সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছে না টলিপাড়া
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছে না টলিপাড়া। যুদ্ধ জয় করে তাঁর ফিরে আসার দিকে চেয়েছিলেন প্রত্যেকে। কিন্তু সব আশা মিথ্যে করে দীপাবলির উৎসবেই নিভে গেল কিংবদন্তি অভিনেতার জীবনদীপ। কাঁদছে টলিউড। বলছে ‘তুমি রবে নীরবে’।
বর্ষীয়ান অভিনেতার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পরেই স্মৃতিতে ডুব দিলেন সাংসদ-অভিনেতা দেব। ‘সাঁঝবাতি’ ছবিতে কিংবদন্তির সঙ্গে কাজ করেছিলেন বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম বিখ্যাত অভিনেতা। সেই স্মৃতি যেন আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছেন দেব। টুইটারে দু’জনের একসঙ্গে ছবি পোস্ট করে তাঁর ‘ছানাদাদু’কে ভাল থাকার বার্তা দিলেন তিনি।
দেবের মতোই শোকে মুহ্যমান অভিনেতা জিৎ। ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছিলেন তাঁরা। ইনস্টাগ্রামে জিৎ লিখলেন, ‘চলে গেলেন বাংলা ছবির কিংবদন্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। একটি যুগের অবসান হল। তাঁর কাজের মাধ্যমে তিনি আমাদের মনে থেকে যাবেন। তাঁর সঙ্গে আমার খুবই সুন্দর বন্ডিং ছিল। আপনাকে মিস করব’। একাধিক ছবিতে সৌমিত্রবাবুর সঙ্গে অভিনয় করেছেন আবির চট্টোপাধ্যায়। কিংবদন্তির চলচ্চিত্রের জগতকে চিরবিদায় জানিয়ে চলে যাওয়া মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর। এই কালো বছরকে আর সহ্য করতে পারছেন না অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। টুইট করে তিনি লিখেছেন, ‘‘এই বছর সব কিছু কেড়ে নেবে। অভিভাবক, কিংবদন্তি, ছেলেবেলা, নস্টালজিয়া সবকিছু। নির্দয় বছর।’’ পাশাপাশি অভিনেত্রী পার্নো মিত্র পরিচালক মৈনাক ভৌমিকের ‘মাছ মিষ্টি মোর’ ছবি থেকে তাঁদের দু'জনের একসঙ্গে অভিনীত একটি দৃশ্য টুইট করে শ্রদ্ধা জানালেন তাঁর ‘ক্যাপ্টেন’কে।
‘সাঁঝবাতি’ ছবিতে কিংবদন্তির সঙ্গে কাজ করেছিলেন দেব
আরও পড়ুন: 'অপুর সংসার' দেখে আমার নাম দেওয়া হল অপু
একই ভাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অন্যান্য সহ-অভিনেতা এবং সহকর্মীরাও আজ তাঁকে নিয়ে নস্টালজিক।
স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রথম কাজ সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরে বাইরে’ ছবিতে। তার ৩০ বছর পরে আবার আমরা এক সঙ্গে কাজ করলাম নন্দিতা রায়, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘বেলাশেষে’ ছবিতে। তার পর ‘বেলা শুরু’। নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। কিংবদন্তির সঙ্গে ৩টি ছবিতে অভিনয় ভীষণ গর্বের ব্যাপার।প্রতি ছবিতেই যেন নতুন হয়ে সামনে আসতেন সৌমিত্রবাবু। একজন মানুষ কত কিছু পারতেন। অভিনয় তো ছিলই। সঙ্গে নাটক, আবৃত্তি, আঁকা, লেখা— সবেতেই তিনি সেরা। বিশ্ব জুড়ে নামডাক। আড়াইশো-র উপর ছবি। অনেকেই জানতে চান, ৩০ বছরে কতখানি বদলে গিয়েছিলেন সৌমিত্রবাবু? বয়স ছাড়া আর কোনও বদল আমার চোখে অন্তত ধরা পড়েনি। আমি বরাবর ওঁর অন্ধ অনুরাগী। আগেও, এখনও। ‘ঘরে-বাইরে’র সময় যেমন আড্ডা মারতে ভালবাসতেন ‘বেলাশেষে’র সময় দেখলাম সেটা একই আছে। শ্যুট না থাকলেই সেটে আড্ডা দিতেন আমাদের সঙ্গে।
আমার জন্য কতজনকে উনি বলেছেন, স্বাতীকে তোমরা নাও না কেন ছবিতে? ডাক না কেন ওঁকে? ওঁর মতো এত ভাল অভিনেত্রী কম পাবে। দুঃখের মধ্যেও সান্ত্বনা, শেষ ছবি আমার সঙ্গেই করে গেলেন। ‘বেলা শুরু’-র পর বায়োপিক করেছেন। বড় ছবি আর করেননি। আফশোস, সেই ছবি দেখে যেতে পারলেন না!
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নেই... মনে করলেই মনে পড়ছে ওঁর আত্মীয়তা। ভীষণ আন্তরিক ছিলেন। পর পর দুটো কাজ করায় অদ্ভুত এক আত্মীয়তা তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমাদের সবার সঙ্গে। লাঞ্চের সময় খাবারদাবার নিয়ে আমার উপর একটু যেন নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। বলতেন, স্বাতী দেখো তে, ঠিক করে যেন আমায় খাবারটা দেয়। গান শোনাতেন ফাঁক পেলেই। চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ানোর দৃশ্য ছিল। কী আন্তরিক ভাবে সেই দৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন। সেই স্মৃতিই আমার সঙ্গে থেকে যাবে আমৃত্যু।
‘বেলাশেষে’ ছবির একটি দৃশ্যে সৌমিত্র এবং স্বাতীলেখা
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত: যখন খুব কাছের মানুষ কেউ চলে যান, মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। ঠিক জানে না, কী বলবে, কী করবে? আমারও অবস্থা ঠিক সেই রকমই। বুঝতে পারছি না, কী বলব! কী ভাবেই বা এই শোক সামলাব? জানি না। মনটা অনেক দিন ধরেই খারাপ ছিল। সৌমিত্রকাকু অসুস্থ। এর আগেও যতবার অসুস্থ হয়েছিলেন, এক মনে ঈশ্বরকে ডেকেছি। উনি যেন সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন। ভগবান সেই প্রার্থনা শুনেছেন। আমাদের কাছে ফিরে এসেছেন সৌমিত্রকাকু। দুরারোগ্য ব্যাধিকে হার মানিয়ে। কখনও আমাদের নিরাশ করেননি। এই প্রথম হার মানলেন কিংবদন্তি অভিনেতা। ২৫-২৬ বছর আগে প্রথম যখন অভিনয়ের দুনিয়ায় পা রাখলাম তখন থেকেই সৌমিত্র কাকুর স্নেহ পেয়েছি। কত ভালবাসা, শিক্ষা, জ্ঞানে সমৃদ্ধ করেছেন। অনেক বছর ধরে দেখেছি তাঁকে। এক বয়স থেকে আরেক বয়সে পা রাখা— সবটাই দেখলাম নিজের চোখে। আমার ছোট থেকে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। নিউ কামার্স হিসেবে যখন পা রাখলাম ইন্ডাস্ট্রিতে খুব ভয়ে ভয়ে কাজ করতাম সৌমিত্র কাকুর সঙ্গে। মনে পড়ছে, 'শ্বেত পাথরের থালা'-র সঙ্গে আরও একটি ছবি করেছিলাম, 'শেষ চিঠি'। সৌমিত্রকাকুর সঙ্গে ছিলেন তনুজা সমর্থ। বিশাল অভিজ্ঞতা সেটি আমার জীবনের। তখন সৌমিত্রকাকুর অল্পবয়স। দুর্দান্ত হ্যান্ডসাম। পরে কাজ করতে করতে যখন তুলনায় স্বাভাবিক হল সম্পর্ক, কথায় কথায় জানিয়েছিলাম, এত সুন্দর পুরুষ আমি এর আগে দেখিনি। ভীষণ রঙিন ছিলেন মানুষটি। রঙিন রঙিন শার্ট পরতেন। আমি মজা করে জিজ্ঞেস করতাম, এটা তোমার কোন গার্লফ্রেন্ড দিয়েছে? একদিন একটি শার্ট পরে এসে ডেকে বললেন, দ্যাখো, এটা আমার জার্মান গার্লফ্রেন্ড দিয়েছে! ভীষণ মজা করতেন। প্রচণ্ড হাসতেন। সেটে দরাজ গলায় আবৃত্তি করতেন। আর নানা বিষয়ে প্রচুর আলোচনা করতেন। অনেক কিছু শিখেছি ওঁর থেকে। মনে পড়ছে, বসু পরিবার ছবির শ্যুটিংয়ের সময় সেটে অপর্ণা সেন আর সৌমিত্র কাকু কত কিছু নিয়ে আলোচনা করতেন। একজন জীবনানন্দ দাশ বললেন আরেক জন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আওড়াতেন। নক্ষত্রপতনের পাশাপাশি একটা যুগ শেষ হয়ে গেল। আমি, অপর্ণা সেন আর সৌমিত্রকাকু এর আগে একসঙ্গে 'পারমিতার একদিন' করেছিলাম। সৌমিত্রকাকুর সঙ্গে আমার শেষ স্মৃতি 'বেলাশেষে' আর 'বেলা শুরু'। দুটোতেই আমরা বাবা-মেয়ে। এই দৃশ্য বাঙালি বোধহয় ভুলতে পারবে না চট করে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বাংলাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। বাংলার সৃষ্টি, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ভাষা, প্রেম, গর্ব তাঁর রক্তে, মজ্জায়। তাই আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়ার পরেও বাংলাকে ভালবাসতে কার্পণ্য করেননি।
অভিনেতার সঙ্গে ঋতুপর্ণার শেষ স্মৃতি ‘বেলাশুরু’ এবং ‘বেলাশেষে’
শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়: আমার কাছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় গুরুস্থানীয় ছিলেন। আমার অভিনয় করা থিয়েটার বা ছবি দেখে ঠিক-ভুল ধরিয়ে দিতেন। এমনকি, সংগঠনের ব্যাপারেও সব সময় মাথার উপর ছিলেন তিনি। ফোন করে বাড়ি আসার ইচ্ছে জানালেই, অনায়াসে ডেকে নিতেন সৌমিত্র জেঠু। সব সময় সব সমস্যার সমাধানের উপায় বাতলে দিতেন। তাঁর দেওয়া পরামর্শই আমাদের সব সময় সেরা মনে হতো।
শঙ্কর চক্রবর্তী: ১৯৯২ সালে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম কাজ। শেষ কাজ ‘বেলা শুরু’তে। সেখানে বাবা-ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেছি আমরা। কি অবলীলায় সব রকম চরিত্রে অভিনয় করতে পারতেন তিনি। যখন হাসপাতালে ভর্তি হলেন, ভেবেছিলাম লড়াই করে ফিরে আসবেন। সেটা আর হল না। আমি বিশ্বাস করি, উনি আমাদের আরও অনেক কিছু দিতে পারতেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগেও আমি, শান্তিলাল ওঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম। কত কথা হয়েছিল।
আরও পড়ুন: সৌমিত্রকাকু বলল, উইগ পরলে বেশি ফেলুদা-ফেলুদা লাগবে
জয় গোস্বামী: তিনি এমন একজন অভিনেতা যিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সঙ্গে, নাটকের মঞ্চেও একই ভাবে অভিনয় করেছেন। তার মধ্যেও নিজের কবি সত্তাকে জাগিয়ে রেখেছিলেন তিনি। এ বছর বইমেলাতেও তাঁর একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। সেটি খুবই উচ্চমানের ছিল। এক মঞ্চে আমরা কবিতা পড়েছি। অভিনয়ের সঙ্গেই কবিতার জগতেও অসীম অবদান ছিল তাঁর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy