সন্দীপ রায়। নিজস্ব চিত্র।
আধখোলা সবুজ গেটটা পেরিয়ে বোগেনভিলিয়ার সারির পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাঁ দিকে তাকাতেই নিরাপত্তারক্ষী বললেন, তৃতীয় দরজাটা খুলে ঢুকে যান। আট নম্বর ফ্ল্যাট। ব্রিটিশ আমলের পেল্লায় আকাশছোঁয়া বাড়িতে কেউ ঢুকলে ধরেই নেওয়া হয় অতিথি অনিবার্য ভাবে বাড়ির আট নম্বর ফ্ল্যাটের দিকে যাচ্ছেন।
এক সময় পরিচিত মহলের লোকজন এ বাড়ির দরজা থেকেই গৃহকর্তার সুরেলা ‘শিস’ শুনতে অভ্যস্ত ছিল। সেই দরজা এখন বন্ধ। কলিং বেলটাও বাজে না। তিনি অসুস্থ হওয়ার পরেই বাড়ির ‘প্রবেশমুখটা’ বদলে ফেলা হয়। তাঁর পড়ার ঘরের দরজাটা বন্ধ করে আট নম্বর লেখা দরজা দিয়ে যাওয়া-আসা শুরু হয়।
তবু আজও এ বাড়ির সিঁড়ি, দেওয়াল, চৌকাঠ, ঘরদোর তাঁর গন্ধে ম-ম করে! তিনি যে সত্যজিৎ রায়।
রায় বাড়িতে ঢুকেই আজকে যাঁকে দেখা যায়, তিনি সন্দীপ রায়। নিয়ম ধরে কালো ফোনের সামনে। ‘সোনার কেল্লা’-র ৫০ বছর এবং ‘নয়ন রহস্য’-এর মুক্তি নিয়ে এ দিনও তিনি ব্যস্ত, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ছাড়াই বসে আছেন গনগনে আগুনে হাওয়ার মধ্যে।
প্রশ্ন: নির্বাচন আর এই গরম। তার মাঝে ‘নয়ন রহস্য’-এর মুক্তি। টেনশন হচ্ছে?
সন্দীপ: নির্বাচন বলে আলাদা করে আমার কোনও টেনশন হচ্ছে না। কিন্তু ছবি এলে প্রথম দিনের মতো আজও টেনশন হয়।
প্রশ্ন: সত্যজিৎ-পরবর্তী রায় বাড়ি একই রকম থেকে গেল! রবীন্দ্রনাথের ছবি, সুকুমার রায়, বইয়ের আলমারি... কোথাও কোনও বদল নেই…
সন্দীপ: সবটাই ধরে রাখতে চেয়েছি। কিছু বদলাতে চাইনি। সুকুমার, উপেন্দ্রকিশোর, সত্যজিৎ রায়— এত জনের লেখাপত্র সামলানো, সংরক্ষণ করা এটা এখন বিরাট কাজ। বাবার ছবি মোটামুটি নব্বই ভাগ সংরক্ষণ করা হয়ে গিয়েছে। এই মুহূর্তে যখন সংরক্ষণের কথা বলছি, ইতালিতে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ সংরক্ষণের কাজ হচ্ছে। কিন্তু রায় পরিবারের সকলের লেখাপত্র, কাগজ সংরক্ষণ খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। পরের প্রজন্মের কাছে, বিশেষ করে যাঁরা গবেষণা করছেন, তাঁদের কাছে এই লেখাগুলি খুব জরুরি। এখানেও সৌরদীপের (সন্দীপ-পুত্র) বড় ভূমিকা আছে। এত খারাপ আবহাওয়া, আমাদের কাগজ সংরক্ষণ বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে।
প্রশ্ন: মানে আপনি সারা জীবন রায় পরিবারের ঐতিহ্য নিয়ে থেকে গেলেন…
সন্দীপ: আরে, আমি সেটাই তো চেয়েছিলাম।
প্রশ্ন: সেই ঐতিহ্য নিয়ে সৌরদীপ কবে ছবির কাজে হাত দেবে?
সন্দীপ: ও এখনও কিছু বলেনি। তবে আমি তো বলব, আমার চেয়ে ওর দৌড়তে একটু দেরি হচ্ছে। আমি তিরিশ বছর বয়সে কিন্তু ‘ফটিকচাঁদ’ করে ফেলেছি।
প্রশ্ন: সৌরদীপ তো ‘নয়ন রহস্য’ ছবিতে আপনার সহকারী হিসেবে কাজ করেছে!
সন্দীপ: হ্যাঁ। ও তো দীর্ঘ দিন ছবি তুলছিল। আমিও বাবার সঙ্গে কাজ করার শুরুর দিকে যেমন করতাম। ‘নয়ন রহস্য’ করার সময় বলল, ও সহকারী হিসেবে কাজ করতে চায়। আমি রাজি হয়ে যাই। দেখলাম, খুব যত্ন করে কাজ করছে। ও নতুন প্রজন্মের মানুষ। ওর থেকেও এই সময়ের উপযোগী নানান মতামত পাই। এখন চিত্রনাট্য লিখে যেমন বুনিকে (স্ত্রী ললিতা রায়ের ডাকনাম) দেখাই, তার পরে ওকেও শোনাই। ভিএফএক্সের কাজও ভাল বোঝে ও। তবে এখনও ছবি করার কথা বলেনি। আমি যদিও এক-দু’বার তাড়া মেরেছি। বলেছি, দেরি হয়ে যাচ্ছে। তো, দেখা যাক।
প্রশ্ন: বড় পর্দায় ফেলুদার স্বত্ব তো আপনি কাউকে দেননি! সেটা কি ছেলের জন্যই রাখলেন?
সন্দীপ: আরও ফেলুদা তো হবে। এক-দু’বছরের মধ্যে। তার পরে ছেলে যদি করতে চায়, করবে। এখনও ঠিক নেই কিছু।
প্রশ্ন: আজ পর্যন্ত যে ক’জন ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তাঁদের কাকে কত নম্বর দেবেন?
সন্দীপ: ফেলুদার নম্বর হয় না। সৌমিত্রকাকু স্বয়ং লেখক-পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা। যদিও সত্যজিৎই ফেলুদা ছিলেন। সৌমিত্রকাকুর উচ্চারণ, কথা বলার ধরন ভীষণ বাঙালি। খুব মানিয়ে যেত। অন্য দিকে বেণুর সেলুলয়েডে উপস্থাপনা অসাধারণ। মেজাজি চেহারা। বেশ একটা ব্যাপার ছিল। দারুণ বন্দুক চালাতে পারত। সবাই তো তা পারে না। মাঝেমাঝে আমি তো ওকে বলতাম, স্বর একটু নরম করতে। ফেলুদার অনুরাগীরা ভয় পেয়ে যাবে। আমার মনে হয় শরীরটা ঠিক থাকলে বেণু আরও একটা ফেলুদা করতে পারত। উচ্চতাও তো ছিল।
প্রশ্ন:আবীর চট্টোপাধ্যায়?
সন্দীপ: আবীর তো ফেলুদা করল। আমরা ভাল করেই কাজ করেছি। তবে এক জন অভিনেতা একসঙ্গে ফেলুদা আর ব্যোমকেশ করবেন, এটা চাই না। আর ইন্দ্রনীল (সেনগুপ্ত) আমায় নিজে এসে বলেছিল, ও ফেলুদা করতে চায়, সেটা খুব সম্ভবত ২০১৬ সাল। প্রথম বার যখন দেখা করতে আসে, তখন কথা বলার সময় লক্ষ করেছিলাম, ও বেশি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছে। অস্বস্তি হয়েছিল। বেশ কিছু দিন পরে যখন আমরা ফেলুদা খুঁজছি, তখন ও আবার এল, তখন ওই ইংরেজির বিষয়টা ছিল না। ‘হত্যাপুরী’র পরে ওকে দর্শক পছন্দ করল। দেখুন, সবাইকে তুষ্ট করতে কেউ পারে না। বহুসংখ্যক মানুষ নতুন ফেলুদা, তোপসে, জটায়ুকে গ্রহণ করেছে। আর ইন্দ্রনীলের অভিনয় নিয়ে কোনও দিন কোনও সংশয় ছিল না আমার। ‘হত্যাপুরী’ ছবির শেষে একটা বড় বিষয় ছিল যখন শুধু ফেলুদাই কথা বলে। সেই সংলাপকে ইন্দ্রনীল যে ভাবে আয়ত্ত করেছিল, সেটা দেখে খুব ভাল লেগেছিল।
প্রশ্ন: ইন্দ্রনীল বেশি প্রেমিক, না?
সন্দীপ: সৌমিত্রবাবু কি কম প্রেমিক নাকি!
প্রশ্ন: ‘হত্যাপুরী’ দেখেই তো অভিনবকে ভাল লাগে আপনার?
সন্দীপ: মনে হয়েছিল, একে দিয়ে যদি ‘নয়ন রহস্য’ করানো যায়। দেখলাম, ও তো খুব দ্রুত বড় হয়ে যাবে! তাই ওর জন্যই ‘নয়ন রহস্য’ করলাম। ওকে অভিনয়ের বিষয়ে কিছু বলতে হয় না।
প্রশ্ন: টোটা রায়চৌধুরীর সঙ্গে আপনি কাজ করেছেন, ওঁর ফেলুদা দেখেছেন?
সন্দীপ: হ্যাঁ। সৃজিতের ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ দেখেছি। ভাল লেগেছে টোটার ফেলুদা। ও অভিনেতা হিসেবে খুবই ভাল। তবে এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত মতামত আছে।
প্রশ্ন: বলুন না…
সন্দীপ: আমার মনে হয়েছে, টোটাকে আরও যদি একটু ছেড়ে রাখা যেত, তা হলে ফেলুদার ম্যাজিকটা আরও বেরিয়ে আসত।
প্রশ্ন: ‘ত্রিনয়ন, ও ত্রিনয়ন’, ‘ভ্যানিশ’ এই সবের পরে ‘নয়ন রহস্য’ ছবিতে এ বার পুরোদস্তুর ম্যাজিক। সত্যজিৎ রায়ের এই ধরনের বিষয়গুলিতে কি ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ ছিল?
সন্দীপ: হ্যাঁ। প্যারাসাইকোলজির প্রতি আগ্রহ বাবার পরে আসে। ম্যাজিকে প্রথম থেকেই ছিল। বাবা তাসের ম্যাজিক দেখাতে পারতেন। ডায়েরিতে দেখেছি, বিদেশে গিয়ে বাবা ম্যাজিক দেখেছেন। পিসি সরকারের ম্যাজিক দেখেছি আমরা। আর এসি সরকার তো সন্দেশ পত্রিকায় লিখতেন। বাড়িতেও প্রচুর ম্যাজিকের বই আছে।
প্রশ্ন: দেবনাথ (চট্টোপাধ্যায়, ছবির ম্যাজিশিয়ান) তো শুনছি ‘নয়ন রহস্য’ করে ম্যাজিশিয়ান হয়ে গিয়েছে!
সন্দীপ: হ্যাঁ। ও এখন চাইলে ম্যাজিক দেখাতে পারে। কাজটা ভাল করেছে।
প্রশ্ন: এই ছবিতে আবার মোহন আগাসে…
সন্দীপ: উনি তিন প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করলেন। মাঝেমাঝেই ফোন করে বলেন, কী ব্যাপার, আমাকে নিচ্ছ না কেন? আমি ইচ্ছে করেই মোহন আগাসেকে দিয়ে হিন্দি বলিয়েছি। চেন্নাইয়ে শুট, তাই ওখানকার ভাষাও রেখেছি। আবার ছবিতে ইংরেজিও আছে।
প্রশ্ন: সেই কারণেই কি এই ছবির প্যান- ইন্ডিয়া রিলিজ়?
সন্দীপ: কিছুটা তো তাই। অন্য দিকে সুরিন্দর ফিল্মস, আমার প্রযোজকদেরও এই পরিকল্পনাই ছিল। ওঁরা খুব আরাম করে ছবি করতে দিয়েছেন।
প্রশ্ন: ১০ মে ‘নয়ন রহস্য’-এর সঙ্গে ‘দাবাড়ু’ আসছে, দুই ছবিতেই চেন্নাইয়ের ব্যবহার আছে…
সন্দীপ: তাই? ভালই তো।
প্রশ্ন: চেন্নাইয়ে কাজ করে কেমন লাগল?
সন্দীপ: ওঁরা কাজটা পুরোটা জানেন। যাঁদের সম্মান করতে হয়, তাঁদের জন্য মাথা নত করে থাকেন। বাবার ‘পায়ে পড়ি বাঘ মামা’ গান তো চেন্নাইয়ে শুট। বাবার সময় চেন্নাই ছিল জন্তু-জানোয়ারদের জায়গা।
প্রশ্ন: শেষ প্রশ্ন, সন্দীপ রায়কে বাংলা ছবির দর্শক, বিশেষ করে ছোট পর্দার দর্শক বহু টেলিফিল্ম করতে দেখেছেন। অন্য ধারার গল্প নিয়ে। বড় পর্দায় আপনি ফেলুদার বাইরে হাঁটা বন্ধ করে দিলেন। যদি বলি, প্রেমের ছবি, সম্পর্কের ছবি! করবেন না?
সন্দীপ: কেন নয়? অবশ্যই করব। গল্প চাই। আমি সাহিত্যনির্ভর ছবি করতেই পছন্দ করি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy