গায়িকা ও অভিনেত্রী সঞ্জীতা ভট্টাচার্য। ছবি: সংগৃহীত।
জন্মসূত্রে তিনি বাঙালি। তবে বড় হয়েছেন দিল্লিতে। সেই হিসাবে প্রবাসী বাঙালি তকমাটাই উপযুক্ত তাঁর জন্য। তাঁর মুখে ঝরঝরে বাংলা শুনে অবশ্য তা আঁচ করা দায়। দিল্লিবাসী বাঙালিদের বাংলায় হিন্দির যে টান শুনতে পাওয়া যায়, তার লেশমাত্র নেই সঞ্জীতা ভট্টাচার্যের কথাবার্তায়। এক বারও হোঁচট না খেয়ে গড়গড় করে বললেন, বাড়িতে তো মা-বাবার সঙ্গে বাংলাতেই কথা বলেন তিনি! ‘ফিল্স লাইক ইশ্ক’ ও ‘দ্য ব্রোকেন নিউজ়’-এর ছোট ছোট কিছু চরিত্রের পর এ বার বড় পর্দায় পা রাখছেন সঞ্জীতা। বড় পর্দায় তাঁর আত্মপ্রকাশও বেশ বড়সড় ভাবেই। শাহরুখ খানের ‘জওয়ান’ ছবির মাধ্যমে বড় পর্দায় অভিষেক হতে চলেছে তাঁর। ছবিমুক্তির বাকি এখন সপ্তাহ দুয়েক। তার আগে আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে আগাগোড়া বাংলায় আড্ডা দিলেন দিল্লির সঞ্জীতা।
প্রশ্ন: আপনি তো জন্মসূত্রে বাঙালি। বাংলাতেই প্রশ্ন করি তা হলে?
সঞ্জীতা: (ঝরঝরে বাংলায়) হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি তো বাড়িতেও সবার সঙ্গে বাংলাতেই কথা বলি!
প্রশ্ন: দিল্লিতে থেকে এত ঝরঝরে বাংলা বলেন আপনি! কলকাতার বাইরে পা রাখলেই তো বাঙালিরা বাংলা বলা ভুলে যান...
সঞ্জীতা: হ্যাঁ, সেটা তো হয়েই থাকে। আমার নিজেরই এমন বেশ কিছু বন্ধু আছে যারা বাঙালি। কিন্তু এক ফোঁটা বাংলা বলতে পারে না। আমি আসলে প্রবাসী বাঙালি ঠিকই। তবে আমার বাবা কলকাতার, আর মা ময়মনসিংহের। তাই বাঙাল-ঘটি মিলিয়ে বাংলার চলটাই আমাদের বাড়িতে বেশি।
প্রশ্ন: বাড়িতে তা হলে ওজন কার বেশি? ইস্টবেঙ্গল না মোহনবাগান?
সঞ্জীতা: আসলে আমি ফুটবল খুব একটা দেখি না। আমার বাবা এক জন চিত্রশিল্পী। বাবারও খেলাধুলোর দিকে খুব একটা ঝোঁক নেই। তাই ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান নিয়ে খুব একটা মাতামাতি আমাদের বাড়িতে হয় না।
প্রশ্ন: বড় পর্দায় আপনার অভিষেকই হচ্ছে বাদশার হাত ধরে। শাহরুখ খানের সঙ্গে একই ছবিতে আত্মপ্রকাশ... সেটা ভেবে কেমন লাগছে?
সঞ্জীতা: সত্যি বলতে, আমি এখনও পুরো বিষয়টা বিশ্বাসই হচ্ছে না। এখনও প্রসেস করছি। প্রায় দু’বছর ধরে আমরা কাজ করছি ‘জওয়ান’-এ। আর কিছু দিন পরেই ছবিটা মুক্তিও পাবে। এ বার আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি এই উত্তেজনাটা। আমার মনে হয়, যখন ছবিটা মুক্তি পাবে আর আমি দেখব নিজেকে পর্দায়— তখন বোধ হয় উপলব্ধি করতে পারব যে, স্বপ্ন সত্যি হয়েছে।
প্রশ্ন: দু’বছর ধরে শুটিং চলেছে ‘জওয়ান’-এর?
সঞ্জীতা: টানা শুটিং নয় অবশ্যই। যত দূর আমার মনে পড়ছে, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে শুটিং শুরু হয়েছিল। তখন থেকে শুরু হয়ে এই বছর পর্যন্ত... একটানা শুটিং চলেনি, তবে সব মিলিয়ে বছর দুয়েক তো বটেই।
প্রশ্ন: কখন জানতে পারলেন যে আপনি শাহরুখ খানের সঙ্গে একটা ছবিতে কাজ করতে চলেছেন?
সঞ্জীতা: ২০২১ সালের অগস্ট মাসে। অতিমারির সময়েই। নেটফ্লিক্সে আমার প্রথম সিরিজ়ের কাজ মুক্তি পেয়েছিল ২০২১ সালের জুলাইয়ে, ‘ফিল্স লাইক ইশ্ক’... তার এক মাসের মধ্যে আমি ‘জওয়ান’-এর জন্য একটা ফোন পাই।
প্রশ্ন: অডিশন দিতে হয়নি তা হলে?
সঞ্জীতা: আমি জানি না ওঁরা কী ভাবে আমাকে খুঁজে পেয়েছিলেন। ‘ফিল্স লাইক ইশ্ক’ থেকেই বোধ হয়... তার পরে আমার কাছে ফোন আসে। তবে আমাকে অডিশন তো দিতে হয়েছিল।
প্রশ্ন: অতিমারির সময়টা তা হলে আপনার ভালই কেটেছে...
সঞ্জীতা: টাচউড, হ্যাঁ। আমি গানে মন দিতে পেরেছি, নতুন গান লিখেছি, সুর দিয়েছি। তার সঙ্গে ‘জওয়ান’ তো রয়েইছে। ওই দুটো বছর আমার জন্য বেশ লাকি।
প্রশ্ন: আপনি ছাড়াও ‘জওয়ান’-এর প্রমীলা বাহিনীতে আরও পাঁচ জন অভিনেত্রী রয়েছেন। সঙ্গে নয়নতারা, দীপিকা পাড়ুকোন। সবার মধ্যমণি শাহরুখ খান। ছবিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
সঞ্জীতা: বলিউডে এত দিন নায়িকা স্রেফ নায়কের ছায়া হয়েই পর্দায় থেকেছে। কোনও সিরিজ় বা সিনেমার সেটে অভিনেত্রী হিসাবে যখন আমার নিজস্ব একটা ভূমিকা থাকে, যেটা ছবির নায়কের মুখাপেক্ষী নয়— তখন সেখানে কাজ করাটা অনেক বেশি উপভোগ করা যায়। তার উপর ‘জওয়ান’-এর সেটে এত জন অভিনেত্রী... ছবির ক্রুয়ের সদস্যরাও তখন সবাইকে তাঁদের প্রাপ্য সম্মান দেন। এত দিনে দেশে এমন ছবি তৈরি হচ্ছে যেখানে মহিলাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গল্প বলা হচ্ছে। মহিলা পরিচালক, মহিলা কলাকুশলীরা কাজ করছেন। ‘জওয়ান’ তো ভীষণ ভাবে নারীকেন্দ্রিক ছবি। এই ছবির মাধ্যমে যে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছি আমরা, সেটা আজকের যুগে দাঁড়িয়ে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সবাই খুব খুশি যে, এটা একটা প্যান-ইন্ডিয়া ফিল্ম হিসাবে মুক্তি পাচ্ছে। সত্যিই এই ছবিটা সব বয়সের দর্শকের জন্য তৈরি।
প্রশ্ন: সান্যা মলহোত্র, প্রিয়া মণির মতো অভিজ্ঞ অভিনেত্রীদের সঙ্গে কাজ করার সময় কখনও পারফর্ম্যান্স নিয়ে চাপে পড়েছেন?
সঞ্জীতা: আসলে অভিনেত্রীদের সঙ্গে কাজ করার সব থেকে সুবিধাজনক দিক হল, তাঁরা কখনও শুধুমাত্র নিজেদের পারফরম্যান্সের কথা ভেবে অন্যকে ছোট করে না। আমি জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এক জন অভিনেত্রীর (প্রিয়া মণি) সঙ্গে অভিনয় করছি বলে আমাকে কোনও দিন বাড়তি চাপ নিতে হয়নি। সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ হয়েছে। সেখানে কেউ এক জন বেশি গুরুত্বপূর্ণ, অন্য এক জনকে তেমন পাত্তা দেওয়ার দরকার নেই— এমন কখনও মনেই হয়নি। আমাদের বরাবরই মনে হয়েছে, ‘জওয়ান’ আমাদের ছবি— আমাদের সব্বার ছবি। আর আমাদের সেটের শিল্পীদের মধ্যে এত বৈচিত্র যে, সেটাই ছোটখাটো একটা দেশ। আমি বাঙালি, সান্য মুম্বইয়ের, প্রিয়া মণি দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রির... ‘জওয়ান’ প্রকৃত অর্থেই একটা প্যান-ইন্ডিয়ান ছবি।
প্রশ্ন: ‘জ়িন্দা বান্দা’ গানে শাহরুখের সঙ্গে পারফর্ম করেছেন আপনি। গানের এনার্জি প্রশংসা কুড়িয়েছে। ওই গানের শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা কেমন?
সঞ্জীতা: আমার মনে আছে প্রায় ৩ দিন ধরে ওই গানের শুটিং হয়েছিল। আর ওই গানে তো আমাদের সঙ্গে হাজার জন নৃত্যশিল্পী ছিলেন। একসঙ্গে একটা গানে নাচ করার অভিজ্ঞতা ভাষায় বোঝানো যাবে না। শাহরুখ স্যর যখন সেটে আসতেন, এমনকি, প্রিয়া মণিও যখন সেটে আসতেন... সবাই যা চিৎকার করত! তাতেই আমাদের নাচ করার উৎসাহ আরও বেড়ে যেত। চেন্নাইয়ের ওই গরমেও আমরা ওই গানের শুট যে কী উপভোগ করেছি!
প্রশ্ন: শাহরুখ তো আছেনই, সঙ্গে নয়নতারা, দীপিকা পাড়ুকোন! প্রথম ছবিতেই এত জন তাবড় তারকার উপস্থিতি....
সঞ্জীতা: আমি ভীষণই লাকি! শাহরুখ স্যর তো অসামান্য। উনি সেটে থাকা মানেই আমরা সবাই বাড়তি এনার্জি পেয়ে যেতাম। তবে নয়নতারাও অসাধারণ। এত বড় তারকা, অথচ ওঁর থেকে বিনম্রতা শিখতে হয়। প্রতি দিন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করা, প্রতি দিন নিজের কাজের জন্য কোনও রকম অভিযোগ না করে পরিশ্রম করা... এই শিক্ষাগুলোই ‘জওয়ান’-এর সেট থেকে আমার সব থেকে বড় পাওনা। দীপিকার সঙ্গে আমার কোনও দৃশ্য নেই। তবে নয়নতারার সঙ্গে অভিনয় করতে পেরেছি, এটা আমার জীবনের অন্যতম বড় পাওনা।
প্রশ্ন: অভিনয়ের জগতে পা রাখার আগে আপনি এক জন গায়িকা। বার্কলি কলেজ অফ মিউজ়িক-এ গান নিয়ে পড়েছেন। বার্কলির তরফে কয়েক বছর আগে এআর রহমানকে একটা ট্রিবিউট দেওয়া হয়েছিল, সেই দলেও আপনি ছিলেন!
সঞ্জীতা: ওটা ভীষণ দামি একটা স্মৃতি। আমরা টানা চার মাস ধরে মহড়া দিয়েছিলাম। আমাদের ওই দলে বাংলাদেশের পড়ুয়া ছিলেন। নেদারল্যান্ডস, শ্রীলঙ্কা... এ রকম কত জায়গা থেকে বার্কলিতে পড়ুয়ারা আসেন, তাঁরা সবাই ছিলেন ওই মহড়ায়। তাঁরা সবাই তামিল, মালয়ালম, হিন্দিতে গান গেয়েছেন। আমরা প্রায় পাঁচ হাজার দর্শকের সামনে ‘বন্দে মাতরম’ পারফর্ম করেছিলাম। আমার এখনও মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়।
প্রশ্ন: এখন তো গানের পাশাপাশি অভিনয়ও আছে। কী ভাবে দুই দিক সামলাবেন?
সঞ্জীতা: দুটোই একসঙ্গে সামলানো তো একটা চ্যালেঞ্জ বটেই। বিশেষত, দুটোর জন্য সময় বার করাটাই সব থেকে কঠিন কাজ। তবে আমি চেষ্টা করছি যাতে একটা ব্যালান্স রাখতে পারি দুটোর মধ্যে। গান তো আমি ছাড়তে পারব না, ছোটবেলা থেকে ওটা আমার সঙ্গী। অভিনয় আমার নতুন করে খুঁজে পাওয়া ভালবাসার মতো।
প্রশ্ন: ‘বিগিন এগেন’-এর মতো কোনও ছবিতে কাজ করার ইচ্ছা আছে, যেখানে আপনি নিজের চরিত্রের জন্য প্লেব্যাকও করতে পারবেন?
সঞ্জীতা: আমি নিজে ছবিটা দেখিনি... কিন্তু এমন ছবি করার সুযোগ পেলে তো খুবই ভাল। তবে এমন কোনও নিয়ম নেই যে আমাকে নিজের চরিত্রের জন্যই গান গাইতে হবে, আমি অন্য কোনও ছবিতে প্লেব্যাক করতেও এক পায়ে রাজি।
প্রশ্ন: আপনি জন্মসূত্রে বাঙালি। নিজের সুরে বাংলা গানের প্রভাব খুঁজে পান?
সঞ্জীতা: ছোটবেলায় আমার গান শোনার শুরু বাউল গান আর রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে। প্রায় প্রতি বছর মা-বাবার সঙ্গে শান্তিনিকেতনে যেতাম। আমার মনে আছে, সোনাঝুরিতে গিয়ে বাবা বাউলদের সঙ্গে বসে গান শুনতেন, গান গাইতেনও। আমাকেও বাবা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখিয়েছেন। বড় হয়ে আমার গানের ঘরানা বদলে গেলেও আমি জানি, কোথাও না কোথাও ওই গানগুলোই আমাকে প্রভাবিত করেছে।
প্রশ্ন: কলকাতায় কবে আসছেন?
সঞ্জীতা: এই মুহূর্তে তো তেমন কোনও পরিকল্পনা নেই। ‘জওয়ান’-এর মুক্তি আছে, তার পরে আরও কিছু কাজকর্ম রয়েছে। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি আমাকে কলকাতা ফিরতে হবে। দিল্লিতে কোথাও কলকাতার মতো রসগোল্লা পাওয়া যায় না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy