ননীচোরার ‘শিমুল পলাশ’ গানে কৌশানী ও শিবপ্রসাদ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পূর্বপুরুষের সূত্রে আমাদের এই পেশা। খুব ছোটবেলা থেকে দাদু, বাবা, কাকাদের বহুরূপীর সাজে সাজতে দেখেছি। ছোটবেলায় কার্তিক দাস বাউলের গান শুনেছিলাম একদিন। তখন স্থির করি বাউল গানও শিখব। বাড়িতে সেই সময় কিছুই নেই। ঠিক মতো খাবার জুটত না। একটি টিনের কৌটো ছিল। তাতে ছিদ্র করে গাবু বাদ্যযন্ত্র তৈরি করলাম। ওটা দিয়েই অনুশীলন জারি থাকল। একদিন বাবাকে বললাম আমার একটা গাবুর প্রয়োজন। প্রাথমিক ভাবে বাবা শুনে বলেছিলেন, “তোর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। বহুরূপীকেই ধরে রাখ না।” পরে বাবা রাজি হয়েছিলেন, একটা গাবু এনে দিয়েছিলেন।
আমার কাছে বহুরূপী ও বাউল সমান মান্যতা পেলেও অধিকাংশ মানুষের কাছে বহুরূপী শিল্প মর্যাদা পায় না। দু’-চার টাকা দিয়ে দেওয়া হয় বহুরূপী শিল্পীদের। প্রায় মাধুকরীর সমকক্ষ করে তোলা হয় এই শিল্পকে। হাসি-কৌতুক চলতে থাকে, ন্যূনতম সম্মানটুকু দেওয়া হয় না। এই প্রসঙ্গে আমার এক অভিজ্ঞতার কথা ভাগ করে নিতে চাই পাঠকদের সঙ্গে। একটি গ্রামে গিয়েছি। এক মদ্যপ এসে আমাকে বললেন, “এই, এটা তোর কী সাজ?” আমি বলেছিলাম, “এটা কী জানেন না? বহুরূপী এটা।” তার পরে তিনি বললেন, “তুই বহুরূপী সেজেছিস! কাজ করতে পারিস না?” বহুরূপী কোনও কাজ নয়। কোনও শিল্প নয় আর! এই অসহ্য বেদনা সহ্য করে বেঁচে থাকি আমরা বহুরূপীরা।
বহুরূপীর জগৎ খুব কষ্টের। রাস্তায় বহুরূপী সেজে বেরিয়েছি, কেউ এমন টিটকিরি দিল যে শুনেই এত কষ্ট হল! আবার এমনও হয়েছে, কেউ একজন এত ভাল কথা বলেছে শুনে খুব ভাল লেগেছে। তবে গায়ক হিসাবে আমাকে যখন কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়েছে তখন সম্মান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বহুরূপী শিল্পী হিসাবে কখনও সেই সম্মান পাইনি আমি। লোকে সেই সাজ দেখে বলে, “এই দেখো ফাজলামি করতে চলে এসেছে!”
গ্রামবাংলার এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে কিন্তু সরকারি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন। আগের সরকারের থেকে কোনও রকম সহায়তা পাইনি। তবে বর্তমান সরকার ১ হাজার টাকা ভাতা দেয় বহুরূপী শিল্পীদের। আমাদের সাজপোশাক ও শিক্ষার জন্য অর্থের প্রয়োজন। যদি কোনও সরকারি অনুদান পাওয়া যায় তা হলে বহুরূপী শিল্পীরা এই শিল্পকে ধরে রাখতে পারবেন। পাশাপাশি এই শিল্পের প্রতি মানুষের গ্রহণযোগ্যতাও বৃদ্ধি করতে হবে।
আমি মাঠে ধানচাষ করি। কিন্তু গ্রামবাংলার এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে গ্রামে গ্রামে গিয়ে বাচ্চাদের আনন্দ দিই। গুটি কয়েক মানুষ সম্মান দিলেও তাচ্ছিল্যের পরিমাণই বেশি। বর্তমানে এই শিল্প লুপ্তপ্রায়। আগের দিন ছিল উজ্জ্বল, পাঁচ দিন পাঁচ রকমের সাজ বা সাত দিনে সাত রকমের সাজ দেখিয়ে শেষ দিনে আদায় করতে বেরোতাম। কৃষ্ণ, রাম, কালী, রাক্ষস, গোয়ালিনী কত রকমের সাজ! মন ভরে উঠত। পুরাণের কথা বলতাম। গল্পেরা যেন রূপকথা হয়ে ফিরত। এই অবসরে বলে রাখি, নানা সাজের মধ্যে ‘তারাসুন্দরী’র চরিত্র আমার সবচেয়ে প্রিয়। বর্ধমানের নন্দ রাজার একমাত্র পুত্রবধূ সে। অনেকটা সাজা যায় এই চরিত্র হতে গেলে। তবে কিনা সে অগোছালো। কখন কী মনের ভাব, বোঝা দায়! এমন মানুষকে শরীরে ধারণ করতে, মনের কথা সুরে বলতে আমার বেশ লাগে। ভয় লাগে না যে, সব কিছুই বলা যায়।
আমি বীরভূমের যে গ্রামে থাকি সেখানে সকলেই পেশাদার বহুরূপী। শুধু রাতে হাঁড়ি চড়ে আমাদের। সারাদিন ঘুরে ঘুরে কাজ করেন গ্রামবাসীরা। আগে মানুষ শিল্পটাকে মর্যাদা দিয়ে পারিশ্রমিক দিতেন। এখন তো আমরা পথের ভিখারি। মানুষের মনোযোগ নেই এই শিল্পের প্রতি।
আমার এই পোড়া জীবনে মোড় ঘুরিয়ে দিল ‘বহুরূপী’ নামের বাংলা ছবি। গান গাইতে পারলাম, এটা আমার কাছে পরম সৌভাগ্য। আমার লেখা গান আমি গেয়েছি, তার পুরো কৃতিত্ব নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের। আমি তো বহুরূপী। রেকর্ডিং হল আমার গলা। কোনও দিন ভাবতেও পারিনি। তবে কাজ করতে গিয়ে একটা বিষয় খেয়ালে এল। আমার থেকেও বড় বহুরূপী শিবপ্রসাদ স্যর। ওঁর অভিনীত চরিত্রে ওঁর কাজ দেখার মতো। কৌশানীদিও ভাল। আমার গান এত মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছে তাতেই খুশি আমি। তবে সাফল্য নিয়ে এখন ভাবছি না। অনেকে বলছেন, আরও নাকি সুযোগ আসতে পারে। এলে তো ভালই। তবে ভবিষ্যৎ কেউ জানে না। জীবন অনেক বড়। থেকে থেকে বদলে যায়। একটাই আক্ষেপ, ‘শিমুল পলাশ’ গান তো গাইলাম, কিন্তু বহুরূপী সাজলে আজও লোকে ভাবে ভিক্ষা করছি।
অনেকে প্রশ্ন করেন আমায়, মানুষ কি বহুরূপী? মানুষ অবশ্যই বহুরূপী। এক রূপ থেকে অন্য রূপে সে পরিবর্তন করে নিজেকে। এ বহুরূপী ছাড়া আর কী! ভিতরে এক রূপ ও বাইরে এক রূপ বা অনেক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy