুত্বপূর্ণও নয়) আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এক দিন। তিনি জানতেন যে, আমি কুকুরদের জন্য প্রাণও দিতে পারি। দময়ন্তীর কাছ থেকে জানতে পারলাম, একটি ছোট কুকুরছানা খুব বিপদে পড়েছে। থাকার জায়গা নেই। কোনও ভাল পরিবার খুঁজতে হবে, যারা কুকুরছানাটিকে দত্তক নিতে পারে। তখনই ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ফেললাম। কুকুরছানাটিকে দত্তক নিলে তাঁর সঙ্গে ‘ডেট’-এ যাব— আমার এই পরিকল্পনা নিয়ে এখন অনেকে বহু কিছু বলছেন। অনেকে বলছেন, আমি নাকি নিজেকে ‘ট্রফি’ মনে করছি। আমার এই পরিকল্পনার দু'টি উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমটি, কুকুরছানাকে দত্তক নেওয়ার মতো কাজ যিনি করছেন, তাঁর প্রশংসা করা। আর দ্বিতীয়টি হল, কার হাতে বাচ্চাটাকে তুলে দিচ্ছি, তাঁকে সামনে থেকে দেখা। এ ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তিটিকে চেনা দরকার। কিন্তু তার পরেও আমি ভুল করলাম। মস্ত বড় ভুল। কুকুরছানাটি বাঁচলই না।
শশাঙ্ক তাকে বাঁচিয়ে রাখতেই পারলেন না। সামনাসামনি দেখা করেও চিনতে পারলাম না। আসলে বুঝতে পারিনি যে, রেড ভলান্টিয়ারকেও ভরসা করা যায় না। অথচ এই শশাঙ্ক কিন্তু দত্তক নেওয়ার আগে আমার বিশ্বাস অর্জনের জন্য ক্রমাগত আমাকে জানিয়ে যাচ্ছিলেন যে, তিনি কুকুরপ্রেমী। কখনও কুকুরদের ভিডিয়ো পাঠানো, কখনও তিনি রাস্তার কুকুরদের খাওয়াচ্ছেন, সে রকম ছবি। কিন্তু কুকুরটি কী ভাবে মারা গেল, সেই তথ্যটাও তাঁর কাছে নেই। কখনও বলছেন দুর্ঘটনায়, কখনও বলছেন বেপাড়ার কুকুরদের আক্রমণে মারা গিয়েছে। ফেসবুকে আমি যখন ‘ডেট’-এর প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তখন এক নেটাগরিক আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘শশাঙ্ক কুকুরটিকে রাস্তায় ছেড়ে দেবেন না তো?’ আমি জোর গলায় বলেছিলাম, ‘না, এটা তিনি করবেন না।’ ভুল প্রমাণিত হলাম।
শশাঙ্ককে কুকুর দত্তক দেওয়ার পর থেকেই তিনি আমাকে মাঝেমধ্যেই মেসেজ করতেন। নানা ভিডিয়ো পাঠিয়ে দেখতে বলতেন। বা কোনও পোস্ট করলে আমাকে মেসেজ করে বলতেন, ‘এখানে আপনার কমেন্ট চাই-ই চাই।’ আমাকে আর ওঁকে নিয়ে কোনও খবর বেরোলে মেসেজ করে বলতেন, ওই খবরের লিঙ্কে আমাকে ট্যাগ করে দিন।’ বুঝতে পারছিলাম যে খ্যাতির আনন্দ ভোগ করছিল। যে দিন আমি বিদেশ পাড়ি দেব, সে দিনও আমার সঙ্গে বিমানবন্দর পর্যন্ত আসার বায়না ধরেছিলেন। আমি সে সবে পাত্তা দিইনি। ভেবেছি বালখিল্যপনা। সব মেসেজ আমার কাছে রাখা আছে। এই কথাটাও আমি আগে কখনও বলিনি, শশাঙ্কের বিষয়ে কিন্তু বিভিন্ন কথা শুনেছিলাম আমি। ওর স্বভাব-চরিত্র নিয়ে সমালোচনা করা হয়েছিল আমার কাছে। এই তথ্যগুলি নিয়ে আমি তখনও মাথা ঘামাইনি, আজও না। কারণ এগুলির সত্য-মিথ্যা আমি জানি না। যত ক্ষণ না পর্যন্ত আমি নিজে বুঝতে পারছি, তত ক্ষণ তাঁর স্বভাব-চরিত্র নিয়ে মন্তব্য করাও উচিত নয় আমার।
মারধরের ঘটনার কথায় আসা যাক। দময়ন্তীদের সন্দেহ হচ্ছিল বেশ কয়েক দিন ধরে। শশাঙ্ককে কুকুরটির ভিডিয়ো পাঠাতে বলেছিলেন। তিনি পুরনো ভিডিয়ো পাঠিয়ে দময়ন্তীদের শান্ত রাখার চেষ্টা করছিলেন। একটা বাচ্চা মারা গেল, আর সেই খবরটুকু দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না শশাঙ্ক! সেই রাগটা চেপে রাখতে না পেরে শশাঙ্ককে মারধর করেছেন দময়ন্তীরা। অনেকে ভাবছেন, আমি নাকি ওঁদের পাঠিয়েছি। ওঁরা নাকি আমার ‘গুন্ডাবাহিনী’। দময়ন্তীর ব্যাপারে কেউ জানেন না বলেই এই কথাগুলো বলতে পেরেছেন। ওঁরা বহু বছর ধরে গোটা পশ্চিমবঙ্গ ঘুরে ঘুরে কুকুরদের যত্ন করছেন। আমার নির্দেশের প্রয়োজন পড়ে না ওঁদের।
তবে হ্যাঁ, আবেগতাড়িত হয়ে মারধর করাটা উচিত হয়নি। সেটা মানছি। কিন্তু ওঁদের জায়গায় থাকলে আমিও শশাঙ্ককে চড় মেরে দিতাম বোধ হয়। তার জন্য কেউ আমাকে ‘কুকুর মৌলবাদী’ বললে বলব, হ্যাঁ আমি ‘কুকুর মৌলবাদী’। আমি কুকুরদের জন্য সব কিছু করতে পারি।
এই ঘটনার পর থেকে সিপিএমের সেই সব সদস্যরা আমাকে অপমান করা শুরু করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, আমি নাকি রেড ভলান্টিয়ারদের ছোট করছি। যা মিথ্যে! তাও আমি বলব, সিপিএমের হাত আমি ছাড়ব না। কোনও দিন নয়। এই মানুষগুলির জন্য তো একেবারেই নয়। তবে প্রচার, রাজনৈতিক মঞ্চ— এ সব জায়গায় আমাকে আর দেখবেন না কেউ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy