‘আদিপুরুষ’ ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত।
জয় শ্রী রাম! এই জয়ধ্বনি দিয়েই শুরু হল ‘আদিপুরুষ’-এর ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো। কিন্তু প্রায় হাউসফুল শো-এ তার পর আর বিশেষ উচ্ছ্বাস দেখা গেল না। কোনও হাততালি নেই, রাম-রাবণের ‘এন্ট্রি শট’-এ কোনও সিটির আওয়াজ নেই, এমনকি, বিরতিতেও কোনও রকম চাঞ্চল্য নেই দর্শকের মধ্যে। তা হলে কি রামায়ণ বলে সকলে ভক্তিভরে চুপটি করে দেখছেন? নাহ্, তা-ও বলা যাবে না!
আদিকাণ্ড
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘তানাজি’-খ্যাত পরিচালক ওম রাউতের ‘আদিপুরুষ’ নিয়ে উৎসাহ ছিল ঘোষণার সময় থেকেই। রাম হচ্ছেন প্রভাস। ‘বাহুবলী’র পর আবার এক বার তাঁকে পর্দায় বড় মাপের চরিত্রে দেখা যাবে। সীতা হিসাবে কৃতি শ্যাননের কাস্টিং নিয়ে শুরু থেকে সমালোচনা হলেও পর্দার বাইরে প্রভাস-কৃতির প্রেমের গুঞ্জন দর্শকের উৎসাহ বাড়িয়ে দিয়েছিল। রাবণের চরিত্রে সইফ আলি খানের নামেও ছিল বাড়তি চমক। রাম-রাবণের কাস্টিংয়ে উত্তর-দক্ষিণের উলটপুরাণ মনে ধরেছিল অনেকেরই। কিন্তু ছবির প্রথম ট্রেলার বেরোনোর পর থেকেই শুরু হল বিপত্তি। এক দিকে, রাবণের মুখে কেন বিধর্মী দস্যুর মতো দাড়ি— এই মর্মে আপত্তি তোলে একাধিক ধর্মীয় সংগঠন এবং রাজনৈতিক দল। অন্য দিকে, রসিকতা শুরু হয়েছিল নিম্নমানের সিজিআই-এর কাজ দেখে। সমালোচনার জেরে ছবির মুক্তি পিছিয়ে দিয়েছিলেন নির্মাতারা। অবশেষে ঠিক হয়, ১৬ জুন মুক্তি পাবে ছবিটি। ছবির প্রচার পর্বেও একাধিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন কলাকুশলী। কিন্তু সব মিলিয়ে ছবি নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছিল ভরপুর। নির্মাতাদের দাবি, প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা নাকি অগ্রিম বুকিংয়েই তুলে নিয়েছে এই ছবি। বোঝাই যাচ্ছে, ছবি নিয়ে যথেষ্ট ‘হাইপ’ তৈরি করতে পেরেছেন নির্মাতারা। কিন্তু দর্শকের প্রত্যাশা কি পূরণ করতে পারলেন? সেটাই আসল প্রশ্ন।
চিত্রনাট্যকাণ্ড
এ ছবি গোটা রামায়ণের গল্প নয়। রাম-সীতার বিয়ে, কৈকেয়ীর ষড়যন্ত্র, রামের বনবাস, রামের কাছ থেকে পাদুকা নিয়ে ভরতের অযোধ্যায় ফেরা— এ সবই ছবির শুরুতে অ্যানিমেশনে দেখিয়ে দেওয়া হয়। গল্প শুরু হয় দণ্ডকারণ্য থেকে সীতাহরণ দিয়ে, চলে লঙ্কাকাণ্ড বা যুদ্ধকাণ্ড পর্যন্ত। তবে ছবি শুরু হওয়ার আগেই বিস্তারিত বিবৃতি দিয়ে বলা হয় (অন্যান্য ছবিতে যা শুধুই এক ঝলক দেখানো হয়, সেটি এখানে যত্ন নিয়ে ভয়েসওভারের সাহায্যে দর্শককে জানানো হয়েছে), বাল্মীকির রামায়ণ তাঁরা হুবহু মানেননি। বরং শৈল্পিক স্বাধীনতা ব্যবহার করেই ছবির চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে। রামানন্দ সাগরের রামায়ণের যুগ থেকে যখন প্রযুক্তি অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে, পর্দায় নানা ভাবে গল্প বলার সুযোগ-সুবিধা যখন অনেক বেড়েছে, তখন নির্মাতারা অবশ্যই নিজেদের কল্পনা মিশিয়ে নতুন ভাবে রামায়ণ দেখাতে চাইবেন। তাই রাম হয়েছে রাঘব, লক্ষ্মণ হয়েছে শেষ সীতা হয়েছে জানকী এবং রাবণ হয়েছে লঙ্কেশ। কুম্ভকর্ণ-বিভীষণ-শূর্পণখা অবশ্য তাদের মূল নামই পেয়েছে ছবিতে। কিন্তু নতুন ভাবে রামায়ণকে দেখাতে গিয়ে পরিচালক অনেক জায়গায় বেশ অদল-বদল করেছেন গল্পের। তাতে ‘রামায়ণ দেখছি’— এই অনুভূতিটাই তৈরি হয়নি দর্শকের মধ্যে।
সিজিআইকাণ্ড
শুধু গল্পবদলের জন্য নয়। এ ছবিকে রামায়ণের চেয়ে আলাদা করার আরও এক কারণ ছবির সিজিআই। রক্তমাংসের অভিনেতারা অভিনয় করছেন, না কি লাইভ অ্যাকশন অ্যানিমেটেড ছবি দেখছি, বোঝা দায়। শোনা গিয়েছিল, এ ছবির ভিএফএক্স-এর বাজেট নাকি ৬০০ কোটি টাকা! এত টাকা কিসে খরচ হল, বোঝা যাবে না। কারণ গোটা ছবি জুড়ে প্রচুর সিজিআই-এর কাজ থাকলেও সেগুলির মান বেশ খারাপ। কিন্তু গুণগত মানের বিচার বাদ রেখে একটু ট্রিটমেন্ট নিয়ে কথা বলা যাক। কোনও দৃশ্য দেখে ‘গেম অফ থ্রোন্স’-এর নাইট কিং বা হ্যারি পটারের ডিমেন্টরদের কথা মনে পড়বে, কোনওটা দেখে মনে হবে মার্ভেলের ‘লোকি’ কিংবা ‘থর’ কিংবা ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জ’-এর কথা। ভারতীয় মহাকাব্যের কোনও রকম আলাদা স্বাদ পাওয়া যাবে না দৃশ্যায়ন দেখে। লঙ্কা দেখে মার্ভেলের কোনও ‘অল্টারনেট ডাইমেনশন’-এর কথা মনে হবে। সেখানে অশোক বনে রয়েছে কিছু চেরি ব্লসমের গাছ। বাকি রাজ্য যেন লোহার পাতে মোড়া। কুবেরের সেই স্বর্গরাজ্য যা রাবণ ছিনিয়ে নিয়েছিল, তার বিন্দুবিসর্গও চোখে পড়বে না। লঙ্কার বাসিন্দারা রাক্ষস, না কি জলদস্যু, না কি হ্যারি পটারের ‘ওগার’ বোঝা মুশকিল। এখানে রাবণ পুষ্পক রথের বদলে একটি ড্রাগন জাতীয় জন্তুর পিঠে চড়ে উড়ে বেড়ায়। রাম-রাবণের অস্ত্রের নীল-হলুদ সব আলোও বহু বার মার্ভেলের ছবিগুলিতে দেখা ফেলা। সঞ্জীবনী বেটে ওষুধ তৈরি করার বদলে এখানে যেন অ্যালকেমির পরীক্ষাগারে পশ্চিমি কায়দায় ‘এলিকজ়ার’ তৈরি হয়। এত ভেলকিবাজির মধ্যে রামায়ণের কথা দর্শক ভুলেই যাবেন।
চরিত্রায়ণকাণ্ড
সেটা ভুলে যাওয়ার আরও একটি কারণ অবশ্যই চরিত্রায়ণ। এখানে রাবণ হাঁটে কিংকংয়ের মতো। ইন্দ্রজিৎ মেঘের আড়াল থেকে নয়, যুদ্ধ করে ‘ফ্ল্যাশ’-এর মতো দ্রুত গতিতে দৌড়ে। হনুমানের রসবোধের কথা রামায়ণের অনেক সংস্করণে উল্লেখ থাকলেও তার মুখে ‘টাপোরি’ ভাষা বসিয়ে দেওয়াটা বাড়াবাড়ি বলেই মনে হয়। লক্ষ্মণ যেন এখানে ভুল প্রমাণিত হওয়ার জন্যেই দু’চার লাইন সংলাপ বলে! কুম্ভকর্ণের মতো দারুণ একটি চরিত্রকেও কেন হেলাফেলা করলেন গল্পকারেরা, তা-ও বোঝা গেল না।
অভিনয়কাণ্ড
প্রভাসের অভিনয় বড্ড একমাত্রিক। রাম হিসাবে তাঁকে মন্দ লাগেনি। কিন্তু তাঁর হাসি-কান্না-রাগ, সবই এক রকম। একটিই দৃশ্যে তাঁকে ভাল লাগবে। যখন রাঘব ঝরনার জলে স্নান করে, শূর্পণখা তাকে দেখেই প্রেমে পড়ে যায়। সেই দৃশ্য উস্কে দেবে ‘বাহুবলী’র স্মৃতি। এক মুহূর্তের জন্য মনে পড়ে যাবে, সে ছবিতে প্রভাসকে দেখে দর্শক কতটা উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। পরমুহূর্তেই কিন্তু মনখারাপ হয়ে যাবে। কারণ, এ ছবিতে সেই ভাল লাগার এক কণাও পাওয়া যাবে না। সীতার চরিত্রে কৃতি শ্যানন সত্যিই বড্ড ‘মডার্ন’। তবে তাঁর বদলে অন্য কোনও নায়িকা হলেও কোনও অসুবিধা হত না। একটু ভয় পাওয়া আর খানিক লজ্জা মাখা রোম্যান্টিক দৃশ্য ছাড়া সীতার আর কোনওই অবদান নেই ছবিতে। রাবণের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন এ যুগের সাধারণ মেয়েদের মতোই। সেটা অবশ্য কৃতির খামতি নয়, দুর্বল সংলাপের দোষ। লক্ষ্মণের চরিত্রে সানি সিংহ এবং ইন্দ্রজিতের চরিত্রে ভৎসল শেঠ— দু’জনেই খুব বেমানান। তাঁদের অভিনয়, না কি তাঁদের সংলাপ লিখন, কোনটায় বেশি অযত্ন, চট করে বলা যাবে না। রামায়ণ দুই অন্যতম শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদের এ ছবিতে এতটা অবহেলা কেন করা হয়েছে, সেটা নির্মাতারাই জানেন। হনুমানের চরিত্রে দেবদত্ত নাগে মন্দ নন।
হাস্যকর সিজিআই আর দুর্বল পরিচালনা সত্ত্বেও যিনি নজর কেড়েছেন, তিনি রাবণের চরিত্রে সইফ আলি খান। যতই রাবণের দশটি মুণ্ডু হঠাৎ হঠাৎ ভেসে উঠে বিবেকের মতো একে অপরের সঙ্গে কথা বলুক, সইফ দারুণ অভিনয় করেছেন। সকলের মধ্যে তাঁকে দেখতেই সবচেয়ে ভাল লাগবে।
পরিচালনাকাণ্ড
অভিনয় যদি ভাল হত, তা-ও এই রামায়ণ দেখে ভক্তি জাগত না। কারণ, চিত্রনাট্য এবং পরিচালনা দুই-ই বড় কাঁচা। কিছু অহেতুক লম্বা সিকোয়েন্স দিয়ে ছবির দৈর্ঘ্য আড়াই ঘণ্টা করা হয়েছে। পরিচালনা এতই দুর্বল যে, কোনও অংশেই উত্তেজনা তৈরি হবে না। লঙ্কার যুদ্ধের দৃশ্যগুলি দেখেও কোনও রকম শিহরণ জাগে না। যুদ্ধজয়ের পর সে ভাবে আনন্দ হয় না। যুদ্ধশেষে রাম-সীতার মিলনে চোখে জলও আসবে না। রামায়ণের মতো মহাকাব্য পর্দায় রূপ দিলেন পরিচালক। অথচ একটিও গায়ে কাঁটা দেওয়া দৃশ্য তৈরি করতে পারলেন না! যুগ যুগ ধরে বিবিধ আঙ্গিকে রামকথা একই কাহিনিকে উপস্থাপন করে গিয়েছে, করে চলেছে। প্রতিটি রূপায়ণেই জুড়ে থাকে আবেগ। ‘আদিপুরুষ’ সেই আবেগ তৈরিতেও ব্যর্থ।
উত্তরকাণ্ড
শুধু প্রচার কৌশলে যে একটা ভাল ছবি তৈরি করা যায় না, তা বোঝা যায় ‘আদিপুরুষ’ দেখলে। যতই সাম্প্রতিক রাজনৈতিক আবহকে কাজে লাগিয়ে ‘রাম-সীতা’ বিক্রি করার চেষ্টা করা হোক, তারকাদের দিয়ে ১০ হাজার টিকিট কেনানো হোক, হনুমান আসবে বিশ্বাস নিয়ে ফুলপাতা দিয়ে হলের একটা সিট খালি রাখা হোক, আসল ছবি যদি দর্শকের মনে না ধরে, তা হলে এ ধরনের চমক কত দূর চলবে, তা বলা কঠিন। তবে এ ছবির একটাই ভাল দিক, গল্পের শেষে সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয় না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy