যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারতলার জানলা দিয়ে দেখি, বৈশাখের খর রোদ্দুরে আকাশ বেয়ে গলগল করে গড়িয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণচূড়ার লাল, রাধাচূড়ার হলুদ, চার নম্বর গেটের বাইরে ছেঁড়া পোস্টার: পার হয়ে আসা ভোটের স্মৃতি। কেমন যেন মনে হয়, হয়তো সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিন বলেই ‘পথের পাঁচালি’-র অপু আজ কৈশোর থেকে যৌবনে পা দিলে, গ্রাম থেকে শহরে এসে কী ভাবে নিজেকে পাল্টে নিত। অপুর সংসারে দারিদ্র ছিল, কিন্তু কবিতাও ছিল। কিনু গোয়ালার অন্ধকার গলিতে সিন্ধু বাঢ়োয়াঁ-য় তান লাগানোর মতো যুক্তি থাকত। আজ এই হতকুচ্ছিত শহর অপুকে কি আশ্রয় দিতে পারত? আমরা তো শুনে আসছি, সত্যজিৎ এমন এক মানবতাবাদী, রোজকার রাজনীতির রোজনামচায় যাঁর দেখা মেলে না। যেন তাঁর ছবি যুধিষ্ঠিরের রথ, মাটি ছুঁয়ে চলে না! সত্যজিৎ নিজে কি এমন প্রশ্নের উত্তর দিতেন?
ইতিহাসের অপার কৌতুক যে ‘জনঅরণ্য’ ছবির নায়ক সোমনাথ ইতিহাসেরই ছাত্র ছিল। সত্তর দশকের কিংবদন্তিতুল্য লোডশেডিং তাঁর ডিগ্রিটিকে যে অবান্তর করে দেয় তা, আমার মনে হয়, সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে এক চূড়ান্ত রাজনৈতিক বক্তব্য। যে অপু পঞ্চাশ দশকের শেষে অধ্যক্ষের ঘরের বাইরে ছাত্র আন্দোলনের স্লোগান শুনেছিল সে আজ দেখতে পায়, দেওয়াল লেখায় চিনের চেয়ারম্যান মাও সেতুং-এর স্টেনসিল কী ভাবে ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য’ ইন্দিরা গাঁধীতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এ রকম স্মৃতি দরজায় কড়া নাড়লে অনুতাপ হয়, কেন যে সাবেকি ঘরানার চিন্তার দাপটে আমরা সুকুমার-তনয়কে ‘অরাজনৈতিক’ ভেবে বসলাম!
সুতরাং সত্যজিৎ রায় কোন ধরনের মানবতাবাদী— এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে দেখব তাঁর বক্তব্য এক ধরনের রাজনৈতিক দোলাচল ধারণ করে আছে যা আমাদের বিখ্যাত উনিশ শতকীয় আলোকপ্রাপ্তির মধ্যেই নিহিত। ‘চারুলতা’ ছবিতে ভূপতির স্ত্রীকে এক দিন সুরেন বাঁড়ুজ্জের বক্তৃতা বুঝিয়ে দেবে বলে। চারুলতা সে সব না বুঝেও ‘স্বর্ণলতা’ পড়ে বা বাল্যস্মৃতি লিপিবদ্ধ করে। যে ঔপনিবেশিক বুদ্ধিজীবী তাঁর মুখপত্রে ‘সত্য জয়ী হবেই’ ঘোষণায় অবিচল থাকে সে বুঝতেই পারে না অন্দরমহলের জলবায়ুর গতিপ্রকৃতি। সদর ও অন্দরে ইংরেজি ও ভার্নাকুলারের দ্বন্দ্ব যে শেষ পর্যন্ত আমাদের আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়ায় একটি প্রাথমিক স্তর, সেই সত্য এখন ধীরে ধীরে উপলব্ধি করা যাচ্ছে। প্রায় একই রকম ভাবে খেয়াল করা যায়, ‘অপরাজিত’ ছবিতে যে অপূর্ব কুমার রায় ‘গ্লোব’ হাতে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের প্রতি প্রবল শ্রদ্ধা বহন করে পটুয়াতোলার মুদ্রণালয়ে গুটেনবার্গ ছায়াপথ আবিষ্কার করেছিল, সে মাত্র ১৪ বছর বাদে কেন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিতে সিদ্ধার্থ হিসেবে ফিল্ম ডিভিশনের তথ্যচিত্রে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার গল্প শুনতে শুনতে হলের সিটে শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বোজে। সন্দেহ নেই, সত্তর দশকেও সত্যজিতের নাগরিক যুবা ভিয়েতনাম যুদ্ধকে মানুষের চন্দ্রাবতরণের তুলনায় বেশি দাম দেয়। কিন্তু অপূর্ব কুমার রায়ের মধ্যে যে বিশ্বাসী নাগরিকতা বোধ ছিল, যা উনিশ শতকে নির্মিত, যা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছিল শহরের নবনির্মাণ, জ্ঞানের বিস্তার ও কারিগরি উৎকর্ষ— এ পথেই আমাদের চেতনার ক্রমমুক্তি তা ডাক্তারির অসফল ছাত্র সিদ্ধার্থ চৌধুরীর মধ্যে অনেকটাই সন্দিগ্ধ রূপ নিয়েছে। সে নারীর স্তন থেকে সামাজিক প্রাণ পর্যন্ত সব কিছুতেই সন্দেহের ছায়াপাত টেনে আনে। সিদ্ধার্থ অসহায়। সিদ্ধার্থ অনিশ্চিত। সিদ্ধার্থ দ্বিধাগ্রস্ত।
একই রকম দোলাচলে দীর্ণ শ্যামলেন্দুকে আমরা আবিষ্কার করেছি ‘সীমাবদ্ধ’ ছবিতে অভিজাত অ্যাপার্টমেন্টে সকালবেলায়। তাঁর সার্থকতার সিঁড়ি অব্যক্ত ও নিষ্ঠুর। উন্নতির পথে ছলনার আশ্রয় নিতে তাঁর মনুষ্যত্ব থমকে দাঁড়ায় না। আর ‘জনঅরণ্য’-তে সোমনাথ মেয়েমানুষের খোঁজে নৈশ অ্যাডভেঞ্চার শুরু করলে সত্যজিৎ রায়ের আত্মগ্লানি তিক্ততার শিখরে পৌঁছে যায়। জীবনানন্দ থাকলে হয়তো বলতেন— ‘নগরীর মহৎ রাত্রিকে তাঁর মনে হয়, লিবিয়ার জঙ্গলের মতো’। জরুরি অবস্থায়, শ্বাসরোধকারী মুহূর্তে, সত্যজিৎ অন্তত একটি কর্কশ ‘না’ উচ্চারণ করে জাতিকে কৃতজ্ঞ রাখলেন।
এই ব্যক্তিসত্ত্বাকেই যদি পিছনে মুখ ফিরিয়ে ইতিহাসগত ভাবে দেখি, তবে নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ-কে পাওয়া যাবে। ‘সতরঞ্জ কে খিলাড়ি’-তে তিনি না পারেন লখনউ সামন্তদের সুরেলা অবক্ষয়কে সমর্থন করতে, না পারেন লর্ড ডালহৌসির কদর্য পররাজ্য লোলুপতাকে স্বাগত জানাতে। যিনি সততাকে বিসর্জন দেবেন না, অথচ, সততার আচার ও প্রকৃতি বিষয়ে যিনি সংশয়ে বদ্ধমূল তেমন শিল্পীর আর কোন পথ খোলা থাকতে পারে?
ইতিহাসকে দেখার জন্য শিশুর চোখ বেছে নেন সত্যজিৎ রায়। ‘পথের পাঁচালি’-তে অপু আখ্যানের পক্ষে নিরপেক্ষ এক ‘অপর’ অবস্থান। আর সে ভাবেই ‘দাবাড়ু’র অন্তিম পর্যায়ে একটি বালক বাইরে থেকে অদূরের পথে কোম্পানির ফৌজের সাড়ম্বর শোভাযাত্রা দেখে। এই পদ্ধতি ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত না থেকেও নিরীক্ষণের এক পদ্ধতি। ‘পিকু’ যেমন নির্জ্ঞান থেকে যৌনতার সঙ্কটকে দেখতে পায়, সত্যজিৎ নিজেও তেমন সীমানার বাইরে থেকে বাঙালির উনিশ শতকীয় উড়ান ও শেষ বিশ শতকের ডানা ভাঙা জটায়ুকে চিনতে পারেন। উল্লাস ও বিষণ্ণতা যুগপৎ তাঁকে পাহারা দেয়। আমার সামান্য বিবেচনায় তিনি মোটেও সামাজিক টালমাটাল বিষয়ে উদাসীন নন, বরং আমৃত্যু অতিরিক্ত সংরক্ত। আমাদের তথাকথিত ‘নবজাগরণ’ সত্যজিৎকে উপহার দিয়েছিল রৈখিক প্রগতি ভাবনার বীজ। ষাট দশকের শেষে যখন সেই কাঠামোটিতে সামাজিক আন্দোলনের চাপে ঘুণ ধরল, সত্যজিৎ ইতি ও নীতির দ্বন্দ্বে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। তবু, আমরা নজরে রেখেছি এক জন মহৎ শিল্পীর মতোই রক্ত, হিংসা, নাস্তিক্যের দুনিয়া পরিত্যাগ করে কল্পিত তপোবন ভ্রমণে যাননি। সত্যজিৎ রায়ের রাজনৈতিক দর্শনের যদি ব্যর্থতা থেকেও থাকে তা উনিশ শতকীয় মানবতাবাদের একদেশদর্শীতার পরিণাম, হেগেল-এর ভাষায় ‘আনহ্যাপি কনশাসনেস’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy