‘সিটাডেল: হানি বানি’ সিরিজ়ের একটি দৃশ্যে সামান্থা রুথ প্রভু ও বরুণ ধওয়ান। ছবি: সংগৃহীত।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইংরেজি ‘সিটাডেল’ নামে সিরিজ়টি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। এই ‘সিটাডেল’ সিরিজ়টিতেই এক সময় অভিনয় করেছিলেন প্রিয়ঙ্কা চোপড়া। সেই জনপ্রিয়তার কিছুটা ব্যবসায়িক ছোঁয়া যাতে তাদের ভাগেও আসে, সেই কারণেই হয়তো আন্তর্জাতিক ওটিটির ভারতীয় সংস্করণটির হিন্দি ভাষায় একই সিরিজ় করার ভাবনাচিন্তা। ভারতীয় সিরিজ়টির প্রথম পরিচ্ছেদটি পরিচলনা করেছেন রাজ নিধিমারু ও কৃষ্ণ ডি কে, যাঁরা ভারতীয় দর্শকের কাছে রাজ ও ডি কে নামেই বেশি পরিচিত। তাঁরা আগেও এই ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’ নামে অন্য একটি বাণিজ্যিক ভাবে সফল সিরিজ় পরিচালনা করেছিলন। সেটি গুপ্তচরবৃত্তির উপরেই মূলত অনুপ্রাণিত ছিল। তাই ‘সিটাডেল’ সিরিজ়টি, যেটি একেবারেই গুপ্তচরবৃত্তির দ্বারাই অনুপ্রাণিত (যেমন মূল ‘সিটাডেল’), তেমন একটি গল্প পরিচালনার ভার নেওয়ার স্বাভাবিক পছন্দও তাঁরা।
ভারতের ওটিটি বাজারে ‘সিটাডেল: হানি বানি’ মুক্তি পেয়েছে বৃহস্পতিবার। মোট ছ’খানা পর্ব, প্রত্যেকটি গড়ে ৪০ মিনিটের। প্রথম এবং শেষ পর্ব দু’টি আর একটু লম্বা। ৫০ মিনিটের সামান্য বেশি। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে প্রায় ৬ ঘণ্টার সিরিজ়। সমস্যা হল সম্পূর্ণ সিরিজ়টি ভীষণ ভাবেই ‘অ্যাকশন’ নির্ভর। তার উপর ভারতীয়। এ দেশের বেশির ভাগ পরিচালকের ধারণা ভারতীয় দর্শক ‘অ্যাকশন’-এর রস তখনই সম্পূর্ণ নিতে সমর্থ হন যখন ‘অ্যাকশন’-এর সঙ্গী হয় আবহের নির্দয় আস্ফালন। ‘সিটাডেল: হানি বানি ’-তেও তার অন্যথা ঘটেনি। সুতরাং ৬ ঘণ্টার কাছাকাছি আপনি যদি বিভীষণ আবহের নির্দয় অত্যাচার সইতে প্রস্তুত থাকেন, তা হলে হয়তো এই সিরিজ়টি দেখার সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারেন।
আলোচনার এই পর্যায়ে সিরিজ়ের গল্পটি একটু ধরিয়ে দেওয়ার আছে। গল্পটি সম্পূর্ণ ভাবেই দুই গুপ্তচর সংস্থার রেষারেষির উপর ভিত্তি করে রচিত। সুতরাং এমন কাহিনিতে গুলিগোলার বিনিময়, মুহুর্মুহু গাড়ি ধাওয়া, অনন্ত রক্তপাত ও খুনোখুনি ইত্যাদি হিংস্র দৃশ্যই যে মূলত প্রাধান্য পাবে সে কথা বলাই বাহুল্য। গুপ্তচরবৃত্তিতে যে সূক্ষ বুদ্ধির খেলাটা আছে, সেটায় কোনও আজব কারণে সাম্প্রতিক ভারতীয় পরিচালকেরা বিশ্বাস করেন না। হয়তো কেউই করেন না। কেন করেন না, তার কারণ কেউ জানেন কি না জানি না, একমাত্র ভারতীয় দর্শক মস্তিষ্ককে দুর্বল বুদ্ধি ভাবা ছাড়া। যাই হোক, সিরিজ়ের কাহিনি বিস্তার এই দুই গুপ্তচর সংস্থার সভ্যদের বন্ধুত্ব, প্রেম, পারস্পরিক বোঝাপড়া, শত্রুতা, প্রতিশোধ ইত্যাদি নিয়েই। এর মধ্যে আবার যে সংস্থাটি ‘সিটাডেল’ নামক প্রযুক্তিটি তৈরি করছে সেটি গৌণ। সিংহভাগ গল্পই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থাটিকে নিয়েই, যার কর্ণধার বাবা (কে কে মেনন)। এই বাবাই আবার পালিত পুত্রের মতো বড় করেছে বানিকে (বরুণ ধওয়ান), যে আসলে অনাথ। বানির প্রেমিকা-বন্ধু-পরে প্রায়-স্ত্রী হানি (সমান্থা) আবার অবৈধ এক রাজকন্যা। বানি একই সঙ্গে মুম্বইয়ের ছবির ‘স্টান্টম্যান’ এবং বাবার গুপ্তচর সংস্থার এক জন অত্যন্ত কার্যকরী সদস্য। হানি দক্ষিণের বাসিন্দা, নিজের বাবার সঙ্গে কথা কাটাকাটির ফলে ভাগ্যান্বেষণে মুম্বই এসে ছবির দুনিয়ায় ঢোকে। সেখানে বানির সঙ্গে আলাপ। বানির সহায়তায় সে বাবার দলে যোগ দেয় এবং বনির শিক্ষাতেই সে-ও একজন তুখোড় মারকুটে হয়ে ওঠে। এর মধ্যে নানা মারদাঙ্গার ঘটনা ঘটে, সে সবের মধ্যেই কোনও এক সময়, যা সংলাপ থেকেই জানা যায়, বানি ও হানির সম্পর্ক গাঢ় হয়, যার ফলশ্রুতি নাদিরা, তাদের কন্যা। সামান্থা আর বরুণের জুটি যে হেতু একেবারেই আনকোরা, সে হেতু তাঁদের খুবই টাটকা লাগে। তাঁদের কন্যার চরিত্রে যে বাচ্চাটি (কশভি মজুমদার) অভিনয় করেছে তার অভিনয়ও বেশ মনকাড়া।
কাহিনিতে অবশ্য এই সব সম্পর্ক সম্পূর্ণ গৌণ, মূল কাহিনি একেবারেই দুই গুপ্তচর সংস্থার একে অন্যকে টপকে যাওয়াতেই আটকে থাকে। সম্পর্কগুলি এসেছে মূলত উপকাহিনি হিসাবে। সুতরাং আবহের আস্ফালন, খুনোখুনি এবং রক্তপাতেই সিরিজ়টি ভর্তি। কাহিনির বিস্তার মুম্বই, বেলগ্রেড এবং দাক্ষিণাত্যের পটভূমিকায়। শুটিং হয়েছে এ দেশে এবং বেলারুশে। দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফি (জোহন হয়েউরলিন আইডিট), বিশেষত ‘অ্যাকশন’ এবং ধাওয়া করার দৃশ্যগুলি। তবে এটি অনস্বীকার্য, কাহিনি রোমহর্ষক যতটা, হৃদয়তন্ত্রীতে টান ততটা নেই। বলতে গেলে একেবারেই নেই।
তবে থাকতে পারত। যদি সম্পর্কের ছোট ছোট উপকাহিনিগুলিকে আরও বিস্তারিত করা যেত। আসলে কাহিনিতে নিহিত ছিল এক অমোঘ জীবনসত্য। প্রত্যেক মানুষই জীবনের কোনও না কোনও বাঁকে পৌছে, কোন পথটি বেছে নেবে, সেই প্রশ্নটির সম্মুখীন হয়। কোনটি ভুল, কোনটিই বা ঠিক? সিদ্ধান্ত কিন্তু ব্যক্তিগত। সাধারণত মানুষ হয়তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল পথটি বেছে নেয় এবং সেই সিদ্ধান্তটিই তার জীবন গোলমাল করে দেয়। সব সময় যে সেটি ঘটে আপন দোষে তা-ও নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পারিপার্শ্বিক চাপ তাকে প্রভাবিত করে। এই সত্য অবশ্য নতুন কোনও সত্য নয়। মহান যে কোনও চিন্তাই অনেক আগেই নির্মিত হয়েছে। তবে সেই কারণেই জগতে কিছু গল্প ‘ট্র্যাজেডি’ হয়। আবার ‘ট্র্যাজেডি’ও যে সবার জীবনে বিয়োগান্তক, তারও কোনও মানে নেই। যে কোনও ঘটনাতেই কেউ না কেউ লাভবান হয়ই।
কিন্তু হয়তো বাণিজ্যলক্ষীকে ঘরে আটকাতেই কাহিনির এই অমোঘ দিকটিতেই পরিচলকদ্বয় নজর দিলেন না। কাহিনির মধ্যে কিন্তু সেই দিকটি লুকিয়ে ছিল, যা মাঝেমধ্যে, বিশেষত শেষের দিকে, সংলাপের দ্বারা উঠে এসেছে। কিন্তু আবহের আস্ফালন, বেলগ্রেড আর ভারতের মধ্যে বিন্যাসের হুড়মুড় দৌড়, আর থেকে থেকেই হিংস্র ‘অ্যাকশন’-এর তোড়ে এই দিকটি দুর্বলই থেকে গিয়েছে। এটিই এই কাহিনির সবচেয়ে দুঃখের দিক। রাজ এবং ডিকে কিন্তু চাইলে কাহিনির ভিতর এই নিহিত ফল্গুধারাটিকে একটি অন্য মাত্রা দিতে পারতেন। ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’ (শুরু ২০১৯) সিরিজ়টিতে কিন্তু নায়কের পারিবারিক টানাপড়েন আর গুপ্তচরবৃত্তির চাপ সমান্তরাল ভাবে এগোয়। তবে বাণিজ্যিক ভাবে যত সফল পরিচালকই হন বা যত মেধাবিশিষ্ট স্রষ্টা, আসলে কোনও সিরিজ়ই তো সহজে শেষ করা যায় না। পরের পর্বে তা হলে কিসের ভিত্তিতে কাহিনি এগোবে? আর ‘সিটাডেল: হানি বানি’র এই তো সবে প্রথম পরিচ্ছেদ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy