আর ডি বর্মণকে নিয়ে কলম ধরলেন রূপঙ্কর।
আমি রাহুল দেব বর্মনের অন্ধ অনুরাগী? সবাই তেমনই বলেন। কতটা সঠিক? নিজেই জানি না!
তবে আমি তাঁর অনুরাগী। এ কথা অস্বীকারের কোনও উপায় নেই। কেন এত ভাল লাগে ওঁর সুর, ওঁর গান? তাঁর প্রথম কারণ, আর ডি সব সময় তাঁর সময়ের থেকে এগিয়ে থাকতেন। ভারতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে তাঁর প্রজ্ঞা ছিল লাতিন-আমেরিকার সঙ্গীতের উপরেও। সেই প্রজ্ঞা প্রকাশ পেত তাঁর তালবাদ্যে। একটা উদাহরণ দিই। ‘শোলে’ ছবিতে ‘বাসন্তী’ হেমা মালিনীকে ‘গব্বর সিং’ ওরফে আমজাদ খানের লোকেরা ধাওয়া করছে। সেই দৃশ্যে নাটকীয়তা ফোটাতে আর ডি তবলা ব্যবহার করেছিলেন। এ এক অনবদ্য সৃষ্টি। ওঁর আগে ওই ধরনের দৃশ্যে কেউ তবলা ব্যবহারের কথা ভাবতেই পারেননি!
পরেও ওঁর এই তাল জ্ঞানের পরিচয় ওঁর আরও অনেক গানে আর আবহে পেয়েছি। যা ওঁকে বাকি সুরকারদের থেকে আলাদা করে দিত। তবলা, ড্রাম, কঙ্গ, পারকাশনে উনি যেন ঝড় তুলতে পারতেন। একই ভাবে লোকসঙ্গীত ওঁর শিরায় শিরায় বয়ে যেত। এই ধারার প্রতি অনুরাগ নিশ্চয় ওঁর বাবা শচীন দেববর্মনের কল্যাণে। নিজে বহু ধরনের বাজনা বাজাতে পারতেন। সারা ক্ষণ নানা ধরনের গান শুনতেন। আর তার ভাল জিনিসগুলো নিয়ে নিজের ছাঁচে ঢালতেন।
রাহুল দেববর্মনের বাদ্যযন্ত্রীরাও যেন নবরত্ন সভার এক একটি রত্ন! শিবকুমার শর্মা, হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, ভবানী শঙ্কর, বাসু চক্রবর্তী, মারুতি রাউত এবং আরও বহু জন ওঁকে সঙ্গত করতেন। সবার পরিশ্রমে একটি গান যখন সৃষ্টি হত সেটা তো অবশ্যই কান পেতে শোনার মতো। এঁরা এখনও রাহুল দেববর্মনের নাম নিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে অনুষ্ঠান করে থাকেন। এটা অন্য সুরকারের ক্ষেত্রে কখনও ঘটেনি। এই ব্যতিক্রমী ঘটনার নেপথ্য কারণ সুরকার-শিল্পী স্বয়ং। এটাই ছিলেন সুরকার রাহুল।
এ বার আসি কণ্ঠশিল্পী রাহুলের কথায়। শুধুই বাজনা বা সুরে নয়, স্বকীয়তা ওঁর গলার স্বরেও। খুব ভাল গাইতে জানতেন। ফলে, কোন গান কাকে দিয়ে গাওয়ালে কী ফলাফল হবে, আগাম বুঝতে পারতেন। আবার এটাও অস্বীকারের জায়গা নেই, এত ভাল বোঝার পরেও শিল্পী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তাঁকেও আপোস করতে হয়েছে। সেখানে ওঁর করার কিছুই থাকত না। কারণ, মুম্বই এমনই একটি জায়গা যেখানে প্রতি পদে সমঝোতা করতেই হয়। যে গান তিনি মহম্মদ রফিকে দিয়ে গাইয়েছেন সে গান তাঁরই উপযুক্ত ছিল। কিশোর কুমারের জন্য তিনি আলাদা গান তৈরি করতেন। লতা মঙ্গেশকরের জন্য আবার আলাদা। অন্য দিকে আশা ভোঁসলে মানেই তো ভিন্ন ধারার গান। গানে মডিউলেশনের প্রচুর জায়গা।
ওপি নায়ারের পরে রাহুলের হাতে পরে আশাজি কিন্তু আশা ভোঁসলে হয়েছেন। তাঁকে দিয়ে নানা রকমের গান গাইয়েছেন বলেই গানের দুনিয়ায় আশাজি ‘ভার্সেটাইল’ তকমা পেয়েছিলেন। যদিও এই নিয়ে তর্ক আছে। অনেকে বলেন, আর ডি নাকি তথাকথিত রোম্যান্টিক বা পেলব গান তুলে রাখতেন লতা মঙ্গেশকরের জন্য। আর দ্রুত লয়ের বা মশালা গান গাওয়াতেন আশাজিকে দিয়ে। আশাজি নিজেও এই নিয়ে কয়েক বার হাসতে হাসতে অনুযোগ জানিয়েছেন। যদি এই বিতর্কের সমাধান রয়েছেন এই তিন জনের কাছে। তবে আমার মনে হয়, হয়তো এর পিছনে নানা রাজনীতি কাজ করেছে। লতা-আশা তখন সুরের আকাশের দুই তারা। যেমন বন্ধুত্ব তেমনই প্রতিযোগিতা। সে সবই হয়তো এই অভিযোগের অনুঘটক ছিল! সব সময়েই কি রাহুল দেব বর্মন যা চেয়েছেন তাইই করতে পেরেছেন? তখনও কেউই করতে পারতেন না। এখনও পারেন না। তবু তর্কের খাতিরেই বলব, ‘কাটি পতঙ্গ’ ছবির ‘না কোই উমঙ্গ হ্যায়’ গানটি লতা ছাড়া ও ভাবে আর কেউ গাইতেই পারতেন না। আবার লতার গাওয়া ‘ক্যারাভান’ ছবির গান ‘দিলবর দিল সে প্যায়ারে’ শুনে মনে হয়েছে এটা আশাজির গান। লতাজিকে দিয়ে জোর করে গাওয়ানো হয়েছে। প্রযোজক, নায়িকা সবার চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে এই ওলোট পালট হয়।
অনেকেই জানেন না, কিশোর কুমার অনেক দিন রাহুল দেববর্মনের গান করেননি। তাঁদের মধ্যে সাময়িক মনোমালিন্যের কারণে। ফলে, বাধ্য হয়ে অমিতাভ বচ্চনের কিছু ছবির গানে কণ্ঠ দিতে হয়েছিল আর ডি-কে। যেমন, ‘পুকার’ ছবির বিখ্যাত গান ‘সমুন্দর মে নহাকে’। এক জনের গলা উঁচু তারে বাঁধা। আরেক জনের ব্যারি টোন! দু’জনের গলা মেলে কখনও? সুরকার ওই সময় মেলাতে বাধ্য হয়েছিলেন। এবং অদ্ভুত ব্যাপার ছবির প্রত্যেকটি গান সুপার হিট!
এত প্রশংসার পরে একটু সমালোচনা করতেও মন চাইছে। আমার আর ডি-র বাংলা গান নিয়ে ক্ষোভ আছে। সুরকার হিসেবে মনপ্রাণ ঢেলে সুর করেছেন ঠিকই কিন্তু গানের কথার দিকে একে বারেই মনোযোগ দেননি। ‘স্বপ্ন আমার হারিয়ে গেছে’ এই গানটার কথাই বলব। সুরের মধ্যে এত মাদকতা। গানের কথা গুলো যেন অযত্নে বসানো। আমি বাঙালি বলেই হয়তো কানে এত বেজেছে! বাংলা ভাষা কী ভীষণ মিষ্টি! তার ব্যবহার ঠিক মতো না হলে খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক। উনিও তো বাঙালি, তাই এমন মনে হয়েছে।
হিন্দিতে ওঁর সুরে গুলজারের লেখা গানগুলো আমার সবচেয়ে প্রিয়। এই যুগলবন্দি আর হবে না। কারণ, গুলজারের লেখার প্রতি পংক্তিতে কবিতা ঝরে।
যাঁকে নিয়ে এত কথা তাঁর কতটা প্রভাব আমার গানে? আমি বলব, বেশ কয়েকটি গান মন দিয়ে শুনলে শ্রোতারা নিজেরাই বুঝতে পারবেন। যেমন, আমার প্রথম অ্যালবাম ‘বন্ধু দেখা হবে’র একটি গান ‘মানে না মন আমার’-এ আর ডি-র প্রভাব যথেষ্ট। ‘ওই পাখি ফিরে যায়’, ‘ছোট্ট এ হাতে’-র মতো গানগুলোও এই তালিকায় পড়বে। রাহুল দেববর্মনের শেষ কাজ ‘১৯৪২: আ লাভ স্টোরি’। গান-মুক্তির পরে সবাই ভাসলেন সেই সুরে। আজও যে কোনও রিয়্যালিটি শো-এ প্রতিযোগীরা গাইবেনই ‘কুছ না কহো’ বা ‘এক লড়কি কো দেখা তো’। আমি কিন্তু ভিন্ন মত পোষণ করি। আর ডি- চলে যাওয়ার পরে এই গান প্রকাশিত হওয়াই তার জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। মৃত্যুর পরে সবাই মহান! আর ডি বরাবরই এই ধরনের কাজ করেছেন। খুব নতুন কিছু নয়। তবে এই গানগুলোর ক্ষেত্রে কাজ করেছে কুমার শানুর জাদু! কিশোর কুমারের অবিকল ভঙ্গি, ওঁর দরদ যেন গানের প্রতিটি পংক্তিতে শানু কণ্ঠ দিয়ে বুনে দিয়েছিলেন।
এত যাঁকে নিয়ে হইচই, চলে যাওয়ার আগের বেশ কিছু বছর তাঁর হাতেও কিন্তু কোনও কাজ ছিল না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy