‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে উত্তম কুমার।
উত্তমকুমারকে যখন প্রথম ছবিতে দেখি তখনও আমি নিজে ছবির জগতে আসিনি। নতুন একটি হিরোর আবির্ভাব হয়েছে বলে শুনছিলাম, ছবিটিও নাকি ভাল, তাই স্বাভাবিক তাগিদেই গেলাম ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ দেখতে। নির্মল দে-র ছবি, পরিচ্ছন্ন পরিচালনা, আঁটসাট চিত্রনাট্য। এই বিশেষ পরিচালকের কাজ ভাল লেগেছিল বলেই পরে দেখলাম ‘বসু পরিবার’ ও ‘চাঁপাডাঙার বউ’। তিনখানা ছবি পর পর দেখে, মনে হল উত্তমকুমারের অভিনয় ও ব্যক্তিত্বে সত্যিই একটা স্বাতন্ত্র্য আছে। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকের দুর্গাদাস, প্রমথেশ, ধীরাজ, জহর গাঙ্গুলী প্রমুখের কাজের সঙ্গে এর বিশেষ মিল নেই। মনে হল ছেলেটি হলিউডের ছবি-টবি দেখে। অভিনয়ে থিয়েটারের গন্ধ নেই, চলায়-বলায় বেশ একটা সাবলীল স্বাচ্ছন্দ্য। ক্যামেরা বস্তুটিকে যেন বিশেষ তোয়াক্কা করে না। তার উপরে চেহারায় ও হাবেভাবে বেশ একটা মন টেনে নেওয়ার ক্ষমতা আছে। উত্তমকুমারের ভবিষ্যৎ আছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
এর দশ-বারো বছর পর উত্তমকুমারের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আসে আমার। ইতিমধ্যে উত্তম-সুচিত্রার রোম্যান্টিক জুটি দর্শকদের মন জয় করেছে। লেখক পরিচালক প্রযোজক দর্শক সকলের চাহিদা চলে গেছে প্রেমের গল্পের দিকে। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ বা ‘হারানো সুর’ দেখে এটা বুঝেছিলাম যে এই জুটির সাফল্যের পিছনে লেখক প্রযোজক পরিচালক দর্শক সমালোচক ফিল্ম-পত্রিকা সম্পাদক ইত্যাদি সকলের যতই অবদান থাকুক না কেন, এদের দু’জনের মধ্যেই এমন সব গুণ বর্তমান, যার রাসায়নিক সংমিশ্রণে সোনা ফলতে বাধ্য। শুধু উত্তমের কথা বলতে গেলে এটা বলা যায় যে, নায়িকার সান্নিধ্যে এলেই অনেক নায়কের মধ্যেই সিঁটিয়ে যাওয়ার ভাবটা ক্যামেরায় অব্যর্থ ভাবে ধরা পড়ে, উত্তমকুমারের মধ্যে সেটি নেই। বরং প্রেমের দৃশ্যে এঁর অভিনয় খোলে সবচেয়ে বেশি। নারী-পুরুষের সম্পর্ক যেখানে চিত্রকাহিনির অন্যতম প্রধান উপাদান, সেখানে এটা যে কত বড় গুণ সেটা সহজেই অনুমান করা যায়।
‘নায়ক’-এর গল্প আমি লিখি উত্তমকুমারের কথা ভেবেই। সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের এক অভিনয়-পাগল যুবক ছবিতে নেমে তরতরিয়ে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে। এই অবস্থায় এই যুবকের মনে কী ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে, তার মূল্যবোধে কী পরিবর্তন হতে পারে, এও ছিল গল্পের বিষয়।
চিত্রনাট্য শুনে উত্তম খুশি হয়। তার একটা কারণ হতে পারে তার ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে কাহিনির সাদৃশ্য। আলোচনা করে বুঝলাম যে গল্পের গভীরে প্রবেশ করতে না চাইলেও, বা না পারলেও, তার চরিত্রটি কীভাবে ফুটিয়ে তুলতে হবে সেটা উত্তম মোটামুটি বুঝে নিয়েছে। তাকে আগেও বলে রেখেছিলাম যে, সে যে ধরনের প্রেমের গল্পে অভিনয় করতে অভ্যস্ত, এটা সে ধরনের গল্প নয়। সুতরাং তাকে গতানুগতিক পথ কিছুটা ছাড়তে হবে। এতে যে প্রেম আছে, তা প্রচ্ছন্ন। এতে নায়কের দোষ-গুণ দুই আছে, এবং তা যে শুধু অন্তরে তা নয়। তাকে বললাম যে তোমার গালে যে সাম্প্রতিক পানবসন্তের দাগগুলি রয়েছে, সেগুলি ক্যামেরায় বোঝা যাবে, কারণ তোমাকে মেকআপ ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না।
২৬ জুলাই, ১৯৮০। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সত্যজিৎ রায়ের নিবন্ধ।
এই সব প্রস্তাবে তার সামান্য প্রাথমিক দ্বিধা উত্তম সহজেই কাটিয়ে উঠেছিল।
এটা বলতে পারি যে— উত্তমের সঙ্গে কাজ করে যে তৃপ্তি পেয়েছিলাম, তেমন তৃপ্তি আমার এই পঁচিশ বছরের ফিল্ম জীবনে খুব বেশি পাইনি। উত্তম ছিল যাকে বলে খাঁটি প্রোফেশনাল। রোজকার সংলাপ সে সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করে কাজে নামত। তার অভিনয় ক্ষমতা ছিল সহজাত। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উপর দখল ছিল ষোলো আনা। ফলে স্বভাবতই তার অভিনয়ে একটা লালিত্য এসে পড়ত। রোজই দিনের শুরুতে সেদিনকার বিশেষ কাজগুলি সম্পর্কে একটা প্রাথমিক আলোচনার পর আমাকে নির্দেশ দিতে হত সামান্যই। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, নিছক নির্দেশের বাইরেও সে মাঝে মাঝে কিছু সূক্ষ্ম ডিটেল তার অভিনয়ে যোগ করত যেগুলি সম্পূর্ণ তার নিজস্ব অবদান। এই অলংকরণ কখনই বাড়াবাড়ির পর্যায় পড়ত না; এটা সব সময়েই হত আমার পক্ষে একটা অপ্রত্যাশিত উপরি প্রাপ্তি। বড় অভিনেতার একটা বড় পরিচয় এখানেই। ‘নায়ক’-এর পর ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে উত্তমের সঙ্গে কাজ করেও একই তৃপ্তি পেয়েছি। ‘চিড়িয়াখানা’ ছিল নায়িকা-বর্জিত ছবি, ফলে বলা যেতে পারে উত্তমের পক্ষে আরও বড় ব্যতিক্রম।
উত্তমকুমারকে নায়ক ছবির একটি দৃশ্য বোঝাচ্ছেন সত্যজিৎ রায়।
আজ কাগজে পড়ে জানলাম যে উত্তমকুমার নাকি আড়াইশোর উপর ছবিতে অভিনয় করেছিল। এর মধ্যে অন্তত দুশো ছবি যে অচিরেই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। যে দেশে সৎ অভিনেতার সদ্ব্যবহার করতে জানা লোকের এত অভাব, সেখানে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শিল্পীর বিচার সবসময়ই হয় তার শ্রেষ্ঠ কাজের উপর। উত্তমের অভিনয়ের পরিধি যে খুব বিস্তৃত ছিল তা নয়, কিন্তু তার এই নিজস্ব পরিধিতে ক্রমান্বয়ে ত্রিশ বছর ধরে সে যে নিষ্ঠা ও ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে গেল, তার তুলনা নেই। তার অভাব পূরণ করার মতো অভিনেতা আজ কোথায়?
নিবন্ধটি ১৯৮০ সালের ২৬ জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy