‘অযোগ্য’ ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত।
বিশেষ প্রদর্শনের শুরুতেই পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় (আজকাল আর তাঁর পরিচয়টা পরিচালকেই আটকে নেই) জানালেন ‘অযোগ্য’ তাঁর পরিচালনায় ৩২তম ছবি। আর সেই ছবির প্রধান দুই চরিত্রাভিনেতা, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত জুটির এটি ৫০তম ছবি। যে কোনও ভাষার ছবিশিল্পে এমন ঘটনা অনস্বীকার্য ভাবে মৌলিক। এবং এই তথ্যটির উপর বার বার জোর দেওয়ার মধ্যে এটাও শুরুতেই পরিষ্কার হয়ে গেল যে, পরিচালক হিসেবে কৌশিক এই ঘটনাকেই উদ্যাপন করতে চেয়েছেন ‘অযোগ্য’র মধ্যে দিয়ে। এবং এটি করতে গিয়ে তিনি যে ছবিটি বানিয়েছেন, তা হয়ে উঠেছে একটি ‘রোম্যান্টিক-থ্রিলার’। আর কাহিনিটি ঘটনা পরম্পরার ভিড়ে কঠিন হয়ে গিয়েছে বটে, তবে ‘জম্পেশ’ যাকে বলা যায়, তার ধারেকাছেও পৌঁছয়নি।
‘রোম্যান্টিক-থ্রিলার’। কেমন সোনার পাথরবাটির মতো শোনাচ্ছে না শব্দবন্ধটি? কিন্তু ঘটনা তেমনই ঘটেছে ছবিতে। দর্শক আজকাল ‘থ্রিলার’মুখী, এই চলতি হাওয়ার পন্থী হয়ে, কৌশিক চিত্রনাট্যে যে ‘থ্রিলার’ (একটি গোপন খুন, হালকা রাজনৈতিক মোচড়, এবং পরবর্তী প্রজন্মের সেই খুনের বদলা নেওয়ার ইঙ্গিত) অংশটি রেখেছেন, তা দুর্ভাগ্যবশত ছবির চলনের সঙ্গে ঠিক মেলে তো না-ই, বরং শেষ পর্যন্ত ঝুলন্তই রয়ে যায়। ছবির বাকি গল্পের কথন এত সুরেলা যে এই অংশটি বেসুরোই রয়ে যায়। এবং সেটি দর্শককে খানিক আশাহত তো করেই! জানা গেল, এ ছবির গল্প ‘দাঁড় করাতে’ প্রায় এক বছর লেগেছিল। তা হলে আর একটু মসৃণ করা যেত না দুটো গল্পের চলনকে? এই ঘটনাটা কৌশিকের মতো গল্পবলিয়ের কাছ থেকে এলে, একটু আশাহত তো লাগেই। যে মানুষটা ‘বাঘনখ’ শোনাতে পারেন, তাঁর কাছ থেকে এমন অমসৃণতা! আক্ষেপ, আক্ষেপ।
তবে কৌশিকের মূল লক্ষ্য যা ছিল বলে ছবি দেখে মনে হল, সেই বুম্বা-ঋতুর উথালপাথাল রোম্যান্টিক সম্পর্ককে ভারী সুন্দর ভাষ্য দিয়েছেন পরিচালক। সর্বৈব উথালপাথাল প্রেমই বটে। এবং সবচেয়ে মনোগ্রাহী হল জুটির রোম্যান্স রসায়ন নয়, দুই চরিত্রের অভিনয় ক্ষমতার উদ্যাপন। প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত দু’জনের অভিনয়ে অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে, অনেকটাই পরিণতি পেয়েছে তাঁদের অভিনয় ক্ষমতা, তা বাংলা ছবির নিয়মিত দর্শক মাত্রেই জানেন। সেই গুণটিকেই সম্পূর্ণ রূপে কাজে লাগিয়েছে ‘অযোগ্য’র চিত্রনাট্য, যা প্রণিধানযোগ্য। কেবল রোম্যান্সের উপর খেলে দিলে ছবিটি অবশ্যই এতটা আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারত না। সহজ হত হয়তো, কিন্তু কৌশিকের মতো পরিচালকের কাছ থেকে তা আশা করা উচিত নয়। এবং সেটা সম্বন্ধে কৌশিক ওয়াকিবহাল। উনি ভীষণ বুদ্ধিমান পরিচালক, এবং কোন পেরেকে কখন ঘা দেবেন বাজিমাত করতে, সে সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা রাখেন। ‘অযোগ্য’ তার-ই পরিচায়ক। তাই স্বীকার করতে বাধা নেই, এ ছবি প্রধান লক্ষ্যে সম্পূর্ণ সফল।
এবং তার জন্য যা যা উপকরণ লাগে, তা কৌশিক বেছে নিয়েছেন ভারী যত্নের সঙ্গে। চরিত্রাভিনেতা যাঁদের বেছেছেন—শিলাজিৎ মজুমদার, লিলি চক্রবর্তী, অম্বরীশ ভট্টাচার্য, সুদীপ মুখোপাধ্যায়— এঁরা সকলে আধুনিক বাংলা অভিনয়শিল্পের অন্যতম শক্তিশালী অভিনেতা। সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই সবাই মিলে যে কাজটি তুলেছেন সেটি অভিনয়ের দিক থেকে মাখনের মতো মসৃণ।
সবচেয়ে বড় কথা, কৌশিক ‘অযোগ্য’-এ এই সময়ের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর নির্মম ভাবে আলো ফেলেছেন। পেশা-বহিষ্কৃত আধুনিক পুরুষের অসহায় মানসিক যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণা কতটা মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে, তা শিলাজিতের মাপা অভিনয়ে বড় শিল্পসম্মত ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এই রকম লজ্জায় গোপন করে রাখা একটি বঙ্গীয় সামাজিক ব্যাধিকে সামনে এনে নির্মম এবং নির্লজ্জ ভাবে কাটাছেঁড়া করতে সাহস লাগে। তাই আরও বাহবা, কৌশিকের জন্য।
ছবির গল্প, মোচড়, প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণার প্রেমের জোয়ারের উপস্থাপনা– এগুলো যে হেতু ছবির ব্রহ্মাস্ত্র, তাই সে সম্বন্ধে কোনও শব্দ খরচ করা বাঞ্ছনীয় নয়। না হলে পরিচালকের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাই শুধু নয়, অপ্রাসঙ্গিক আলোচনাই বেশি হবে। তাই সে সব ঊহ্য রইল।
শেষে দু’টি কথা। শেষ দৃশ্যে প্রসেনজিতের আগমন বড় ‘নস্টালজিক’, সেই ‘পোসেনজিত’ দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। আর একটি ব্যক্তিগত আক্ষেপ। পুনরুত্থানের পর এই জুটি একসঙ্গে চারটি ছবি করলেন। ‘প্রাক্তন’, ‘দৃষ্টিকোণ’, ‘প্রসেনজিৎ ওয়েডস ঋতুপর্ণা’ (এটি আবার তাঁদের আপন সংস্থার যৌথ প্রযোজনায়), এবং ‘অযোগ্য’। কিন্তু একটাও মিলনাত্মক হল না। জীবন হয়তো তাঁদের মেলায়নি, কিন্তু সিনেমা তো পারত? না কি ধরে নেব বাঙালি এখনও প্রাপ্তমনস্ক এবং যথেষ্ট সাহসী হয়ে উঠতে পারেনি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy