ইরফান। ছবি এপি।
আই হোপ টু বি ব্যাক উইথ মোর স্টোরিজ় টু টেল... টুইটারে একের পর এক দীর্ঘ পোস্টে যখন সময় ফুরিয়ে আসার কথা জানাচ্ছিলেন নিজেই, সেখানেও স্পষ্ট হয়ে ধরা দিত তাঁর অদম্য জীবনীশক্তি। দাঁতে দাঁত চাপা সেই লড়াই থেমে গেল বুধবার সকালে। অনেক না-বলা গল্প বাকি রেখে চলে গেলেন ইরফান খান। স্ত্রী সুতপা শিকদার, দুই ছেলে বাবিল আর অয়ন এবং দেশজোড়া অগণিত ভক্তদের ফাঁকি দিয়ে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে চলে গেলেন অভিনেতা। বলিউডে তৈরি হল এক অপূরণীয় শূন্যস্থান।
‘বলিউড’ শব্দটায় অবশ্য বিশ্বাস করতেন না মনেপ্রাণে। ‘‘আমাদের ইন্ডাস্ট্রির একটা নিজস্ব ধারা রয়েছে, যার সঙ্গে হলিউডের কোনও সম্পর্ক নেই। হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির শিকড় আদতে নিহিত রয়েছে পারসি থিয়েটারে,’’ একবার বলেছিলেন ইরফান। ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার ভাসা ভাসা চোখের ছেলেটিকে মীরা নায়ার প্রথম সুযোগ দিয়েছিলেন ‘সালাম বম্বে’ ছবিতে। তপন সিংহও সেই সময়ে তরুণ ইরফানকে কাস্ট করেন ‘এক ডক্টর কি মওত’ ছবিতে। ‘সালাম বম্বে’তে তাঁর কিছু দৃশ্য সম্পাদকের কাঁচিতে বাদ পড়ায় মনঃক্ষুণ্ণ ছিল বছর কুড়ির ছেলেটি। ইরফানের সেই খেদ ‘দ্য নেমসেক’-এ অবশ্য মিটিয়ে দিয়েছিলেন মীরা। ছবির অশোক গাঙ্গুলি হয়ে উঠতে ইরফান তালিম নিয়েছিলেন এক প্রবাসী বাঙালি রেস্তরাঁমালিকের কাছ থেকে। অশোক, মকবুল, মন্টি, রুহদার, সাজন ফার্নান্ডেজ়, পান সিংহ তোমর, ড্রাইভার রানা চৌধুরী থেকে শুরু করে হালের চম্পক বনসল... ইরফান খানকে ভারতীয় দর্শক মনে রাখবেন বহু রূপে। অথচ এই ইরফানই এক সময়ে ভেবেছিলেন অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার কথা। যখন টেলিভিশনের থোড়-বড়ি-খাড়ায় প্রায় ভুলতে বসেছিলেন অন্তরের শিল্পীসত্তাকে। ব্রিটিশ পরিচালক আসিফ কাপাডিয়া নামী তারকা নিতে না পেরে ইরফানকে নিলেন ‘দ্য ওয়রিয়র’-এ। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক আঙিনায় পৌঁছে গেল ইরফানের কাজ। পরবর্তী কালে ‘ইনফার্নো’, ‘লাইফ অব পাই’, ‘জুরাসিক ওয়র্ল্ড’-এর মতো ছবির অংশ হয়ে উঠলেন এই ভারতীয় অভিনেতা। ভারতীয় দর্শকের সঙ্গে যখন সবে পরিচয়ের শুরু, সেই সময়েই বিশাল ভরদ্বাজের ম্যাকবেথের অ্যাডাপ্টেশনে চমকে দিয়েছিলেন মকবুলরূপী ইরফান। ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’য় ছাদে প্রাণখোলা চিৎকার কিংবা ‘দ্য লাঞ্চবক্স’-এ টিফিন কেরিয়ারের সঙ্গে আসা চিঠির ভাঁজ খুলে মুচকি হাসি— সংলাপহীন দৃশ্য কী করে জীবন্ত করে তুলতে হয়, তা ছিল অভিনেতার সিগনেচার স্ট্রোক।
ব্যক্তিগত জীবনেও কম কথার মানুষ ছিলেন। যতটুকু বলতেন বা লিখতেন, তাতে ফুটে উঠত তাঁর গভীর জীবনবোধ। লন্ডনে চিকিৎসাধীন ইরফানের হাসপাতালের জানালা থেকে দেখা যেত লর্ডসের ক্রিকেট স্টেডিয়াম। তার গায়ে ভিভ রিচার্ডসের সহাস্য ছবি। অভিনেতার মনে হত, হাসপাতাল কিংবা রাস্তার ও প্রান্তের স্টেডিয়াম, দু’টি জায়গাই চরম অনিশ্চয়তায় ভরা, ঠিক আমাদের জীবনের মতোই। নিউরোএন্ডোক্রাইন টিউমরের সঙ্গে লড়াই চলাকালীন এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, ‘‘যেটা অনিবার্য, তার সামনে নিজেকে সঁপে দেওয়া ছাড়া আর উপায় নেই। তবে জীবনে এই প্রথম বুঝতে পারছি, ‘ফ্রিডম’ কাকে বলে।’’ ক্যামেরার সামনেও মুক্তচিন্তা ও স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়ের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ইরফান। একটিই বাংলা ছবি করেছেন, মোস্তাফা সরোয়ার ফারুকী পরিচালিত ‘ডুব’। সেই ছবিতে তাঁর সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ হয়েছিল পার্নো মিত্রর। ‘‘শুধু নিজে ইম্প্রোভাইজ় করা নয়, সহ-অভিনেতাকেও তাঁর মতো করে ইম্প্রোভাইজ় করার সুযোগ করে দিতেন উনি,’’ বললেন পার্নো। ফারুকী মনে করলেন, ‘‘গত বছর লন্ডনে তিশা আর আমি যখন ওকে শেষ বারের মতো দেখেছি, তখনও ওঁর প্রাণশক্তি অফুরান। ওঁর কথায় দার্শনিকসুলভ ঔদাসীন্য ছিল। গভীরে গেলে, তবে টঙ্কের (রাজস্থান) সেই মজার ছেলেটাকেও খুঁজে পাওয়া যেত।’’
আরও পড়ুন: ‘এত তাড়াতাড়ি চলে গেলে?’ ইরফানের মৃত্যুতে কাঁদছে বলিউড
দিনকয়েক আগে মা সঈদা বেগমকে হারিয়েছিলেন। শোনা গিয়েছে, মঙ্গলবার কোকিলাবেন ধীরুভাই অম্বানি হাসপাতালে ভর্তি করানোর সময়ে মায়ের কাছে যাওয়ার কথাই বলছিলেন ইরফান। রাজস্থানের বনেদি ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে ইরফান নিজের নাম থেকে বাদ দিয়েছিলেন ‘সাহাবজ়াদা’, নিজের টুইটার হ্যান্ডল থেকে বাদ দিয়েছিলেন পদবিও। নিজের পরিচয় শুধু শিল্পীর গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইতেন পদ্মশ্রী পদকপ্রাপ্ত এই অভিনেতা। আনন্দবাজার পত্রিকার দফতরে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘মিডিয়াই হিরো বানায়। আই ডোন্ট থিংক উই ডিজ়ার্ভ দিস। আমার কাছে হিরো তাঁরাই, যাঁরা অন্যের জীবন বদলে দিতে পারেন।’’ এই মিডিয়াই প্রত্যক্ষ করেছে, পর্দার হিরো কী ভাবে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে লড়তে চালিয়ে গিয়েছিলেন ‘আংরেজ়ি মিডিয়াম’-এর শুটিং। ‘কারওয়াঁ’র প্রচারে থাকতে না পারায় ক্ষমা চেয়েছিলেন দর্শকের কাছে। ৫৩ বছর বয়সি এই অভিনেতা সম্পর্কে অতীত কাল ব্যবহার করা মুশকিল। তবে তাঁর রেখে যাওয়া কাজ অতিক্রম করে যায় সময়। কারণ রুহদারের মৃত্যু হয় না।
আরও পড়ুন: ইরফান খান, এক পরিপাটি দিব্যোন্মাদ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy