Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Soumitra Chatterjee

আঁকা দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলাম, উনি চলে গেলেন, মায়াটা রয়ে গেল

সিনেমা, নাটক, কবিতা, কণ্ঠশিল্পে তাঁর নিত্য যোগাযোগ সবারই প্রায় জানা। কিন্তু অনেকটাই অজানা তাঁর তুলির টান। অনেকেরই অচেনা এই চিত্রশিল্পী সৌমিত্রর কথা লিখলেন প্রখ্যাত চিত্রকর।প্রথাগত ভাবে ছবি আঁকা শেখেননি কখনও। কিন্তু ওঁর কাজে একটা অদ্ভুত প্যাশন ছিল। আর সে কারণেই কাজগুলো অত জীবন্ত হয়েছিল।

২০১৩ সালে কলকাতায় সৌমিত্রদার ছবির প্রদর্শনী হয়েছিল। তার পর আরও দু’বার আমদাবাদ এবং বডোদরায়।

২০১৩ সালে কলকাতায় সৌমিত্রদার ছবির প্রদর্শনী হয়েছিল। তার পর আরও দু’বার আমদাবাদ এবং বডোদরায়।

সমীর আইচ
শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২০ ১৪:১১
Share: Save:

অনেক বছর আগের কথা। তবু ঘোরটা এখনও লেগে আছে চোখে। ভাল লাগাটাও।

অ্যাত্ত ছবি উনি আঁকলেন কখন! একের পর এক ছবি বার করছেন আর দেখাচ্ছেন। একেবারে শিশুর মতো। একজন শিল্পী তো এমনই হন। কিন্তু আমি তখন ভাবছি, সারা দিনের এই ব্যস্ততার মধ্যে এমন অসামান্য সব কাজ উনি করলেন কখন! মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আঁকা দেখে। মুগ্ধ নয়, তাজ্জব শব্দটাই বোধহয় ঠিকঠাক হবে।

বছর সাতেক হয়ে গিয়েছে। একদিন সৌমিত্রদার বাড়িতে গিয়েছি। আচমকাই উনি বললেন, ‘‘এই সমীর, আমার আঁকা ছবি দেখবে?’’ আমি তো এক কথায় রাজি, ‘‘দেখব না মানে, অবশ্যই দেখব।’’ এর পর একের পর এক ছবি বার করতে লাগলেন সৌমিত্রদা। অনেক অনেক কাজ।

আরও পড়ুন: প্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, পাঁচ সপ্তাহের লড়াই শেষ​

তিনি অভিনয় করতেন, কবিতা লিখতেন, নাটক লিখতেন, গদ্য লিখতেন— এ সব আমরা জানি। কিন্তু ছবির ব্যাপারটা সকলে জানেন না। আমরা যাঁরা সৌমিত্রদার সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশেছি, তারাই শুধু জানতাম। আর এটাও জানতাম, ছোটবেলা থেকেই সৌমিত্রদার ছবির প্রতি ভালবাসা ছিল। কারণটা আর কেউ নন, ভারতবিখ্যাত শিল্পী রবীন মণ্ডল। তিনি তখন হাওড়াতে থাকতেন। তাঁরই সাহচর্যে ছবির প্রতি প্রেম তৈরি হয় সৌমিত্রদার। বছর কয়েক আগে রবীনদাও মারা গিয়েছেন। কিন্তু আমৃত্যু দু’জনের যোগাযোগ ছিল।

অদ্ভুত আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন। এমনই এক আড্ডার মুডে আমি আর সৌমিত্রদা।

২০১৩ সালে কলকাতায় সৌমিত্রদার ছবির প্রদর্শনী হয়েছিল। উদ্বোধন করার কথা ছিল মৃণাল সেনের। কিন্তু অসুস্থ থাকায় উনি আসতে পারেননি। একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পাঠ করার জন্য। তার পর দু’বার আমদাবাদ এবং বডোদরায় সৌমিত্রদার ছবির প্রদর্শনী হয়েছে।

আরও পড়ুন: সৌমিত্রকাকুকে মডেলের মতো বসিয়ে ছবি এঁকেছিলেন বাবা​

সৌমিত্রদা এই ছবির ব্যাপারে কিন্তু কখনও কাউকে জানাননি। নিভৃতে কাজ করে গিয়েছেন। কাজগুলো দেখে বুঝেছিলাম, একটা দীর্ঘদিনের চর্চা ছিল তাঁর। কখন সময় পেতেন জানি না। যেমন তিনি কবিতা লিখতেন, তার চর্চা করতেন, পাঠ করতেন, তেমন ছবিও আঁকতেন। সৌমিত্রদার কাজ যাঁরা দেখেছি, তারা জানি, তাঁর কাজ একেবারেই শখের নয়। ছোট হলেও যথেষ্ট ভাল কাজ। একটা পরিশীলিত চিন্তাধারা না থাকলে, একটা অনুশীলন না থাকলে এমন ছবি আঁকা যায় না। ভীষণই আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন। সেটার ছাপ তাঁর কবিতায় পাওয়া যায়। প্রথাগত ভাবে ছবি আঁকা শেখেননি কখনও। কিন্তু ওঁর কাজে একটা অদ্ভুত প্যাশন ছিল। আর সে কারণেই কাজগুলো অত জীবন্ত হয়েছিল। কাজগুলোর মধ্যে প্রাণ ছিল।

সৌমিত্রদার খুব ইচ্ছে ছিল, তাঁর আঁকা ছবিগুলো সংরক্ষিত থাকুক। আমাদের কিউরেটর বন্ধু জ্যোতির্ময়কে বলতেন, ‘‘আমার এই কাজগুলো ঠিকঠাক সংরক্ষণ করো।’’

সংরক্ষণের প্রয়োজনও রয়েছে। পরবর্তী প্রজন্ম যেন ওঁর কাজগুলো দেখতে পারে। নাটক, ছায়াছবি, সাহিত্য— শিল্পের প্রায় সব আঙিনায় সৌমিত্রের অবাধ বিচরণ ছিল। পাশাপাশি, শিল্পকলাতেও যে তিনি পারদর্শী ছিলেন, সেটা সকলের জানা দরকার।

প্রথাগত ভাবে আঁকা শেখেননি কখনও। কিন্তু কাজে একটা অদ্ভুত প্যাশন ছিল। সে কারণেই কাজগুলো অত জীবন্ত।

আরও পড়ুন: উত্তমকুমার হয়ে ওঠেননি, কিন্তু বেলাশেষে তিনি সৌমিত্র​

শিল্পীদের প্রতি সৌমিত্রদার একটা নরম মনোভাব ছিল। আমি খুব কাছ থেকে মানুষটাকে প্রায় ২০ বছর দেখেছি। পর্দার বাইরে সব মিলিয়ে ৩৫ বছর তো চিনতামই। শিল্পীদের সঙ্গে কী আন্তরিক ভাবে গল্প করতেন! শুধু আমার একার নয়, বহু বার তিনি বিভিন্ন শিল্পীর প্রদর্শনীর উদ্বোধন করতে এসেছেন। মাস কয়েক আগেআমাদের চার শিল্পীর ‘মহাভারত’ প্রদর্শনীর উদ্বোধনেও এসেছিলেন।

অদ্ভুত আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন। এক বার সৌমিত্রদা নাটকের সেটের ব্যাপারে কথা বলতে এলেন আমার স্টুডিয়োয়। বলেছিলেন, ‘‘খুব ব্যস্ত আছি। ঘণ্টাখানেক থাকব।’’ সেট কেমন হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে নাটক আর ছবির সেই আড্ডা প্রায় ৬ ঘণ্টা চলেছিল! এমনই ছিল ওঁর সান্নিধ্য। মানুষটার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখা যেত। কথা শুনতেই ভাল লাগত। যেন একটা মায়া।

সৌমিত্রদা চলে গেলেন। মায়াটা রয়ে গেল!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy