নুরজাহান বা আনারকলির জাহাঙ্গির, মুমতাজের শাহজাহান, জোধাবাইয়ের আকবর কবেই তো হয়ে গিয়েছে। এত দিন পরে বাবর!
তাঁকে নিয়ে গল্প কই? বাবরি মসজিদ নিয়ে দশকের পর দশক তরজায় বাবর থাকেন আড়ালেই। আফগানি যুদ্ধচর্চায় লাদেন, তালিবান, বাইডেন, ইমরান সব আছেন, পাঁচশো বছর আগেকার জহিরউদ্দিন মহম্মদ বাবর কই? যদিও ওই কাবুলেই তিনি শুয়ে আছেন আজও, নিজের সাম্রাজ্যে।
ফলে সাম্রাজ্যের গল্প বলতে গিয়ে কেউ যদি বাবরের গল্প পেড়ে বসে, কৌতূহল হয় বইকি। মুঘল সাম্রাজ্যের পিতামহের খোলস ভেঙে দেখতে ইচ্ছে করে সেই কিশোরকে যে দুরন্ত ঘোড়ার বল্গা ছেড়ে তিরের নিশানায় বিঁধে দিতে পারে ধাবমান বাঘের ভ্রুমধ্য— যেমনটি লিখে গিয়েছেন উজবেক সাহিত্যিক পিরিমকুল কাদিরভ। বাবার আচমকা অপমৃত্যুর পরে মাত্র বারো বছর বয়সে যাঁকে পরতে হয় রাজার মুকুট আর মধ্য এশিয়ায় ধূম্রঝটিকার মতো যিনি ধেয়ে যেতে থাকেন সমরখন্দ থেকে হিসার, কুন্দুজ় থেকে কাবুল। বাপের বংশে চাঘতাই তুর্কি তৈমুর লং আর মায়ের কুলে মোঙ্গল চেঙ্গিজ় খাঁয়ের রক্ত তাঁর ধমনিতে। অথচ ঘোড়ার খুর আর তরবারির ঝনঝনার মধ্যেই তিনি লিখে ফেলেন দু’হাজার পঙ্ক্তির কাব্য ‘দর ফিক মুবাইয়াঁ’, বিষয় ইসলাম ও শরিয়ত। জীবনে প্রথম বার প্রেমে পড়েন, তা-ও এক কিশোরের, লেখেন উথালপাথাল সব কাপলেট। আর রোজকার জীবন, সাধ, স্বপ্নভঙ্গ, রুক্ষ পথ, তৃণাঙ্কুর, বিপজ্জনক অভিযান এক সুতোয় বেঁধে নিরাবেগ ঝরঝরে গদ্যে এক রোজনামচা, ছেঁড়া ছেঁড়া, ভবিষ্যতে যা ‘বাবরনামা’ নামে বেঁচে থাকবে শতকের পর শতক।
অ্যালেক্স রাদারফোর্ডের (লেখক দম্পতি ডায়ানা ও মাইকেল প্রেসটনের যৌথ ছদ্মনাম) ‘এম্পায়ার অব দ্য মোঘুল’ নামে ছ’খণ্ডের ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রথমটি ‘রেডার্স ফ্রম দ্য নর্থ’ অবলম্বনে তৈরি মিতাক্ষরা কুমারের ‘দি এম্পায়ার’ সেই লোকটাকে, সেই দেশ-কালকে কতটা ছুঁতে পারল?
দি এম্পায়ার (ওয়েব সিরিজ়)
পরিচালনা: মিতাক্ষরা কুমার
অভিনয়: শাবানা, কুণাল, ডিনো, দৃষ্টি, আদিত্য, রাহুল
৪.৫/১০
বড় বাজেটের সিরিজ়। জমকালো সেট (মূলত অন্তর্দৃশ্যে) আর কস্টিউম ছাড়াও পর্দায় হাজির শাবানা আজ়মি (বাবরের দিদিমা দৌলত এহসান বেগ), ডিনো মরিয়া (বাবরের চির প্রতিদ্বন্দ্বী শয়বানি খাঁ), কুণাল কপূর (বাবর) বা ইমাদ শাহ (বাবরের প্রেমিক)। বহু দিনের শাবানা আর তরুণ ইমাদের পারফরম্যান্স রাতজাগা চোখের আরাম। মূল দু’টি চরিত্রে কুণাল কপূর ও ডিনো মরিয়া মন্দ নন। জঘন্য গ্রাফিক্স, যদিও ক্যামেরা আর সেটের তালমিল ভাল (‘গেম অব থ্রোনস’-এর সঙ্গে তুলনা বাদ থাক)।
তবে বাবর মানে যে বারবার পাল্টে যেতে থাকা ভূপ্রকৃতি, জনপদ, স্থাপত্য সে সবের বিশেষ বালাই নেই। সমরখন্দও যা, কাবুলও তা-ই। সে না হয় বাজেটের গেরো। কিন্তু আসল জিনিস, গল্প? প্রযোজক গোড়ায় গেয়ে রেখেছেন, ইতিহাসের অনুপুঙ্খ অনুসরণের বদলে তাঁরা ‘শৈল্পিক স্বাধীনতা’ নিয়েছেন। কেমন সে স্বাধীনতা?
পাহাড়ি খাদের উপর বসানো আন্দিজ়ান (এখন উজবেকিস্তানে) দুর্গ থেকে কোন এক রহস্যে অতলে পড়ে গিয়েছিলেন বাবরের বাবা, কবুতর-প্রিয় ওমর শেখ মির্জ়া। বাবরনামা বলছে, “উড়ানবাজ কবুতরদের সঙ্গে উড়ে গেলেন আমার আব্বা আর বাজপাখি হয়ে গেলেন।” কিন্তু পর্দা দেখাচ্ছে, ভূমিকম্পে ছিটকে খাদের ধারে ঝুলছেন ওমর, তাঁর হাত আঁকড়ে ধরা শাশুড়ি দৌলত এহসান আলগোছে মুঠো ছেড়ে দিলেন। দুর্বল জামাইয়ের বদলে সবল নাতিকে তিনি হিন্দুস্তানের তখ্্তে দেখতে চান!
এ ছাড়া আরও যে কত! শয়বানির কবল থেকে বাবরের দিদি খানজ়াদার (দৃষ্টি ধমি) নিষ্কৃতির শেষ দৃশ্য কহতব্য নয়। প্যাচপেচে বলিউডি উদ্গার।
বস্তুত, হিন্দুকুশ পেরিয়ে কাবুলে এসে ঘাঁটি গাড়ার পরেই হিন্দুস্তানের খোয়াইশ একটু-একটু করে উঁকি দিতে থাকে বাবরের মনে (পরে তিনি কাবুল আর কন্দহরের রাজপাট ছেড়ে দেবেন হুমায়ুনের বৈমাত্রেয় ভাই কামরান মির্জ়ার হাতে)। না-হলে আজীবন তিনি তো সমরখন্দের স্বপ্নই দেখেছেন, যা একাধিক বার হাতে পেয়েও ধরে রাখতে পারেননি।
২০ এপ্রিল ১৫২৬, পানিপথের প্রথম যুদ্ধে পতন হল সুলতান ইব্রাহিম লোদির। প্রথম বার কামান গর্জাতে দেখে তাঁদের পর্বতপ্রমাণ হাতিগুলো উল্টো মুখে ঘুরে এমন দাপাদাপি শুরু করল যে বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। বাবরনামা জানাচ্ছে, সুলতান পালিয়েছেন ভেবে তাঁকে পাকড়াও করতে দুই যোদ্ধাকে আগ্রার দিকে ছুটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিকেলে খবর এল, মৃতদেহের স্তূপে ইব্রাহিম লোদির দেহ মিলেছে। “সেই দিনই হুমায়ুনকে দ্রুত আগ্রা চলে যাওয়ার ভার দিলাম...” লিখছেন বাবর।
অথচ পর্দা দেখাচ্ছে, লোদি হাতির পিঠ থেকে নেমে হুমায়ুনকে তরবারির ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত করছেন যতক্ষণ না বাবর এসে তাঁকে কোতল করেন। সৎমায়ের ষড়যন্ত্রে সেই ক্ষত বিষিয়েই হুমায়ুন মরতে বসেন। আর তার পরে ‘বাবরের প্রার্থনা’, নিজের আয়ু দিয়ে হুমায়ুনকে বাঁচিয়ে বাবর মৃত্যুশয্যায়। অমর লেজেন্ড। কিন্তু ঘোরতর অসুস্থ হুমায়ুনের মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা এবং বাবরের মৃত্যু যে আসলে আরও চার বছর পর, ১৫৩০-এ।
ঐতিহাসিক আখ্যানকার মাত্রেই কল্পনার আশ্রয় নেন। ‘গৌড় মল্লার’-এ শরদিন্দু, ‘সেই সময়’-এ সুনীল, ‘শাহজাদা দারাশুকো’-য় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়— কে নেননি? যেখানে ইতিহাস চুপ, কল্পনা দিয়ে সেই সব ফাঁকফোকর ভরাট করে বুনে চলাই এই নকশিকাঁথার রীতি। কিন্তু সস্তা নাটক তৈরি করতে গিয়ে ইতিহাসের ঘাড় মটকালে ইতিহাস কি তা ক্ষমা করবে? বা দর্শক?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy