প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে...
২২শ্রাবণ। তবে সালটা ২০২২। আজও কি রবীন্দ্রনাথ বাঙালির মননে একই ভাবে বাজলেন? আজও কি যুদ্ধের বাজারে তিনি ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা’? না কি ছোট্ট একফালি পরিসরে আটকে ছটফট করছেন বাঙালির রবি ঠাকুর? সীমাবদ্ধতার অচলায়তনে বন্দি। তাঁকে উচ্চারণ করাটাই যেন স্পর্ধার। ঘিরে ফেলবে বিকৃতির ভয়। শত শত তর্জনী উঠবে, যদি তাঁকে নিয়ে নিজের মতো করে তর্পণ করেন কেউ। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে দুই বাংলার রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী, গবেষক সাহানা বাজপেয়ী কিন্তু ঝাড়া হাত-পা। আনন্দবাজার অনলাইনকে জানালেন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ভয়ের নয়, তাঁর সখ্যের রসায়ন।
ছোট থেকে শান্তিনিকেতনে পড়েছেন বলে সাহানার দৈনন্দিন যাপনে জড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। বললেন, “তাঁর গান গাই বেশির ভাগ সময়, তাঁর লেখা পড়ি। তাঁর গান নিয়ে গবেষণা করি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে আমাদের উপর চাপিয়ে দেননি কেউ। সেই রবীন্দ্রনাথেরই ইস্কুলে, তাঁর বাতাবরণে আমরা বড় হয়েছি। তাই তাঁর সঙ্গে ভয়-ভীতির সম্পর্ক নেই আমার, যে তাঁর গান গাইতে গেলে ভয় পেতে হবে। তাঁর লেখা পড়তে গেলে ভয় পেতে হবে, আবৃত্তি করতে গেলে ভয় পেতে হবে— এই ব্যাপারটা নেই আমার মধ্যে। সমীহের জায়গাটা নিশ্চয়ই আছে, তবে তার থেকেও বেশি রয়েছে সখ্য।”
সমীহের ভিড়ে কী ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় এমন সখ্য? সাহানার জবাব, “আমার মনে হয়, বাঙালির শীর্ষ পরিচিতি হিসাবে রবীন্দ্রনাথকে ধরা হয়, এবং ঐতিহাসিক ভাবেই পরম্পরাটা চলে এসেছে। তাঁর সম্পর্কে কথা বলতে গেলে যে শিক্ষিত হতে হবে, তাঁর গানে কেবলমাত্র রুচিশীলদের এক্তিয়ার— এই যে একটা ধারণা বাঙালির মধ্যে রয়েছে, এটাও আবহমান।”
সকাল সকাল রবীন্দ্রস্মরণে একটি নির্মেদ পোস্ট করেছিলেন গায়িকা। তাতে ছিল, ‘‘মার্জিত, শিক্ষিত, রুচিশীল। বাঙালির তিন প্রিয় শব্দ- বিশেষত রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনের ক্ষেত্রে। যেন এই তিনটি শব্দের মধ্যেই তার সাঙ্গীতিক গুণাবলী রয়েছে। অবশ্যই এই ন্যারেটিভ ঐতিহাসিক ভাবে বাঙালি মননে প্রোথিত রয়েছে। কারণ কী, জানতে আগ্রহী।’’ তার উত্তরে নিজের মতো করে মতামত জানিয়েছিলেন অনেকেই। তাতে উঠে আসা শ্রদ্ধা-ভক্তি-অবিকৃতির বিতর্ক আবহমান।
সাহানার দাবি, এটাকে নানা ক্ষেত্রে ভাঙার চেষ্টাও হয়েছে। “আমরা যদি বাম সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কথা তুলি, সেখানেও দেখা গিয়েছে, রবীন্দ্রনাথের গান সুচিত্রা মিত্র ট্রাকের উপর দাঁড়িয়ে গাইছেন, “সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে।” সেই সময়ের অনেক শিল্পী সকলের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তো বলেছেন, “শোকে দুঃখে আনন্দে বাঙালিরা আমার গান গাইবেই।” এ বার ‘বাঙালিরা’ বলতে একটা মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির মধ্যে বিষয়টা কুক্ষিগত হয়ে গিয়েছে। নতুন প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথ অধরা। সার্বিক ভাবে বাঙালির কাছে রবীন্দ্রনাথের গান এখনও পৌঁছনো বাকি আছে বলেই আমার মনে হয়।”
আর রবীন্দ্রবিকৃতি? সে এক অদ্ভুত প্রসঙ্গ বলেই মনে করেন সাহানা। বললেন, “রবীন্দ্রনাথ নিজেই তো গতানুগতিক গানের ধারায় বদল এনেছিলেন। নিজেই লিখে গিয়েছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীত বদলাবে। আমরা তো সেই বদলেরই শামিল হয়েছি। আমরা যারা গান পরিবেশন করি, ভালবাসা থেকেই করি। যাঁরা রবীন্দ্রনাথের গানের ভিতরে কিছু সংযোজন করেন, তাঁরাও ভালবেসেই করেন। সেটাকে অশ্রদ্ধা করে নষ্ট করে দেবেন বলে করেন না। আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা— এক জন রূপকারের তো এটুকু স্বাধীনতা থাকা উচিত বলে মনে হয়। কিন্তু সবটাই যাঁরা শুনছেন, তাঁদের উপর নির্ভর করে। সকলেরই মতপ্রকাশের অধিকার আছে। তবে যাঁরা গাইছেন তাঁদের রবীন্দ্রনাথের প্রতি দায়বদ্ধতার দিক যেমন রয়েছে, নিজের মতো করে ভাবারও অধিকার রয়েছে।”
এত কিছুর ভিড়ে কোথাও গিয়ে হারিয়ে গিয়েছেন আপনার ব্যক্তিগত রবীন্দ্রনাথ? সাহানার সহাস্য জবাব, “আমার ব্যক্তিগত রবীন্দ্রনাথ কোথাও হারাননি। যত বয়স বাড়ছে আমার হৃদয়ে তাঁর বসত আরও পাকাপোক্ত হচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy