কুমার শানু এবং রূপম ইসলাম।
টেলিভিশনের জনপ্রিয় গানের রিয়্যালিটি শো-র বিচারক হিসেবে আমার প্রিয় শিল্পী কুমার শানুকে হাত তুলে ‘জয় রক’ বলতে শুনে বেশ খানিকটা হকচকিয়েই গেলাম। বাংলা রক-এর এই জয়ধ্বনির সৃষ্টিকর্তা হিসেবে বেশ খানিকটা আনন্দও হল। আনন্দ কেন হল, বলি।
প্রথমত, আপনাদের অনেকেই কুমার শানুকে হিন্দি ছবির প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে চেনেন। আমার ক্ষেত্রে এই পরিচয় আরও কিছুটা পুরনো। দূরদর্শনে শনিবার কি রোববার (অথবা শুক্রবার কি? মনে পড়ছে না) বেশ রাত করে, একটি ননফিল্মি গানের জলসা বসত। নাম ছিল— ‘পপটাইম’। এই অনুষ্ঠানে রেমো ফার্নান্ডেজ, শ্যারন প্রভাকর, তালাত আজিজ, ভারতের প্রথম রক ব্যান্ড ‘ইন্ডাস ক্রিড’, উষা উত্থুপ প্রমুখ নিয়মিত অনুষ্ঠান করতেন। বিড্ডু আর জোহেবকেও দেখেছি। আরও অনেকেই করতেন— সকলের নাম মনে পড়ছে না। এখানেই আমার প্রথম চেনা আধুনিক হিন্দি গানের শিল্পী কুমার শানুকে। বাড়িতেও তাঁকে নিয়ে আলোচনা হত। যেহেতু রফিকণ্ঠী মুন্না আজিজ, কিশোরকণ্ঠী আনন্দ প্রমুখ শিল্পীরা, যাঁরা মহম্মদ রফি এবং কিশোর কুমারের শূন্যস্থান পূরণের একটা প্রাণান্তকর চেষ্টা করছিলেন, তাঁদের সঙ্গে বাবা বিশেষ ভাবে পরিচিত ছিলেন। মহম্মদ আজিজ মুন্না ছিলেন আমার বাবারই ছাত্র। কাজেই কুমার শানুর জাতীয় স্তরের টেলিভিশনে উঠে আসাটাকে আমার বাড়িতে বেশ প্রশংসার চোখে দেখা হত। সেটা আশির দশকের মধ্যভাগ। তখনও ইন্ডিপপ আসেনি। কুমার শানুর প্লেব্যাকের জয়রথ চলতে শুরু করা তখনও অনেক দূরের স্বপ্ন।
তারপর তিনি এলেন। ‘আশিকি’, ‘ফুল অউর কাঁটে’, ‘দিল হ্যায় কে মানতা নহি’, ‘সড়ক’— একের পর এক ছবিতে কালজয়ী গান। সারা ভারত সে সব গান গেয়েছিল তাঁর সঙ্গে। তাঁর সেই শ্রোতাদের মধ্যেও আমিও ছিলাম। ধীরে ধীরে তাঁর নিজস্বতা তিনি তৈরি করলেন— গলা কাঁপিয়ে ঈষৎ আনুনাসিক কণ্ঠস্বরে আবেগি ঢঙে গাওয়া। ‘আশিকি’তে বা তারও আগের ‘ম্যায় জাদুগর’, ‘মেরা নাম গোগা’-তে তাঁর গাওয়ার ভঙ্গী অনেক বেশি সোজাসাপ্টা এবং শক্তিশালী। সেখান থেকে খানিক সরে এসেই তিনি পরের দিকে ধরলেন কিশোর কুমারের দুঃখের গানের আবেগ-অনুভূতিকে। দেখা গেল, সত্যিই ওই জায়গাটা ধরার মতো আর কেউ ছিলেন না। তা নিয়ে অবশ্য ব্যঙ্গ বা আজকের ভাষায় ট্রোল কম হয়নি সে সময়ে। কিন্তু তাঁর রাজত্বে বিন্দুমাত্র বিঘ্ন ঘটাতে পারেনি ট্রোলাররা। রাজত্বই করেছেন কুমার শানু। তাঁর কোটি কোটি শ্রোতার হৃদয়ে আজও তাঁর সিংহাসন পাতা।
এ হেন কিংবদন্তী শিল্পী মন্তব্য করেছেন— তিনি বাংলা রক সংগীত এর আগে শোনেননি। এখন ওই অনুষ্ঠানের এক প্রতিযোগীর কল্যাণে তিনি শুনছেন, তাঁর ভাল লাগছে। ক্লিপিংটার নেপথ্যে বাজছে আমারই গান ‘সেদিনও ছিল’র একটি নতুন সংস্করণ। এবং শেষমেষ তিনি আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলছেন, ‘জয় রক!’। এটা যেহেতু একটি প্রত্যুত্তরমূলক জয়ধ্বনি, প্রতিযোগী শিল্পীকেও বলতে হচ্ছে ‘জয় রক’। গ্যালারিতে দেখা যাচ্ছে অন্যান্যরাও অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করছেন ‘জয় রক’!
এখন এই যে শব্দদ্বয় ‘জয় রক’— কুমার শানু বাংলা রকসংগীত না শুনেও কিন্তু এই স্লোগান সম্পর্কে অবহিত! অর্থাৎ এটা আমার তৈরি করা গানগুলোকেও ছাপিয়ে অনেক দূর চলে গেছে। রক মিউজিকে আর একটা প্রকাশভঙ্গী চালু আছে, সেটা হল— ‘রক অন’। সেটাকে ব্যবহার করে ছবির নামকরণও হয়েছে। আমি ‘জয় রক’ কথাটি প্রচলন করার পরে ‘রক অন’ বাংলা রকারদের জবানিতে খুব একটা পাত্তা পায়নি। বাংলা রক-এর একটা স্বতন্ত্র উচ্চারণের হয়তো প্রয়োজন ছিল। এখনও আমি যেখানেই যাই, দূর থেকে মানুষ আমার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলেন— রূপমদা, ‘জয় রক’! আমিও উত্তর দিই। যোগাযোগের কতটা সুবিধে হয়ে গেছে। এক কথাতেই ভাবের আদানপ্রদান ঘটে যায়।
আজ প্রিয় শিল্পীর মুখে এই দু’টি শব্দের একত্র উচ্চারণ শুনে ভাবলাম, ব্যাপারটাকে আর একটু গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার। আপনাদের তা হলে বলা যাক এর গোড়ার গল্প। কী করে তৈরি হয়েছিল এই স্লোগান। বহু-বহু দিন আগে আমি যখন অটোগ্রাফ দেওয়া শুরু করি, স্বাভাবিক কায়দায় ‘ভালবাসা, রূপম’ লিখতাম। একবার এক অটোগ্রাফ-শিকারী বললেন— ‘দাদা, অন্য কিছু লিখে দিন!’ আমি একটু ভেবে লিখলাম— ‘জয় রক, জয় ফসিলস!’ নিজেরই পছন্দ হয়ে গেল। বেশ কয়েক জনকে আমি এটা লিখেই অটোগ্রাফ দিয়ে ফেললাম। তারপর শুরু হল এরই আদ্যাক্ষরগুলি নিয়ে ‘J.R.J.F’ লিখে অটোগ্রাফের খাতায় সই করা। সে সব পুরনো সই অনেকের সংগ্রহেই আছে নিশ্চয়ই। সম্বোধন বা জয়ধ্বনি হিসেবে এর মৌখিক ব্যবহার ফসিলস-এর অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে, সম্পূর্ণ তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে। তার পর থেকে তো নিয়মই হয়ে গেল—‘জয় রক’ বা রকমন্ত্র উচ্চারণ না করলে আমাদের অনুষ্ঠান শেষই হবে না! এল রকমন্ত্রের উচ্চারণ এবং তার ব্যাখ্যার পালা।
রক মানে পাথর। আবার রক মানে ঝাঁকুনি। সর্বংসহা পাথরের মতো নিশ্চল অস্তিত্বকে তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে প্রতিশোধস্পৃহী করে তোলাটা লক্ষ্য। তবে এই প্রতিশোধ আঘাত নয়, এ হল মুখ বুজে মেনে না নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের প্রতিশোধ। রক মানে তো সংগীতও। আর এই তিন রকম রক-এর সংযোগ যে ঘটাল, সে তো বাংলা রক-এরই মঞ্চ। কই, আর কেউ তো পারেনি এই তিন রকম রক-কে মেলাতে গোটা বিশ্বে। এখানেই বাংলা রক-এর জিতে যাওয়া। আর এই জিতে যাওয়ারই উদযাপন হল— ‘জয় রক’! এ জন্যই বারবার আমি বলেছি— ‘জয় রক’! যত দিন প্রাণ থাকবে আমি ঘোষণা করে যাব রকমন্ত্র— ‘জয় রক’!
ধন্যবাদ কুমার শানু। আপনি এই মন্ত্র উচ্চারণ করে বাংলা রক-এর সংগ্রামী স্বপ্নকে মান্যতা দিলেন। আপনাকে ভালবাসা এবং অভিনন্দন জানাচ্ছি। জয় রক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy