‘বুমেরাং’ ছবির একটি দৃশ্যে জিৎ-রুক্মিণী।
মানুষের অনুভূতি কমছে। মানুষ যন্ত্র হয়ে যাচ্ছে। বলা ভাল, ‘রোবট’ হয়ে যাচ্ছে। কারণ, এটা ডিজিটাল যুগ। শিল্প বিপ্লবের পর এত বড় প্রযুক্তিগত বিপ্লব আর হয়নি বলেই অনেকে মনে করছেন। ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ শব্দটা এখন মানুষের মুখে-মুখে ফেরে। মানুষ এই বস্তুটির জেরে দ্রুত কর্মহীন হয়ে যাচ্ছে বলে বিশ্বাস। এই সব কথা হালফিল বারবার শোনা যাচ্ছে। সিনেমার মতো প্রযুক্তি নির্ভর শিল্পই বা এর বাইরে থাকবে কেন! থাকছেও না। সারা দুনিয়াতেই ‘সিঙ্গল স্ক্রিন’-এর বদলে ওটিটি প্ল্যাটফর্মকে মাথায় রেখেই সিনেমা তৈরি হচ্ছে। ওটিটি-র দর্শক আজ সারা দুনিয়ার সিনেমা মুঠোফোনে দেখে নিচ্ছেন এক লহমায়। তাই মূল ধারার সিনেমার বিষয়েও এই বদলে যাওয়া জীবনবোধ ঢুকে পড়ছে। ‘বাণিজ্যিক’ ছবির মারামারি আর চুম্বনের মুহূর্তগুলি আর সেকেলে থাকছে না।
সদ্য মুক্তি পাওয়া ছবি ‘বুমেরাং’ দেখতে গিয়েও এই কথাগুলিই মনে হল। অভিনেতা জিৎ আর অভিনেত্রী রুক্মিণী মৈত্রর অভিনয়ের কথা শুনে ছবিটি যে ধারার বলে প্রথমেই মনে হয়, এ ছবি সে ধারা থেকে আলাদা। গল্প ‘ব্রিলিয়ান্ট ব্রেন’ সমর সেন নামের এক মধ্যবিত্ত বাঙালির। তিনি চান চাকরি-বাকরির বদলে তাঁর আবিষ্কারের স্বপ্নকে নিয়েই জীবনটা কাটাতে। কিন্তু যে হেতু মধ্যবিত্ত বাঙালি আর যে হেতু তার এক বড়লোক প্রেমিকাও আছে, তাই তাঁকে চাকরি করার জন্য বাধ্য করতে থাকে মেয়েটির পরিবার। প্রফেসর শঙ্কুর মতো তাঁর তো পোষ্য বিড়াল আর গিরিডির সূর্যাস্ত সঙ্গী হতে পারে না, তিনি খোদ কলকাতার মধ্যবিত্ত। তাই তাঁকে চাকরির জন্য চাপ দিতে থাকে মেয়েটির বাবা-সহ গোটা সমাজ। কিন্তু তাঁর নিয়তি আলাদা। তাই বাইক উড়িয়ে বহুতলে ঝুলন্ত বাচ্চাকে উদ্ধারই হোক বা অদৃশ্য মুঠোফোন আবিষ্কার বা মানুষের বিকল্প রোবট বানাবার জেদ— তিনি একের পর এক আবিষ্কার দিয়েই নিয়তির চাকা ঘোরাতে থাকেন। ক্লাইম্যাক্সে যন্ত্রই হয়ে ওঠে মূল হিরো, এ ছবির। যন্ত্র যে মানুষের কেবল শত্রু না, বন্ধুও হতে পারে— এ ছবি শেষ পর্যন্ত তা প্রমাণ করে।
ছবিটির আর একটি দিক নিয়েও কথা বলা দরকার। সেটি হল, এ ছবির পার্শ্বচরিত্রদের উপস্থিতি। অম্বরীশ ভট্টাচার্য, খরাজ মুখোপাধ্যায়, রজতাভ দত্ত বা শ্যামল চক্রবর্তীদের উপস্থিতি ছবিটিকে অন্য মাত্রা দেয়। সকলেই কমেডিকে আশ্রয় করে নিজেদের অভিনয় করেছেন। কিন্তু যে হেতু প্রত্যেকেই খুব শক্তিশালী অভিনেতা, তাই মেয়ের বাবাই হোক বা নারী-আসক্ত ‘ওহ লাভলি’ বলা প্রতিবেশী বা চৈনিক দুষ্কৃতী— সব ক’টি চরিত্রেই অনবদ্য লাগে প্রত্যেককে।
কল্পবিজ্ঞান বাংলা সাহিত্যের বহু পুরনো এক ধারা। কিন্তু বাংলা সিনেমায় সে ধারার বাস্তবায়ন সম্ভব কি না, তা নিয়ে বার বার পরিচালকেরা ভেবেছেন। কারণ প্রযুক্তি আর অর্থের সীমাবদ্ধতায় ধাক্কা খেয়েছে এই ভাবনা। তাই বাংলা সাহিত্যে অনবদ্য সব গল্প থাকলেও, তা থেকে সিনেমা বানানো যায়নি, গেলেও অবাস্তব মনে হয়েছে। কিন্তু এ ছবির পরিচালক সৌভিক কুন্ডু সে রিস্কটা নিয়েছেন। তার জন্য যথাসাধ্য প্রযুক্তির ব্যবহারও করেছেন। তাই মানুষের মতো রোবট বানানোর ল্যাবরেটারিটা দেখতে খুব মন্দ হয়নি। উড়ন্ত বাইক বা জিৎ-রুক্মিণীর বিকল্প রোবটগুলিও অনেকটাই বিশ্বাস্য লেগেছে। কিন্তু কোথাও যেন একটু হলেও অবাস্তব লেগেছে গোটা বিষয়টা। সেটা কি গল্প বলার ধরনে না কি প্রযুক্তিগত দুর্বলতায়?
আমার মনে হয়, মধ্যবিত্ত বাঙালির গল্পের সঙ্গে এ হেন কল্পবিজ্ঞানের মিশেল চিত্রনাট্যে আরও মজবুত হতে পারত। যদিও সমকালের রাজনীতির অনেক ছোট-ছোট মোচড় নিয়ে তির্যক ঠাট্টা রয়েছে এখানে, তবু নেহাত হাসির পাশে সংলাপ বা নাটকীয়তার জায়গায় আরও নিপুণ হতে পারত চিত্রনাট্য। তা হলে আরও ঠাসবুনোট এবং বিশ্বস্ত মনে হত গোটা গল্পটা। যে হেতু এ গল্প নেহাত কল্পবিজ্ঞান না, মানবিকও, তাই সংবেদনের দরকার ছিল আরও। সেখানে বড্ড দ্রুতই যেন বিয়ে ভেঙে যাওয়া বা দ্রুত সমর সেনের উত্থান চোখে লাগে। কিছু জায়গায় চোখে লাগে সমরের মা-বাবার উপস্থিতিও। বিশেষ করে ছেলের বাড়িতে হবু বৌমার বদলে যখন তাঁরা রোবট বৌমাকে দেখেন, তার পর তাঁদের প্রতিক্রিয়াগুলি বড্ড কেঠো যেন। আর একটু কি বিশ্বস্ত করা যেত না গোটা বিষয়টা?
তবে সৌরভ দাস অভিনীত পার্শ্বচরিত্রটি বেশ মজার। তাঁকে ঘিরে চিত্রনাট্যে যে ওঠাপড়া, তা সত্যিই আনন্দ দেয়। নায়কের এমন সৎ-শাগরেদ এক কালে বাংলা ছবিতে অনেক দেখা যেত। তরুণ কুমারের কথা মনে পড়ে এ প্রসঙ্গে। সৌরভের সারল্য তাই ভাল লাগে। আগেই বলেছি, প্রত্যেকটি পার্শ্বচরিত্রই আলাদা করে দাগ কাটে মনে। বরং রুক্মিণীর চরিত্রটির আরও অনুভূতি দরকার ছিল বলে মনে হয়। প্রেমিককে ভরসা যে দিল এত কাল, তার হঠাৎ বাবার কথায় বাড়ি ফিরে এসে বিয়ের জন্য রাজি হওয়া এত দ্রুত কী ভাবে সম্ভব? তার এই মানা বা না-মানার ওপর অনেক কিছুই দাঁড়িয়েছিল ছবির। কিন্তু তাঁকে এত দ্রুত সব অনুভূতির রোবট বানানো হল যে, আসল রোবটের মতোই মানবিক হিসাবে কিছুটা খামতি চোখে পড়ল।
বরং ভাল লাগল বেশি জিৎকে। কারণ তিনি এখানে ‘সুপারস্টার’ হওয়ার বদলে বাড়ির পাশের ছেলেটা হয়ে উঠতে চেয়েছেন। তাই কিছুটা নরম তাঁর চরিত্র, কিছুটা স্বাভাবিক। অতি নাটকীয়তা আজকের ডিজিটাল দুনিয়ায় অস্বাভাবিক, তা অভিনেতা এবং প্রযোজক হিসাবে তিনি জানেন। তাই সব দিক দিয়েই সে সব এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন তিনি। হয়ে উঠতে চেয়েছেন ‘মিনিম্যাল’। সারা ছবি জুড়ে তাই তাঁকে বড় কাছের মনে হয়।
শেষে বলব, রুক্মিণী মৈত্র অভিনীত চরিত্রের জন্য পাত্র নির্বাচনের সময়, তাঁকে টলিউডের প্রথম সারির নায়কদের ছবি দেখান তাঁর বাবা। তাঁদের মধ্যে ছিল অভিনেতা দেবের ছবিও। দেব যদি একটি দৃশ্যেও এ ছবিতে নেমে আসতেন, সদর্থে একটা ‘বুমেরাং’ জাতীয় ঘটনা ঘটে যেতে পারত। কারণ দেব-রুক্মিণীর রসায়নের কথা আমরা সবাই জানি।
সেটুকু রস থেকে বঞ্চিত হওয়ায়, এত হাসাহাসির পর খানিক মনখারাপ থেকেই গেল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy