দর্শকের প্রত্যাশা পূরণ হল?
‘সেই সব হেলাফেলা, নিমেষের লীলা খেলা, চারিদিকে করি স্তূপাকার,/ তাই দিয়ে করি সৃষ্টি, একটি বিস্মৃতি বৃষ্টি, জীবনের শ্রাবণ নিশার।’
১৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১২৯৯-তে রবীন্দ্রনাথ যখন ‘সোনার তরী’ কবিতায় এই পংক্তিগুলি লেখেন, তখনও তিনি এক রহস্যময়ীর রেস্তরাঁয় খেতে আসেননি। পরে এসেছিলেন কি? গল্পের মধ্যে লুকিয়ে থাকা রবীন্দ্রনাথকে না দেখলে অবশ্য তা জানা যায় না।
‘এখানে' বলতে? হাইওয়ের পাশে, রবীন্দ্রনাথের লেখা ও ছবি দিয়ে পরিপাটি করে সাজানো, সুদৃশ্য এক ছিমছাম রেস্তরাঁয়, যেখানে সব স্তূপাকার হেলাফেলা, সমস্ত বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া কোন এক অতলে বসে বর্ষার অঝোর ধারার মতো একা বসে সাম্রাজ্য চালায় রূপবতী, কিন্তু অত্যন্ত রহস্যময়ী মুস্কান জুবেরী (আজমেরী হক বাঁধন)।
কিন্তু কে সে? সেও অঝোরধারে ভিজতে ভিজতে গাড়ির শার্সির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক অবয়ব, হাতের নাগালে থেকেও অধরা, দৃষ্টিগোচরে থেকেও আবছা হয়ে পড়া স্মৃতিমাত্র।
কিন্তু সে কি কেবলই ছবির মতো এক সাজানো দোকানের 'মালকিন'? নাকি আরও কোনও রহস্য আছে? রেস্তরাঁর রন্ধনপটীয়সী মোহময়ী কর্ত্রীর পিছনে? যার রান্নার জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধের মতন ছুটে আসে পশ্চিমবাংলা ও বাংলাদেশের মানুষ? যার একটি ফোন কলে, স্থানীয় এমএলএ থেকে এসপি সবাই তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিতে অধীর হয়ে ওঠে?
কলকাতা থেকে আসা নিরুপম চন্দ (রাহুল বোস) জানায় সে 'মহাকাল' পত্রিকার সাংবাদিক। মুস্কান আর তার অদ্ভুতনামা রেস্তরাঁটিকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন করতে এসেছে। নিরুপমকে স্থানীয় পুলিশের খবরি, আতর আলি (অনির্বাণ ভট্টাচার্য) বলে যে, মুস্কান মানবী নয়, ভিন্ন লোক থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা এক রক্তচোষা ডাইনি। আতর নিজে নাকি এক রাত্তিরে ওই ‘বেটির’ ওপর নজরদারি করতে গিয়ে দেখেছে, ‘বেটির’ চোখ ভাঁটার মতো জ্বলছে, সে নাকি মানুষের রক্ত পান করছে।
তবে কি মুস্কান সত্যিই তাই? আদিম কোনও অভিশপ্ত প্রেতাত্মা? যার কাছে রবীন্দ্রনাথ সত্যিই কোনও দিন খেতে আসেননি? আর সেই আশায় সে বিশ্বকবির পথ চেয়ে বসে আছে?
নিরুপম এই আলো-অন্ধকারের মাঝখানে আলো নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রহস্য উদ্ঘাটনে, পাশে তার সেই পুলিশের খবরি আতর আলি। খুঁজতে খুঁজতে সে পৌঁছে যায়, প্রকাণ্ড এক জমিদারবাড়ির সামনে। এখানেই থাকে সেই মুস্কান, যার সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে চোখ ফেরাতে পারে না কেউই।
অবশ্য রাতের অন্ধকারে সুন্দরপুরে কিছুই সুন্দর থাকে না। তার গোরখোদাইকার ফালু, তার জীবন্ত ইতিহাস রমাকান্ত কর্মকার, সবাই কেমন কুয়াশাবৃত রঙিন একটা কাঁচের শার্সির মধ্যে অন্য এক জগতের বাসিন্দা তখন। প্রত্যেকেই যেন খুব কম সাদা, অনেকখানি কালোয় মেশানো। যেন রোদে পোড়া জলে ভেজা রক্তমাংসের মানুষ নয় তারা। তাদের হাত ধরেই নিরুপম রহস্যের গিঁট খুলতে থাকে এক এক করে।
এ দিকে নিরুপমের সহসা আগমনে উতলা হয়ে পড়ায়, মুস্কান পুলিশের সাহায্য নেয়। পুলিশ জানতে পারে, নিরুপম 'মহাকাল' পত্রিকার সাংবাদিক নয়।
তবে নিরুপম কে? মুস্কানের মতো সেও কি এক প্রহেলিকা? সে রহস্য, পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার, সৃজিত মুখোপাধ্যায় গল্পের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন।
মূল কাহিনিটি বাংলাদেশী লেখক মহম্মদ নাজিমউদ্দিনের সৃষ্টি, যা অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে সৃজিত মুখোপাধ্যায় গ্রহণ করেছেন পর্দার জন্য। রবীন্দ্রসঙ্গীতের চমৎকার ব্যবহার গল্পটির আলো-আঁধারিকে অন্য পর্যায়ে তুলে নিয়ে গিয়েছে, যার জন্য পরিচালকের পাশাপাশি সঙ্গীত পরিচালকেরও প্রশংসা প্রাপ্য।
আতর আলির চরিত্রে অনির্বাণ ভট্টাচার্য এক কথায় অনবদ্য। মুখ্য চরিত্রে বাংলাদেশের অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন সমানে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করে গেছেন বহু সিনেমার কাণ্ডারি রাহুল বসুর সঙ্গে। দু’জনের থেকেই চোখ ফেরানো যায় না। একটি বিশেষ চরিত্রে অঞ্জন দত্তও লা-জবাব! সিরিজটি শুরু হয় একটি প্লেন ক্র্যাশের গল্প দিয়ে, যা পরে কাহিনিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিন্দু হয়ে ওঠে। এখানেও মার্কিন অভিনেতা অ্যালেক্স ও’নেল, নিজের চরিত্রটিকে ভাল ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন।
তবে 'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি'-র কাহিনিতে সব থেকে উল্লেখযোগ্য, তার চিত্রগ্রহণ। আলো-আঁধারির খেলা বাংলা চলচ্চিত্রে এ ভাবে বহুদিন ধরা পড়েনি। যে মুন্সিয়ানার সঙ্গে সৃজিত অত্যন্ত সক্ষম ও পারদর্শী ভাবে বাংলায় একটি রহস্য ছবি তৈরির চেষ্টা করেছেন, সেখানে বিশেষ করে রাতের দৃশ্যগুলি গোরস্থানের বা জঙ্গলের গা ছমছমে পরিমণ্ডলকে যথার্থ ভাবে জাগিয়ে তুলেছে।
ভয়, রহস্য, ছিমছাম সাজানো ঘুমন্ত এক মফস্সল, আর তার কেন্দ্রবিন্দুতে আদ্যোপান্ত রহস্যময়ী মোহিনী মুস্কান জুবেরী। মুস্কানের রহস্যের কি কূলকিনারা করতে পারবে নিরুপম চন্দ? নাকি একটি সমাধানবিহীন প্রহেলিকা হয়েই থেকে যাবে মুস্কান?
লেখা শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের 'সোনার তরী' কবিতার কয়েকটি পংক্তি দিয়ে। 'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি' সিরিজের শেষ পর্বটি দেখার পরে সেই একই কবিতার আরও দুটি পংক্তি মনে পড়ে যায় – 'অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে, শেষ হয়ে হইল না শেষ।'
মনে ঘন হয়ে আসা জমাটি বাংলা থ্রিলারের অভাব পূরণ করল এই সিরিজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy