একটা সময় ওঁর কবিতা শুনতে গিয়ে ওঁকে দেখতাম বেশি। ফাইল চিত্র।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মানুষটিকে আমার একটা মহীরুহের মতো লাগে। তাঁকে নিয়ে কিছু লিখতে আমি একটু অস্বস্তিতেই পড়ি। ওই মাপের মানুষকে নিয়ে কি কিছু লেখা যায়?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, যাঁকে আমি বলি ‘সৌমিত্রদা’, তিনি আমার বাবার বন্ধুস্থানীয়। কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে পড়তেন দুজনেই, একইসময়ে। বাবার চেয়ে বছরদেড়েকের ছোট ছিলেন। সেই সূত্রে ছোটবেলা থেকেই বাবার কাছে তাঁর অনেক গল্প শুনতাম। তাঁর সঙ্গে এ ভাবেই আমার প্রথম পরিচয়।
বাবার আপত্তি ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে আমার ‘সৌমিত্রদা’ সম্বোধনে। মাঝেমাঝেই বলতেন, “এ কী! আমার বয়সি একজন মানুষকে তুমি দাদা বলছ?” ততদিনে সৌমিত্রদা আমার কাছে একজন সর্বকালীন ‘হিরো’— সবদিক থেকেই। আর হিরোদের কখনও বয়স বাড়ে না। আমিও তাই আমার যুক্তিতে অটল থাকতাম। আমি বলতাম, “সৌমিত্রদা তো একজন হিরো। হিরোরা দাদাই থাকেন। তাঁরা কখনও কাকু, মামা এ সব হন না।” একটু বড় হতে বাবা আমাকে নিয়ে যেতেন আবৃত্তির অনুষ্ঠানে। সেই সব অনুষ্ঠানে সৌমিত্রদার আবৃত্তি শুনেছি আমি। তবে সত্যি বলতে কী, সেই ছোটতে তাঁর আবৃত্তির থেকে তাঁর দিকেই আমার বেশি মনোযোগ থাকত।
<
মননের ছোঁয়ায়, মেধার ছোঁয়ায় উজ্জ্বল তাঁর উচ্চারণ। ফাইল চিত্র।
আরও একটু বড় যখন হলাম, শেষ কৈশোর কি প্রথম যৌবন বলা যেতে পারে, তখনও তাঁকে দেখতাম। তাঁর মতো এত সুন্দর মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। সেই যে রবীন্দ্রনাথের গানে আছে না ‘মহেন্দ্রনিন্দিত কান্তি উন্নতদর্শন’, সৌমিত্রদাকে দেখলেই আমার সেই গান মনে পড়ত। সেই ‘মহেন্দ্রনিন্দিত কান্তি’তে লেগে থাকত বুদ্ধির ছটা। অমন বুদ্ধি দীপ্ত সুপুরুষ চোখে পড়ে না বেশি। তখন থেকেই বুঝেছি, সেই বুদ্ধির ছোঁয়াই লেগে থাকত তাঁর আবৃত্তিতে। তাঁর বলা কবিতা তাই অমন মন ছুঁয়ে যেত আমার। বুদ্ধির ছোঁয়ায়, মননের ছোঁয়ায়, মেধার ছোঁয়ায় উজ্জ্বল হয়ে উঠত তাঁর উচ্চারণ।
তাঁর কণ্ঠস্বরটিও ছিল আলাদা করে বলার মতো। কাজি সব্যসাচীর ভরাট উদাত্ত কণ্ঠস্বর যেমন তাঁকে আলাদা করে চিনিয়ে দিত, শম্ভু মিত্রকে যেমন চিনিয়ে দিত তাঁর সামান্য সানুনাসিক কণ্ঠস্বর আর বলার ভঙ্গি, তেমনই সৌমিত্রদাকে চিনিয়ে দিত তাঁর একেবারে নিজস্ব কণ্ঠস্বর আর নিজস্ব পাঠভঙ্গি। তাঁর কণ্ঠস্বরটি পুরোপুরি আলাদা। আমার খুব ভাল লাগত তাঁর গলায় জীবনানন্দের কবিতা। ধীরে ধীরে টানতে লাগল তাঁর বলা অন্যান্য কবিতাও। রবীন্দ্রনাথেরকবিতা, রবীন্দ্র-পরবর্তী কবিদের কবিতা এবং এখনকার সমকালীন কবিদের কবিতা। বুঝলাম একটা নিজস্ব বোধের জায়গা থেকে, বিশ্বাসের জায়গা থেকে তিনি কবিতা পড়তেন। আমি জানি তাঁর বইপড়ার অভ্যাস কতখানি ছিল। তাঁর সেই পড়া, পাঠাভ্যাস তাঁকে দিয়েছে তাঁর নিজস্ব চিন্তন। সেই নিজস্বতা ফুটে উঠত তাঁর উচ্চারণে। কবিতাকে একেবারে নিজের করে নিয়ে তিনি উচ্চারণ করতেন। তাঁর সেই উচ্চারণে আমি সমৃদ্ধ হতাম।
স্বপ্ন দেখতাম। আমি লাবণ্য, অমিতর কণ্ঠে সৌমিত্রদা। ফাইল চিত্র।
আরও অনেকের মতো সৌমিত্রদার অভিনয়ের আমি অনুরাগী ছিলাম। পুরনো ফেলুদাকে আমার খুবই ভাল লাগে। অন্য অনেক চরিত্র আছে, যেখানে চোখ বুজলে সৌমিত্রদাকেই দেখতে পাই। যে সব গল্প-উপন্যাস নিয়ে ছবি হয়নি, তেমন অনেক চরিত্রেও আমার সৌমিত্রদার চেহারাটাই মনে পড়ে। যেমন ‘শেষের কবিতা’র অমিত। যখন আমি প্রথম ‘শেষের কবিতা’ পড়ছি, হয়তো তখন কলেজের প্রথমদিক, আমি লাবণ্যর অংশটা নিজে নিজে বলতাম, আর ভাবতাম উল্টোদিকে অমিতর চরিত্রে সৌমিত্রদা থাকলে বেশ হয়। আসলে অমিতর চরিত্রে সৌমিত্রদার ছবিটাই দেখতে পেতাম।
এর অনেকদিন পরের কথা। এখন থেকে পনেরো-কুড়ি বছর আগে। একই মঞ্চে আমার আর সৌমিত্রদার অনুষ্ঠান। উদ্যোক্তারা অনুরোধ করেছিলেন আমাকে আর সৌমিত্রদাকে ‘শেষের কবিতা’র একটি অংশ পড়ার জন্য। বলাবাহুল্য যে, আমি লাবণ্য আর সৌমিত্রদা অমিত। আমার সেই ছোটবেলার ছবিটা সত্যি হয়ে গেল সেদিন! সেদিনটা আমার একটা স্বপ্নপূরণের দিন।
আরও পড়ুন: সৌমিত্রকাকুকে মডেলের মতো বসিয়ে ছবি এঁকেছিলেন বাবা
সৌমিত্রদা গল্ফ গ্রিনে আমার প্রতিবেশী ছিলেন। তার বাইরেও তাঁর সঙ্গে এমন একটা শ্রদ্ধা, স্নেহ, ভালবাসার সম্পর্ক ছিল, যে সেটা ঠিক বলে বোঝানো যায় না। সৌমিত্রদার কণ্ঠস্বরের মতো, তাঁর আবৃত্তির মতোই সেটা সকলের থেকে একেবারে আলাদা। যতবার তাঁর সান্নিধ্যে এসেছি, দেখেছি নিজের কাজ নিয়ে তিনি কতটা সিরিয়াস। যখনই একসঙ্গে অনুষ্ঠান করেছি, এক মঞ্চে আবৃত্তির অনুষ্ঠান, তখনই সৌমিত্রদা আমার কাছ থেকে জানতে চেয়েছেন, আমি কী কী কবিতা বলব। তিনি নিজে কী বলবেন, সেটা নিয়েও আলোচনা করেছেন আমার সঙ্গে।
নিজস্ব বোধ আর বিশ্বাসের জায়গা থেকে ওঁর কবিতা পাঠ। ফাইল চিত্র।
নিজের কাজে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেও, বহু মানুষের হৃদয় জয় করার পরেও, অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা, ভালবাসা পাওয়ার পরেও তিনি নিজের কাজ নিয়ে এত সিরিয়াস ছিলেন, অনুশীলনে এত জোর দিতেন, এত আন্তরিক, এত মাটির কাছাকাছি থাকা একজন মানুষ ছিলেন, যা আমি ভাবতেই পারি না। আমি ভাবতে পারতাম না এমন হয়, এমন হতে পারে, যদি না তাঁর কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ আমার ঘটত। তাঁর সঙ্গে আমি যতটা সময় কাটিয়েছি, সব সময়েই কিছু না কিছু শিখেছি। সেগুলো যে শুধু আবৃত্তির কথা তা নয়। তাঁর অনেক অভিজ্ঞতার কথা জেনেছি, তাঁর জীবনের নানা ঘটনার কথা শুনেছি। এ সব কথাও আমাকে অনেককিছু শিখিয়েছে। আমি তাঁকে অনেকবার বলেছি এ সব কথা আপনি লেখেন না কেন। উত্তরে মৃদু হেসেছেন তিনি। কিছু কিছু পত্রিকায় পড়েছি তাঁর লেখা। লেখার হাতটিও চমৎকার ছিল— কবিতা, গদ্য দুই’ই।
আমার কাছে আবৃত্তিকার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিশ্চিত ভাবে বিশিষ্ট, নিশ্চিত ভাবে বড়। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি বড় রসস্রষ্টা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, জীবনদ্রষ্টা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন: ‘অপু’ হতে অপেক্ষা করেছিলেন ৩ বছর, রেডিয়োর ঘোষক সৌমিত্রকে পছন্দই হয়নি পরিচালকের
মনে আছে, সে বার উত্তর আমেরিকা বঙ্গ সম্মেলনে আমি আর সৌমিত্রদা দুজনেই আমন্ত্রিত। সম্ভবত ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠান। সৌমিত্রদা মঞ্চে উঠবেন। উদ্যোক্তারা আমাকে বললেন, সৌমিত্রদার অনুষ্ঠানটি ঘোষণা করে দিতে। সৌমিত্রদা বললেন, “করছেনকী? এই মেয়েটিকে আপনারা ঘোষণা করতে বলছেন? ওকে আপনারা আবৃত্তি করতে বলুন। ঘোষণার জন্য আরও অনেকে আছেন।”
আমাকে এ ভাবে বারবার এগিয়ে দিয়েছেন সৌমিত্রদা। অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদেরও বলেছেন আমার কথা। এই যে স্নেহ, এই যে অনুজদের এগিয়ে দেওয়া— এটাও তো শেখার। বললাম না, যতক্ষণ তাঁর কাছে থেকেছি, কিছু না কিছু শিখেছি। কবিতার পাঠ, জীবনের পাঠ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy