ছোট্ট মেয়ে চন্দনার হাঁটু ছড়ে গিয়েছে। সেখানে কি একটু রক্ত? ১৯৭০ দশকের দামাল হিংসার দিনে সোমনাথ, সেই ‘রক্ত’ সরাসরি ব্যবহার করলেন তাঁর ‘উন্ডস্’ সিরিজের কাজে। সব রক্তই যে সন্তানের রক্ত! কফি বানাতে গিয়ে গরম দুধ পড়ে নিম্নাঙ্গ পুড়ে গেল তাঁর। ডায়েরিতে লিখেছেন সেই দহনপর্বের কথা। আমরা অবাক হয়ে দেখেছি তাঁর জগৎবিখ্যাত ধাতু-ভাস্কর্য ‘দ্রৌপদী’— কোমর থেকে নীচ অবধি পুড়ে যাওয়া এক নারীর দাঁড়ানো শরীর। পুড়ে যাওয়া শরীর, পুড়ে যাওয়া আত্মসম্মানের প্রতীক হয়ে দাঁড়াল।
চট্টগ্রামের এর মাছ-শুকোনো পাড়ের বালকের মনের কোণে থাকে তাঁর মায়ের রান্নাঘর, তাঁর এ পারে চলে আসা আর নিরন্তর বাস্তুহীনতার ব্যথা। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া যেন অনিবার্য ছিল সোমনাথের। অনেকের মতো অন্তর নাড়া দিয়ে গিয়েছিল পঞ্চাশের মন্বন্তর– কলকাতা শহরের পথে চামড়ার আড়ালে হাড়-গোনা চেহারার নারী, পুরুষ, শিশু। কমিউনিস্ট পার্টির কাগজ ‘জনযুদ্ধ’তে সোমনাথ হোর মেলে ধরছেন সেই সব ছবি, তার নিজস্ব ব্যথার আঁচড়ে। একের পর এক স্কেচ আর এচিংয়ে উঠে আসে বুক-কাঁপানো সেই ক্ষুধার ছবি, না-খেতে-পেয়ে মৃত সন্তান কোলে পিতার ছবি।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি কুলদাচরণ দাশগুপ্তের মেয়ে রেবা দাশগুপ্ত সরকারি আর্ট কলেজের শিক্ষার সঙ্গে মিশিয়ে নিলেন গণসংগ্রামের পথ। হাত ধরলেন সোমনাথের। নিরাভরণ গভীর দাম্পত্য রওনা দিল যৌথ লড়াইয়ের কঠিন পথে। হাতে দু’গাছি চুড়ি আর আটপৌরে খোলের তাঁতের শাড়ি-পরা শান্ত অবিচল রেবার একটা নিশ্চিত হাত সোমনাথকে ছুঁয়ে না থাকলে ভারতীয় চিত্রকলা আর ভাস্কর্যের ইতিহাস অন্য রকম হত হয়তো। আর সোমনাথ যখন খ্যাতির শীর্ষে থাকা পুরুষ, বিশেষ করে যখন তাঁর করা পশুপাখির স্কেচগুলি আলাদা নজর কাড়ছে বিশ্বের রসিকদের, রেবা সম্পর্কে লিখেছেন, 'রেবার কতগুলি পেন্টিং এবং ড্রয়িং দেখে মনে হয়— এগুলি করা হয়নি— নিজের থেকে হয়ে গেছে। ছবিতে রংগুলি নিজেরাই যার যার জায়গা দখল করে নিয়েছে। কুকুরের ড্রয়িং দেখে মনে হয় জ্যান্ত কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করতে করতে কখন যেন কাগজে সেঁটে গিয়েছে…'।
শান্তিনিকেতনে কলাভবনের শিক্ষক হয়ে আসা তাঁর জীবনে একটা জরুরি বাঁক, এমনটা মনে করতেন সোমনাথ হোর। অনেক মননশীল মানুষের সাহচর্য পেতে থাকলেন সোমনাথ, অথচ মজার বিষয় শান্তিনিকেতনের প্রাচ্যদেশীয় ধারার কোনও নিশ্চিত ছাপ এড়িয়ে গিয়ে পাওয়া গেল এমন এক শিল্পীকে, যাঁর কাজ চূড়ান্ত নাগরিক হয়েও প্রান্তিক। মনে পড়ে যায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাজের মূল সুরটিকেই। প্রান্তর-প্রান্তের কোণে এমন তীব্র স্বর রচনা করলেন সোমনাথ, তাঁর কাজের দিকে বিশ্ব তাকিয়ে রইল বিস্ময়ে। আর আশ্রম তো তখন আচারসর্বস্ব পর্যটকভূমি ছিল না। সোমনাথ-রেবার লালবাঁধের বাড়িতে একদিন গনগনে আঁচে পুড়ত ভাস্কর্যের ব্রোঞ্জ, আর কখনও সন্ধ্যাবেলার নিভৃত আড্ডায় এসে বসতেন সুচিত্রা মিত্র, শম্ভু মিত্রের মতো এক সময়ের গণসংগ্রামের শিল্পীসঙ্গীরা। মুড়িমাখা আর কফির অদ্ভুত বিরোধী অনুষঙ্গে কী গহীন বিনিময় হত সে সব আড্ডায়!
শোনা যায়, কলাভবনে তাঁর চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হয়নি রীতিমাফিক। বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকছেন অসম্মানিত একা সোমনাথ। ‘‘চল, তুই আর আমি গিয়ে তোর বাবার হাত দুটো ধরি’’, দুয়ারে বসে থাকা রেবা বললেন কন্যা চন্দনাকে।
‘তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম- ভিয়েতনাম’— এই স্লোগান শিল্পীরূপ পেল অলৌকিক ধাতুর শরীরে। কেউ বলে, ভিয়েতনাম বিষয়ক 'মাদার অ্যান্ড দ্য চাইল্ড' ওঁর সেরা কাজ। না, কাজটার কোনও চিহ্ন নেই। কলাভবন থেকে উধাও হয়ে যায় ওঁর জীবদ্দশাতেই। অনেকে বললেন, ঈর্ষাকাতর কেউ ওটা গরম আঁচে গলিয়েই দিয়েছিলেন– ঠিক যেমন সম্ভাবনার সন্তানকে নিকেশ করে ফেলা হয় তার গর্ভস্থানেই।
কোনও দিন ঘরে সাজানো থাকত না কোনও সম্মান-স্মারক, লালবাঁধের বাড়ি দিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বভারতীকে। কোনও সৃষ্টির কাজে সে বাড়ি কাজে লাগল না আর। বিশ্বের বাজারে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে তাঁর কাজ জেনেও কেমন উদাসীন ছিলেন সোমনাথ। এক মার্কিন সাহেব এসেছিলেন তাঁর কাছে, কথার ফাঁকে ফাঁকে পাশের অ্যটাচির ডালাটি মাঝে মাঝে ফাঁক করে দেখাচ্ছেন তাড়া তাড়া ডলার। খানিক বাদে বাটিকের লুঙ্গি পরা সোমনাথ হোর নাড়ির কাছে গেঞ্জিটা তুলে ম্লান পেটটার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে সাহেবকে বললেন, “ দেখো সাহেব, আমার এইটুকু পেট, আমাকে ও সব দেখিয়ে কী হবে।’’
হয়তো বা তাঁর এচিংয়ের, স্কেচের খিদে-মরে-যাওয়া ক্ষয়াটে পেটগুলোর কথা মনে পড়ছিল তাঁর… যে সোমনাথ হোর, কার্যত প্রায় দৃষ্টিহীন অবস্থায় এক আশ্চর্য চোখে মৃত্যুর আগে কন্যা চন্দনাকে বলেছিলেন, "চন্দন, আমি দেখতে পাচ্ছি, আকাশ থেকে সব চিল-শকুন নেমে আসছে...", সেই সোমনাথ হোর ২০০৬ সালের আশ্বিনে আশ্রমের অবনপল্লির বাড়িতে নিভে গেলেন প্রায় একাকী। তাঁর নিরাভরণ শেষযাত্রায় বেজে উঠেছিল অনুজপ্রতিম আশ্রমিক মোহন সিং এর গান– ‘উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে…’।
আজ ১৩ এপ্রিল সোমনাথ হোরের জন্মদিন। ঠিক ১০০ বছর পূর্ণ হল তাঁর।
লেখক অরবিন্দ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষার শিক্ষক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy