১৯৫৯ সাল। কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রো ক্ষমতায় ফিরেছেন। তিব্বত থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন দলাই লামা। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘আনাড়ি’ রমরম করে চলছে। কিংবদন্তি কপিল দেব ভূমিষ্ঠ হয়েছেন হরিয়ানার এক গ্রামে। সেই বছর সেপ্টেম্বরে দূরদর্শনের যাত্রা শুরু এবং সেই বছরেই গা ছমছম করা খবরটা ভেসে উঠলো ছোট পর্দায়! শুধু ছোট পর্দা নয়, দেশের সব ক’টা কাগজের প্রথম পাতা অধিকার করল সেই খবর!
নেভি অফিসার কাওয়াস মানেকশাহ নানাবতী স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে মুম্বই-এর (তখন বোম্বে) মেট্রো সিনেমা হলে বসিয়ে, নিজের সার্ভিস পিস্তল নিয়ে চলে যান বিখ্যাত শিল্পপতি প্রেম আহুজার বাড়ি, এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘তুমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে মেলামেশা করো, তুমি কি ওকে বিয়ে করবে?’’
হেসে ওঠেন দুঁদে প্রেম আহুজা! ‘‘এই ভাবে বিয়ে করতে গেলে তো আমায় ১০০টা বিয়ে করতে হয়।’’
‘‘আমার স্ত্রী নিজের দেহ মন দিয়ে তোমায় ভালোবাসে,’’ শান্ত নানাবতীর কণ্ঠস্বর।
‘‘দ্যাট ইজ হার প্রবলেম, নট মাইন,’’ নির্বিকার প্রেম আহুজা।
একদৃষ্টে তাকিয়ে নানাবতী। উঠে এল নিজের সার্ভিস পিস্তল। পর পর তিনটে বুলেট। আহুজার দেহ শবে পরিণত হল। এই ঘটনা প্রত্যেক ভারতবাসীকে স্তম্ভিত করেছিল।
এই সত্য ঘটনা অবলম্বনেই সদ্য মুক্তি পাওয়া সফল ছবি ‘রুস্তম’! আমার ভেতরকার সাধারণ দর্শক খুব খুশি, ভীষণ উত্তেজিত। যাই হোক, জানা ঘটনা গল্প আকারে বড় পর্দায় দেখার আনন্দই আলাদা।
অসাধারণ আরম্ভ। কোনও কথা হবে না। নেভি অফিসার ‘রুস্তম পাভরি’-র চরিত্রে অক্ষয়কুমার যখন তাঁর পেটানো চেহারা নিয়ে পর্দায় পদার্পণ করলেন তখন আর কোনও দ্বিধা রইল না। একটু আগেভাগে সমুদ্র থেকে ছুটি পেয়ে স্ত্রীর জন্যে ফুল হাতে বাড়ি ফিরে, পুরনো পরিচারিকার (ঊষা নাদকার্নি) মাধ্যমে জানতে পারেন স্ত্রী সিনথিয়া (ইলিয়ানা ডি ক্রুজ) গত দু’রাত বাড়ি ফেরেননি। প্রথমে ফুল, মাঝে একটা কার্ড, আলমারিতে প্রেমিক বিক্রম মাখিজার (অর্জুন বাজওয়া) রসালো চিঠি।
সারা রাত মদ খেয়ে, ভোরে নিজের পিস্তল নিয়ে অর্জুনকে তিনটে গুলি করলেন। অর্জুন খতম। আত্মসমর্পন করলেন অফিসার অক্ষয়কুমার।
কোর্টে জাজের সামনে দাঁড়িয়ে ঠিক করলেন যে, পুলিস কাস্টডিতে থেকে নিজের কেস নিজেই লড়বেন। প্রথমে খুনের কথা স্বীকার করেও অক্ষয় যখন জানতে পারেন, যে জরুরি ডকুমেন্ট তাঁর কাছে আছে সেটা বাগাবার জন্যে কিছু অসৎ অফিসার তার বাড়িতে হানা দিয়ে তছনছ করেছেন এবং তাঁর স্ত্রীর সামনে এখন ঘোর বিপদ। আরও জানতে পারেন এর পিছনে বিক্রম মাখিজার হাত ছিল কারণ তিনি এই কাজের জন্যে ৫ কোটি টাকা পেতেন!
অক্ষয় ওকালতির বই ঘেঁটে ইনভেস্টিগেটিং পুলিশ অফিসারের (পবন মালহোত্র) সামনে ভবিষ্যৎবাণী করলেন যে তিনি সসম্মানে ছাড়া পাবেন! তাই হল! শুধু ছাড়া নয়, জেলে বসে মাখিজার অসৎ উপায়ের ৫ কোটি টাকাও নিজের অ্যাকাউন্টে জমা করিয়ে নিলেন! সাহায্য করলেন তাঁর, একদা মাখিজা-আসক্তা স্ত্রী!
ধরে বসিয়ে রাখার মতো গল্প এবং চিত্রনাট্য! কোথাও ফাঁক নেই। তবু... তবু... কেন আমার মত সাধারণ দর্শকের মনে কিন্তু কিন্তু! কেন?
সত্যি যা ঘটেছে তাকে গুটিয়ে দু’ঘণ্টার চিত্রনাট্যের মধ্যে আবদ্ধ করলে সেটা গল্পে পরিণত হয় সত্যি। তবে ঘটনা এবং চরিত্রের ব্যাকরণ গুলিয়ে গেলে বিশ্বাসযোগ্যতা ফিকে হয়ে আসে, সেই সঙ্গে লোপাট হয় সত্য ঘটনার ব্যক্তিত্ব ও গভীরতা।
মনে খটকা লেগেছিল যখন অক্ষয় রুপোলি পর্দায় প্রথম দেখা দিলেন! স্লো মোশনে ওঁর পরিচিতি, সাধারণ দর্শকের কপালে ভাঁজ পড়েছিল! আশঙ্কার মেঘ গুড়গুড় করে, ‘‘তা হলে কি নায়কের সামনে গল্প গৌণ?’’ কিন্তু সে মেঘ নিমেষে উড়ে যায় অক্ষয়ের চেহারা, পরিধান ও পরিবেশ দেখে। কিন্তু শ্রাবণ মাসের মেঘ! সহজে ছাড়ে? আবার গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে!
যিনি স্ত্রীকে প্রাণ-মন দিয়ে ভালবাসেন, তিনি এত ভাবলেশহীন! দু’রাত স্ত্রী ঘরে ফেরেননি, তবু একবারও ভেঙে পড়ছেন না! স্ত্রীকে আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করার আগেই খুন করলেন বিক্রমকে! কোর্টে জাজ, আইনজীবী, পুলিশ ও সতীর্থদের উপস্থিতিতে নিজেই ঠিক করলেন যে তাঁকে কোথায় রাখা হবে এবং ফরমান শোনানোর মতো করে জানিয়ে দিলেন যে নিজের জন্যে কোনও আইনজীবীর দরকার নেই, নিজেই লড়বেন!
অ্যারেস্ট হবার পরও ধবধবে ঊর্দি পরে, সেলে দিনের পর দিন দাবা খেলে আর ওকালতির বই পড়ে, বেশ কাটালেন! জেলে বসে ছক কষে সব দুষ্টু মানুষকে প্যাঁচে ফেলে ওদের অসৎ উপায়ে আত্মসাৎ করা ৫ কোটি টাকা নিজের স্ত্রীর সাহায্যে নিজের নামে করে নিলেন! সরকারকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলেন না! সাধারণ দর্শকের মনে মেঘ জমা হয়!
ইলিনার (স্ত্রী) মুখে সব সময় এক ধরনের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ ভাব খেলছে! দিনের পর দিন মাখিজার সঙ্গে ঘুরছেন, স্বেচ্ছায় রাতের পর রাত মাখিজার বিছানার সঙ্গিনী, অথচ চালচলনে কোনও বদল নেই। অতি সজ্জন স্বামীর সহধর্মিণী, তিনি কিনা কোনও কারণ ছাড়াই নিজেকে ছেড়ে দিলেন মাখিজার হাতে? ভেঙে পড়া, দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া নারী! কোথায়? ব্যাকরণে কি গণ্ডগোল দেখা দিল?
একটা খুন। কতটা দুঃখ, যন্ত্রণা, অপমান ও হতাশা হৃদয়ে বাসা বাঁধলে একজন সৎ, কর্তব্যপরায়ণ সৈনিক ঠান্ডা মাথায় মাখিজার মতো একজনকে খতম করতে পারে? যে ঝড় তাঁর ভেতরে বইছে তার ছিটে ফোঁটাও যদি পেত আমার মত সাধারণ দর্শক! কিন্তু আমজনতা তো বেশ উপভোগ করছে! তা হলে কি আমার ব্যাকরণেই...!
কোর্ট একটা অন্য স্থান, সেখানকার পরিবেশ চিৎকার করে বলে দেয় যে এখানে তামাশা চলবে না। কাঠগড়ায় প্রথম দাঁড়ান খুনের আসামী, তাঁর দূরের ও কাছের মানুষেরা এক ধরনের সম্ভ্রম, ভয় নিয়ে ঘোরা ফেরা করে।
সেখানে জাজ (অনঙ্গ দেশাই) থেকে আরম্ভ করে থানার সেপাই, সবাই যেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন যে তাঁরা কখন দর্শকদের হাসির খোরাক জোগাবেন! এমনকী যিনি বাড়ির পুরনো পরিচারিকা, তিনিও নিজের মনিবের দুর্দশা ভুলে, তাঁর স্ত্রীর গায়ে লাগা লাঞ্ছনা উপেক্ষা করে সরকারি আইনজীবীকে (সচিন খেরেকার) বলছেন, মনিবের রাখা মদ তিনি কি ভাবে চুরি করে খান!
আমজনতা খুব আনন্দ পাচ্ছে, হাসছে, হাততালি দিচ্ছে! আমোদ-প্রমোদ কার না ভাল লাগে? তা বলে এই ভাবে! কিন্তু আমজনতা ভুল করবে কেন? তাহলে কি ডু আর ডাজ-এর তফাৎ ঘুচে গিয়ে মিলেমিশে একাকার হল? এটা কি বিশ্বায়নের ব্যাকরণ?
সবার অভিনয় দেখে মনে হল, যা করতে বলা হয়েছে তা নিপুণ ভাবে করছেন। গানের কথা বলতে পারব না কারণ একটা সুরও মনে নেই। বাকি সব আমি খুব একটা বুঝি না, সাধারণ মানুষ আমরা।
দেখলাম, ছবির শেষে হই হই করে বেরিয়ে আসছে তৃপ্ত আম জনতা! আর দলে দলে লোক হলে ঢুকছে আমোদের আশায়! আমি আমার সাধারণ দর্শকের খোঁজে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, এমন সময় দেখি সে দূরে এক কোনায় একদল লোকের সঙ্গে দিব্যি আড্ডায় মজে আছে! আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, শুনলাম ও যেন কাকে বলছে, ‘‘যাহ! এত দিন পর একটা মনের মতো জম্পেশ ছবি দেখা গেল!’’
এই রে! আর নিজের সাধারণ মানুষটা আমার রইল না! সেও আমায় ছেড়ে আম জনতার সঙ্গে...!
যেন চোরের দায়ে ধরা পড়েছি...
তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে হলের বাইরে এসে দেখি আমি একা। চারিদিক অন্ধকার। আকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘ... যে কোনও মুহূর্তে...।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy