কাহিনির ছক চিরচেনা হলেও পর্দায় টান টান উত্তেজনা, সৌজন্যে রাজ চক্রবর্তীর গল্প কথনের মুনশিয়ানা। ছবি: সংগৃহীত।
মৃদুল কাকুর কথা মনে আছে আপনাদের?
রোজ সকাল সকাল পবনের চায়ের দোকানে এসে বসতেন! দড়ির মতো শরীর! মাথায় রোঁয়ার মতো চুল। হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে থাকতেন। বেশি কথা ছিল না মুখে। দু’-এক কাপ চা খেয়েই ফিরে যেতেন বাড়ি। কিন্তু কেউ ‘বিলেত’ যাচ্ছেন শুনলেই শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠত মৃদুলকাকুর! চোখ চকচক করত! মাথা তুলে আধবোজা স্বরে বলতেন “একবার বিলাত পৌঁছে খবর নিয়ো তো। সমীরটা ভালো আছে তো? কত দিন কথা হয় না!” মৃদুলকাকুর আর সমীরের খোঁজ নেওয়া হয়নি! সেই যে গত শীতে জ্বরে পড়লেন। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারলেন না। পার্সেলে অবশ্য মৃদুলকাকুর চিতাভষ্ম বিলাত পৌঁছল!
এমন গল্প দানা বাঁধে রোজ। রাতের শহরে বেজে ওঠে বেহালা! নাভি থেকে উঠে আসে চেনা অসুখের বিষণ্ণ সুর। সেই সমস্ত বিষাদ স্বরের প্রতিনিধি বুঝি রাজ চক্রবর্তীর ‘সন্তান’।
উড়ালপুলের হু-হু করা গতি, সুউচ্চ আবাসনের আকাশছোঁয়া ইচ্ছে! ঝুপড়ির বাসিন্দাদের নিত্য কলহ। আর প্রতিবাদ মিছিলে নাম ডাকা শেষ হলে ঝাপসা হয়ে যাওয়া কলকাতা। অন্ধকারে কে যেন পিছু ডাকে! আধবোজা স্বরে কানে ঠোঁট ঠেকিয়ে বলে “তাকিয়ে দেখো! চারপাশটা রোজ একটু একটু করে বৃদ্ধাশ্রম হয়ে যাচ্ছে!” তখন কি ভয় করে? শরীরে কাঁপুনি ধরে? পিছন ফিরে তাকাতে ইচ্ছে হয়?
কিন্তু থামার উপায় নেই। তা হলেই ফাঁকি পড়ে যাবে ক্যামেরার ঝলকানি, চলমান সিঁড়ির ত্বরিতগতি! আরও কত কী! হয়তো সেই অবসরে ঝাঁ-চকচকে আবাসনের ১৭ তলার ফ্ল্যাটে বসে পিগি ব্যাঙ্কে খুচরো জমাচ্ছে কোনও নিষ্পাপ শিশু। অফিস-ফেরত বাবা তাকে প্রশ্ন করে, “এত টাকা জমিয়ে কী করবি?”
ছোট্ট সন্তানের উত্তর, “মা বলেছে উকিল অনেক টাকা নিচ্ছে! আমি যখন বড় হয়ে তোমাদের ছেড়ে চলে যাব তোমাদের সঙ্গে দেখা করব না, তুমি তো দাদুর মতো আমার বিরুদ্ধে মামলা করবে! তাই এখন থেকে টাকা জমাচ্ছি!”
রাজ চক্রবর্তী দৃশ্যের ভাঁজে ভাঁজে উস্কে দেন গভীর আলাপ! চারিদিকে ঝুড়িঝুড়ি সাফল্যের গল্প! কিন্তু কাকে বলে সাফল্য? কী তার মাপকাঠি? গাড়ি, বাড়ি, ব্যাঙ্কে জমানো অর্থ, কর্মক্ষেত্রে ঊর্ধ্বমুখী রেখাচিত্র? না কি পরিবার নিয়ে নিশ্চিন্ত যাপন? বাবা-মা, সন্তানের দ্বন্দ্বে চিরকাল খলনায়ক হয়েছে সন্তান? ১৯৯৬ সালে মুক্তি পেয়েছিল প্রভাত রায়ের ‘লাঠি’, ২০১৭ সালে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-নন্দিতা রায়ের ‘পোস্ত’। শুধু তা-ই নয়, বাংলা মূলধারার ছবিতে ‘সন্তান’ নামেই রয়েছে একের পর এক ছবি। ১৯৯৭ সালে হরনাথ চক্রবর্তী ‘আজকের সন্তান’ তৈরি করেছিলেন। ‘সন্তান’ নামে একটি ছবি পরিচালনা করেছিলেন অঞ্জন চৌধুরী, ১৯৯৯ সালে। একই বছর স্বপন সাহা তৈরি করেছিলেন ‘সন্তান যখন শত্রু’।
চেনা গল্পের আড়ালে দ্বন্দ্বের টানাপড়েন একই, হয়তো বেড়েছে মনস্তাত্ত্বিক বোঝাপড়া। তাই প্রশ্ন উঠছে বাবা-মায়ের কোনও দোষ নেই? কোর্ট-কাছারিতে আদৌ সমাধান হয়? না কি জটিলতা বাড়ে? ঘুরপাক খায় দৃশ্যেরা! উত্তর আসে না!
কাহিনির ছক চিরচেনা হলেও পর্দায় টান টান উত্তেজনা। সৌজন্যে রাজ চক্রবর্তীর গল্প কথনের মুনশিয়ানা। আসলে ভাল রাঁধুনির হাতে সাধারণ পদের স্বাদও উপাদেয় ! ছবির শেষের দিকে অনুসূয়া মজুমদার যখন বলেন “মাই হাজ়ব্যান্ড ইজ় নট ফর সেল! (আমার স্বামী বিক্রি নেই)”, ভিড়ে ঠাসা মাল্টিপ্লেক্স ফেটে পড়ে হাততালিতে। না, শুধু হাততালিই নয়, উড়ে আসে এলোপাথাড়ি ‘সিটি’! বোঝা যায় আসলে ফ্যামিলি ড্রামারও রাজার রাজা রাজ! শরীরে, মনে মিঠুন নিজেকে পুরোপুরি ভেঙেছেন। স্বভাবসিদ্ধ ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ (অতিরঞ্জন) ভাবের ছিটেফোঁটাও নেই! যেন পাশের পাড়ার চেনা কোনও বৃদ্ধ। রোজকার বাস-ট্রেনের বাদুড়ঝোলা যাতায়াত। স্ত্রীর চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে না পারা। নিত্য যাপনের গোলকধাঁধায় নিজেকে হারিয়ে ফেলা ক্লিষ্ট স্বামী, বাবা।
অনসূয়া যোগ্য সঙ্গত করে গিয়েছেন গোটা ছবি জুড়ে! ঋত্বিক যে কোনও চরিত্রের পোশাক গলিয়ে নেন অনায়াস স্বভাবে। এখানেও তাই। উকিলের চরিত্রে শুভশ্রী মন্দ নয়! শেষের দিকে ছাপ রেখে যান খরাজ মুখোপাধ্যায়!
প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে আসার সময় অনেকের চোখে জল! কোনও এক ‘সন্তান’ বলে ফেলেন, “পরের বার বাবা-মাকে নিয়ে ছবি দেখতে আসব।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy