ট্যাংরা ব্লুজ়
পরিচালক: সুপ্রিয় সেন
অভিনয়: পরমব্রত, মধুমিতা, সমিউল, ঐশানী
৭/১০
শহরের সব আবর্জনা জড়ো হয় সেখানে। শুধু নোংরাই নয়, তার পাশাপাশি অনেক না-পাওয়া, যন্ত্রণা, ক্ষোভ, চিৎকারও জড়ো হয়। আর তার মধ্য থেকেই উঠে আসেন সঞ্জয় মণ্ডলরা। তলিয়ে যেতে যেতেও যাঁরা হাত ধরেন সৃষ্টির। শিল্পের হাত ধরে ভাষা খুঁজে পায় তাঁর এবং তাঁর মতো আরও অনেক মানুষের চিৎকার।
‘ট্যাংরা ব্লুজ়’ ছবিটি সম্পর্কে একটা দামি কথা বলেছিলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। ইদানীং বাংলা ছবি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যখন বাস্তববিমুখ হয়ে ছকে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে, সেখানে তাঁদের এই ছবি চেনা আশপাশ থেকেই তুলে এনেছে এক ঘোরতর বাস্তবকে। আর তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আমাদের। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত তথ্যচিত্র নির্মাতা সুপ্রিয় সেনের প্রথম ফিকশন দেখলে সে কথার যথার্থতা উপলব্ধি করা যায়। সঙ্গত ভাবেই এই ফিকশন বাস্তববিমুখ হতে পারেনি। আন্ডারডগদের গল্প বলতে গিয়ে অতিরঞ্জনও ঘটেনি। বরং যত্নে তুলে এনেছে, সেই সব সত্যিকারের ছাইচাপা আগুনদের, যাঁদের গল্পটা বলা খুব জরুরি ছিল।
চালু ওরফে চার্লটন মুর্মু (সমিউল আলম) ট্যাংরার বাসিন্দা। মুখে মুখে কবিতা বানায়, স্কুলে যায়, অবসরে পাশের বহুতলে ময়লা কুড়োতেও যায়। তার মতো আরও কয়েকজনের বাজনার দল আছে, যে দলটা চালায় সঞ্জীব মণ্ডল (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জয়ের আদলে তৈরি চরিত্র)। ফেলে দেওয়া ড্রাম, টিন, বাক্স, শিশি-বোতল ইত্যাদি দিয়েই তারা বানিয়ে নিয়েছে পছন্দের বাজনা। বহুতলের বাসিন্দা জয়ী (মধুমিতা সরকার) গানবাজনা প্রেমী, চালু ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে আলাপ হতেই সে ঠিক করে, এদের প্রচারের আলোয় আনবে সে। এর আগে সঞ্জীব আর তার দল জাতীয় স্তরের ট্যালেন্ট হান্টে অংশ নিয়েছে, পরিচিতিও পেয়েছে। কিন্তু তার পরে দল ভেঙে গিয়েছে, সঞ্জীবকে একে একে ছেড়ে চলে গিয়েছে সকলে। তার উপরে সঞ্জীবের পিছু ছাড়েনি তার অন্ধকার অতীত। চালুর মতো কিছু নতুন ছেলেমেয়েদের নিয়ে ফের দল তৈরি করে ঘুরে দাঁড়াতে চায় সঞ্জীব। পাশে পায় জয়ীকে। ফের নাম দেয় প্রতিযোগিতায়। জেতা-হারার ঊর্ধ্বে উঠে ওদের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পটাই বাজিমাত করে শেষটায়।
ছবি শুরু হয় ব্যর্থতার সঙ্গে একা লড়াই করতে থাকা জয়ীর গল্প দিয়ে। ঠিক তার পরেই জয়ীর সুদৃশ্য ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে তার প্রতিবেশীদের উপরে ফোকাস করে রঞ্জন পালিতের ক্যামেরা। হু-হু করে এসে পড়ে চায়না টাউনের অলিগলি, তার রূপ-রস-গন্ধ-গল্প। বাম আমলে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা, কোণঠাসা হয়ে পড়া শ্রমিক আন্দোলন, ক্ষমতাবদল ও গুন্ডারাজের উত্থান... ফ্ল্যাশব্যাকে ঘুরিয়ে আনা হয় এক চক্কর। এই গ্যাং ওয়ারেই জড়িয়ে থাকা গল্পের নায়ক সঞ্জীব ওরফে সঞ্জয় এক সময়ে বন্দুক ছেড়ে বাজনা হাতে তুলে নিয়েছিল, দল গড়েছিল নিজের। এঁদের সত্যিকারের জার্নিকে চিত্রনাট্যে ধরতে গিয়ে ছবির দ্বিতীয়ার্ধ খানিক দীর্ঘায়িত হয়েছে। যদিও তাতে ছবির মূল সুর বিচ্যুত হয়নি। জয়ী ও সঞ্জীবের হতাশা এক সময়ে দর্শককেও গ্রাস করে। তবে কানাগলিতে ঘুরে মরার দমবন্ধকর অনুভূতিটুকু পৌঁছে দিতে সেটা বোধহয় দরকার ছিল।
সঙ্গীত এ ছবির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রশংসনীয় কাজ করেছেন তরুণ সঙ্গীত পরিচালক নবারুণ বসু। বাংলা র্যাপ নিয়ে আরও কাজ করতে উৎসাহিত করবে ছবির মিউজ়িক। ‘এই তো আমার দেশ/মুখটা খুললেই শেষ’-এর মতো গান দাগ কেটে যায়।
প্রতিটি চরিত্রকে ক্লোজ়-আপে ধরায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে তারা। ‘সহজ পাঠের গপ্পো’ ছবির ‘আবিষ্কার’ সমিউল অনবদ্য কাজ করেছে চালুর ভূমিকায় (সঞ্জয়ের দলের সদস্য কৌশিকের আদলে তৈরি চরিত্র)। পরমব্রতের ছবি প্রযোজনায় আসাই এ ছবিকে কেন্দ্র করে, তার প্রস্তুতিও ছিল দীর্ঘ। সঞ্জয় মণ্ডলের ছায়ায় তৈরি সঞ্জীবকে সর্বস্ব দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অভিনেতা। মধুমিতা সরকার ভাল কাজ করেছেন। চালুর বন্ধু পরির চরিত্রে ঐশানী সপ্রতিভ। সঞ্জীবের বন্ধু ইমরানের চরিত্রে ঋষভ বসুকে ভাল লাগে। ছবির শেষে টাইটেল কার্ড ওঠার ঠিক আগে পর্দায় এক ঝলক ভেসে ওঠেন সঞ্জয় মণ্ডল। মুখের হাসিটা বলে দেয়, লড়াইটা জিতে গিয়েছেন তিনি।
‘বিপজ্জনক’ বলে দেগে দেওয়া এ শহরেরই এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সেখানকার অলিগলি থেকে উঠে আসা বাংলার ‘গাল্লি বয়’দের নিয়ে তৈরি ছবি ‘ট্যাংরা ব্লুজ়’, যা বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ হিসেবে থেকে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy