‘সোনার কেল্লায় যকের ধন’ ছবির শুটিং ফ্লোরে কোয়েল এবং পরমব্রত। ছবি: সংগৃহীত।
বিকালের এনটি ওয়ান স্টুডিয়ো চত্বর। বেশ কিছু ফ্লোরে সিরিয়ালের শুটিং চলছে। কিন্তু প্রথম ফ্লোরে ঢুকতেই থমকে যেতে হল। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নিস্তব্ধ ফ্লোর। অন্ধকারে ঢাকা এক জীর্ণ পুরনো মন্দির। মাটিতে লাল সুড়কি, দেওয়ালে ঝুলের আস্তরণ। উঁকি মারতেই দেখা গেল কম আলোয় বেদিতে কালো রঙের শিবলিঙ্গ দেখা যাচ্ছে। আর সেই শিবলিঙ্গকে প্রাণপণে সরানোর চেষ্টা করছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় ও কোয়েল মল্লিক! বিগ্রহ সরতেই ভিতর থেকে অভিনেত্রী বার করে আনলেন একটি ছোট্ট মূর্তি। খোঁজ নেওয়ার আগেই দূর থেকে ভেসে এল ‘কাট! আর এক বার শটটা নেব।’
পরিচালক সায়ন্তন ঘোষাল ‘যকের ধন’ ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির তৃতীয় ছবির শুটিং করছেন। মঙ্গলবার ছবির শেষ দিনের শুটিংয়ে হাজির হয়ে ছবি নিয়ে জানা গেল নানা তথ্য। ফ্লোরে তখন শটের আগে ক্যামেরার লেন্স বদলানো হবে। মনিটরের পিছনে একান্তে পাওয়া গেল পরিচালককে। এর আগে এই সিরিজ়ের ‘যকের ধন’ ও ‘সাগরদ্বীপে যকের ধন’ দর্শক দেখেছেন। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা গল্প অবলম্বনে তৈরি এই সিরিজ়ে বিমল ও কুমারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন যথাক্রমে পরমব্রত ও গৌরব চক্রবর্তী। মনোবিদ রুবির চরিত্রে কোয়েল।
ছবির ক্লাইম্যাক্সের শুটিংয়ের শেষ দিন। তবে এ বারে রয়েছে বাড়তি চমক। চিত্রনাট্যে গেঁথে দেওয়া হয়েছে ‘সোনার কেল্লা’র স্মৃতিমেদুরতা। খোলসা করলেন পরিচালক, ‘‘এই বছর ‘সোনার কেল্লা’ ছবিটার সুবর্ণ জয়ন্তী। তাই আমরা সত্যজিৎ রায়কে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে চেয়েছি।’’ ছবিতে রয়েছে মুকুলের চরিত্রও। তবে সেই প্রসঙ্গ এখনই খুব একটা পরিষ্কার করতে চাইলেন না সায়ন্তন। তাঁর কথায়, ‘‘বছর পঞ্চাশের মুকুলের পূর্বস্মৃতি ফিরে এসেছে। গল্পের ত্রয়ীর সঙ্গে সে আবার সোনার কেল্লায় পাড়ি দেয়। এর বেশি এখন কিছুই বলতে চাইছি না।’’ তবে এই ছবি যে ফেলুদার কোনও কাহিনির সিক্যুয়েল নয়, তা পরিষ্কার জানালেন পরিচালক। বললেন, ‘‘অনেকেই এ রকম ভাবছেন। তাই আগেই বিষয়টা স্পষ্ট করে দিলাম।’’ এই ‘শ্রদ্ধার্ঘ্য’-র কথা জানতে পেরে সত্যজিৎ-পুত্র সন্দীপ রায়ও যে খুশি হয়েছেন, সে কথাও জানাতে ভুললেন না পরিচালক। সেই মতো জয়সলমেরের সোনার কেল্লায় দিন পনেরোর আউটডোর সেরে এসেছে ইউনিট।
পরবর্তী শটের ডাক পড়তেই মনিটরে গিয়ে বসলেন পরিচালক। এ দিকে তখন ফ্লোরে হাসিঠাট্টায় মেতেছেন কোয়েল, পরমব্রত ও গৌরব। সঙ্গে রয়েছেন সাহেব চট্টোপাধ্যায়। তা ছাড়া লাল সুরকিমাখা হাত পরিষ্কার করতে ব্যস্ত তাঁরা। ইতিমধ্যে ইউনিটের মধ্যে তৎপরতা লক্ষ করা গেল। একটি বাচ্চা ছেলে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল কোয়েলকে। সকলেই তাকে সামলাতে ব্যস্ত। তত ক্ষণে ফ্লোরে খবর ছড়িয়ে পড়েছে, মায়ের শুটিং দেখতে কোয়েলের ছেলে কবীর ফ্লোরে এসেছে। পরমব্রত কবীরকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, ‘‘কী রে, আমাকে চিনতে পারছিস?’’ প্রশ্ন শুনে কবীরের মুখে তখন লাজুক হাসি। তার দাবি, ফ্লোরে বড় কোনও ঢোল কেন নেই! নেপথ্য রহস্য ফাঁস করলেন কোয়েল। হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘আসলে গত বছর ছোট পর্দায় মহালয়ার শুটিংয়ের সময় কবীর ফ্লোরে গিয়েছিল। ওখানে সেটে ওই ধরনের প্রপ্স ছিল বলেই ভেবেছে এখানেও থাকবে।’’
ফ্লোরের অন্য প্রান্তে তৈরি হয়েছে এক বিশাল সুড়ঙ্গের সেট। ইউনিট সূত্রে জানা গেল, জয়সলমেরে শুটিংয়ের ইন্ডোর পর্বগুলো কলকাতায় স্টুডিয়োর ভিতরে সেরে নিচ্ছে ইউনিট। শটের পর পরিচালক জলখাবারের বিরতি ঘোষণা করলেন। ইউনিটের প্রত্যেকের হাতে ঘুরছে মুড়ি-চানাচুর। সঙ্গে রয়েছে আলুর চপ। ফ্লোরের বাইরে এক কোণে চেয়ারে বসে ফোনে মগ্ন পরমব্রত। বলছিলেন, ‘‘আগের দুটো ছবি সফল বলে এ বারে আমাদের প্রত্যাশা আরও বেশি।’’ রাজস্থানে আউটডোরেও যে দারুণ শুটিং করেছেন, সে কথাও জানালেন পরমব্রত। বললেন, ‘‘আমার জীবনে দেখা প্রথম থ্রিলার ‘সোনার কেল্লা’। সেই শহর এখন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। কিন্তু আউটডোরে অনেক স্মৃতি মনে ভিড় করছিল।’’
পরবর্তী শটে ডাক পড়ল অভিনেতাদের। কোয়েল হাতে মূর্তি ধরতেই তাঁর মাথায় বন্দুক ধরল এক গুন্ডা। বলল, ‘‘উয়োহ্ মূর্তি হমে দে দিজিয়ে।’’ এ দিকে ফ্লোরের অন্য প্রান্ত থেকে দুষ্প্রাপ্য মূর্তিটির দাবি জানাল সুনীল ভার্গব অর্থাৎ সাহেব। ক্লোজ় আপ আর ওয়াইড মিলিয়ে শট নিয়ে খুশি পরিচালক। সাহেব কি এই ছবির খলচরিত্রে? হেসে অভিনেতা বললেন, ‘‘এখন কিছুই বলা বারণ। তবে এটুকু বলতে পারি, চরিত্রটার মধ্যে অনেকগুলো স্তর রয়েছে। চরিত্রটা ভাল না কি খারাপ, সেটা ছবির শেষে বোঝা যাবে।’’ ফ্লোরের এক কোণে দাঁড়িয়ে অভিনেতা সুপ্রভাত দাস। তিনি ছবিতে মুকুলের চরিত্রে। কিন্তু অভিনেতা আপাতত মুখে কুলুপ এঁটেছেন। কোনও মন্তব্য করতে নারাজ। কারণ, তাঁর চরিত্রটির রহস্য এখনই খোলসা করলে নাকি ছবির ‘যাবতীয় মজাই মাটি!’ নির্মাতাদের তরফেও অনুরোধ, বাঙালির পছন্দের ‘জাতিস্মর’ চরিত্রটি নিয়ে এখনই খুব বেশি তথ্য যাতে দর্শকদের না জানানো হয়। অতএব অনুরোধ রক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
শট শুরুর আগেই ফ্লোরে আবার হাসিঠাট্টা শুরু। ইউনিটের এক জনই ভুল করে মন্দিরের থামে হেলান দিতে সেটি নড়ে গিয়েছে। স্বাভাবিক। কারণ, পুরোটাই যে নকল! পরমব্রতের সতর্কবাণী, ‘‘সাবধানে।’’ কোয়েলের শুটিং প্রায় শেষের দিকে। সেটে প্রপ্স-এর সামান্য কাজ শুরু হল। কোয়েল ফ্লোর থেকে বেরিয়ে এসে খোলা হাওয়ায় চেয়ার নিয়ে বসলেন। তাঁকে দেখে উপস্থিত মানুষের নিজস্বী তোলার অনুরোধ এল। স্টুডিয়োর এক পুরনো কর্মী এগিয়ে এসে বললেন, ‘‘মা, তুমি কেমন আছ? অনেক দিন পর তোমাকে দেখলাম।’’ কোয়েল হাসিমুখে তাঁর সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করলেন। বললেন, ‘‘এখানকার পুরনো কর্মীরা অনেকেই হয়তো আমার বাবার সঙ্গে কাজ করেছেন। ছোট থেকে আমাকে বড় হতে দেখেছেন। একটা অন্য রকম আত্মীয়তা তৈরি হয়ে যায়। এখন তো স্টুডিয়োতে কম আসা হয়। তাই দেখা হলে আমারও মনটা ভাল হয়ে যায়।’’
ছবির প্রসঙ্গে ফিরলেন কোয়েল। বলছিলেন, ‘‘সব ভালরই একটা শেষ হয়। শেষ দিনের শুটিংয়ে তাই একটু মন খারাপ। রাজস্থানে আমরা সবাই হইহই করে ছবির শুটিং করেছিলাম।’’ কথাপ্রসঙ্গেই রাজস্থানের মজার অভিজ্ঞতা শোনালেন কোয়েল। উটের পিঠে চড়েও নাকি তাঁকে ছবিতে শট দিতে হয়েছে। হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘সবাই আমরা উটের পিঠে। এ দিকে আমার কলকাতায় ফেরার ফ্লাইট ধরতে হবে। তখন মনে হচ্ছিল, দ্রুত শট শেষ করতে হলে উটকে ঘোড়ার মতো ছোটানো ছাড়া উপায় নেই।’’ ইতিমধ্যে স্পট বয় এসে উপস্থিত। কোয়েলকে শটে ফিরতে হবে। ওঠার আগে বললেন, ‘‘ছবি নিয়ে আর আলোচনা নয়। বাকিটা প্রেক্ষাগৃহের জন্য তোলা থাক।’’
ছবিতে থাকছে প্রচুর ভিএফএক্স-এর কাজ। তাই সুরিন্দর ফিল্মস প্রযোজিত এই ছবির মুক্তি নিয়ে এখনই কোনও দিনক্ষণ জানাতে রাজি নন পরিচালক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy