Advertisement
১৬ জানুয়ারি ২০২৫
Movie Review

তিক্ততা আর অনিশ্চয়তার থ্রিলাররূপ ‘ডেসপ্যাচ’, ব্যতিক্রমী ছবিতে ছকভাঙা অভিনয় দেখালেন মনোজ

এ ছবিতে নিম্নগ্রামের এক চরিত্রে অভিনয় করে যেতে হয়েছে মনোজকে। যার তীব্র ঘৃণা, সাময়িক আনন্দ, শান্তির পিছনে ধাওয়া করার প্যাশন— কোনও কিছুই উচ্চকিত নয়।

Review of Manoj Bajpayee starer movie Despatch

ছবি: সংগৃহীত।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৬:০৯
Share: Save:

এক দিকে দুঃসহ দাম্পত্য, অন্য দিকে বদলে যাচ্ছে জীবিকার অর্জনের পরিকাঠামো। এই দ্বন্দ্বকে প্রেক্ষিতে রেখেই তৈরি কানু বহেল পরিচালিত, মনোজ বাজপেয়ী অভিনীত ছবি ‘ডেসপ্যাচ’। থ্রিলার ঘরানার এই ছবির বিষয় টু জি স্পেক্ট্রাম স্ক্যাম। ছবিমুক্তি ওটিটি মঞ্চে। সুতরাং ইদানীং কালের কৌলিক অনুযায়ী তাকে ‘থ্রিলার’ হতেই হয়। কিন্তু যে ধরনের থ্রিলার দেখে ওটিটি-দর্শক অভ্যস্ত, এ ছবির ব্যাকরণ সেই ধাঁচার ধারকাছ মাড়ায়নি। গতিময় কন্টেন্টের যুগে এ ছবি মন্থর। তিক্ত। কখনও কখনও ‘থ্রিল’-এর কাঙ্ক্ষিত তরঙ্গ থেকেও সরে আসা। তবু এ ছবিতে এমন কিছু রয়েছে, যা প্রায় আড়াই ঘণ্টা দর্শককে বাধ্য করে পর্দায় চোখ রাখতে এবং সেই সঙ্গে মনও। তার অন্যতম কারণ অবশ্যই মনোজ বাজপেয়ী।

Review of Manoj Bajpayee starer movie Despatch

এ ছবিতে মনোজ বাজপেয়ী আবারও প্রমাণ করলেন, এখনও বহু বিচিত্র খেলা তিনি দেখাতে পারেন। ছবি: সংগৃহীত।

টু জি স্পেক্ট্রাম স্ক্যাম নিয়ে নাড়াঘাঁটা করতে হলে আজ অন্তর্জালের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় নেই আম ভারতীয়ের বেশির ভাগেরই। বাস্তবে এই স্ক্যামকেই কি পর্দায় ধরতে চেয়েছেন ‘ডেসপ্যাচ’ ছবিতে পরিচালক কানু বহেল? সে ক্ষেত্রে এ ছবি অবশ্যই একটি বিশেষ সময়ের বার্তাবহ। সময়টি বিশ্বায়নের পর্বের এক সন্ধিসময়। যখন বিশ্ব প্রায় অজান্তেই মানুষের ‘মুঠোবন্দি হচ্ছে, এ ছবি সেই কালপর্বের। সুতরাং, গোড়া থেকেই একটি ‘পিরিয়ড পিস’ নির্মাণের সম্ভাবনা এ ছবিতে ছিল। অদূর-অতীতকে সাম্প্রতিক কালে বেশ কিছু হিন্দি মূল ধারার ছবিতে তুলে আনার প্রয়াস দেখা গিয়েছে। তার কোনওটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তৈরি, কোনওটি আবার রাজনীতিকে আবছায়ায় রেখে কাহিনিকে গুরুত্ব দিয়ে নির্মিত ছবি। টু জি-কাণ্ড নিয়ে ছবি তোলার সময়ে একটা বড়সড় সম্ভাবনা ছিল, সেই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কাছে চিত্রনাট্য ও পরিচালনার আত্মসমর্পণের। কিন্তু ‘ডেসপ্যাচ’ সে রাস্তায় হাঁটেনি। অথবা ইদানীং কালের ওটিটি কন্টেন্টের সবচেয়ে বড় প্রলোভন থ্রিলারধর্মিতাকে গোয়েন্দা কাহিনির ‘হুডানইট’-এর দিকে নিয়ে যাওয়ার, ‘ডেসপ্যাচ’ সেই পথও মাড়ায়নি। বদলে এ ছবি এমন এক অনির্দেশ্য সমাপনরেখার দিকে চোখ রাখে, যা বহু কাল হিন্দি মূলধারার ছবিতে দেখা যায়নি।

ছবির মুখ্য চরিত্র জয় বাগ একজন ক্রাইম জার্নালিস্ট। তার কর্মস্থল ‘ডেসপ্যাচ’ নামের এক জনপ্রিয় সংবাদপত্র। কিন্তু কাহিনি জানায়, এই ছবির ঘটনা এমন এক সময়পর্বের, যখন ছাপা সংবাদপত্রের সমান্তরালে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে উঠে আসছে অন্তর্জাল সংবাদমাধ্যম বা ওয়েব পোর্টাল। সংবাদ পরিবেশনের রণাঙ্গনে যে সংবাদপত্রের সাংবাদিকতা বাতিল হতে চলেছে, ছবির শুরুতেই তার ইঙ্গিত রয়েছে। আর সেই ইঙ্গিতই জয় নামক চরিত্রটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ সাংবাদিকতার দিকে। বন্দরের অপরাধী ধরার দৃশ্যকে চাক্ষুষ এবং ক্যামেরাবন্দি করতে গিয়ে জয় জীবনের ঝুঁকি পর্যন্ত নিতে পিছপা হয় না। সে কি কেবলমাত্র সাংবাদিক হিসাবে তার অবস্থানবিন্দুটিকে ‘অনন্য’ রাখার তাগিদেই? না কি তার পিছনে কাজ করে তার অসুখী দাম্পত্য, তার অতি-বৈবাহিক প্রেম এবং সংসারের অসারত্ব অনুধাবন করে এক সমান্তরাল সুখী জীবনের স্বপ্নজাত তাড়না, সে সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধোঁয়াশাই রেখে দেন পরিচালক। জয় তার দাম্পত্য-ঘটিত টানাপড়েন এবং প্রমিকা প্রেরণার সান্নিধ্য লাভের অদম্য আকর্ষণের মাঝখানটিতে পড়েই কি ঝুঁকতে শুরু করে অনিশ্চয়ের দিকে? অথবা নেহাতই ঘটনাক্রম তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় অসম্ভব এক প্রকল্পের দিকে, যেখানে পদে পদে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা?

Review of Manoj Bajpayee starer movie Despatch

আড়াই ঘণ্টা ধরে মনোজ একটি জটিল চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। যোগ্য সঙ্গত করেছেন সাহানা গোস্বামী, অর্চিতা আগরওয়াল। অনেক দিন পরে ঋতুপর্ণা সেনকে দেখা গেল এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। ছবি: সংগৃহীত।

জয় ঘটনাচক্রে জানতে পারে বা তার বর্তমান অ্যাসাইনমেন্টের সূত্র তাকে জানায় টু জি-কাণ্ডের কথা। বৃহৎ থেকে বৃহত্তর ‘স্টোরি’র দিকে সে যাত্রা করে প্রায় কিছু না জেনেই। যে সংস্থা থেকে এই ‘স্ক্যাম’-এর সূত্রপাত, সেই জিডিআর-এর পিছনে কোন অদৃশ্য ক্ষমতাবান কলকাঠি নাড়ছে, সেটা জানাই তার কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। জয়ের বিন্দু থেকে দেখলে মনে হতেই পারে, সে প্রথাগত ‘হুডানইট’কেই খুঁজছে। কিন্তু দর্শকের জায়গা থেকে পুরো বিষয়টিকে দখতে গেলে মনে হয়, সেই ক্ষমতাবানটি ঠিক কে, তা এই ছবিতে না দেখালেও চলবে। কারণ, এ ছবি ‘কে অপরাধ করল’-ধারার বাইরে যেন এক জটিল ক্রাইম-বর্ণালির নথি সংরক্ষণ। জয়ের স্ত্রী শ্বেতা বা প্রেমিকা প্রেরণা অথবা অনির্দেশ্য সম্পর্কের নারী নুরি এই বর্ণালির মধ্যে বিবিধ রঙের যোগান দিয়ে যায়। অন্য দিকে জয়ের ‘সোর্স’ তাকে অন্ধকার থেকে অন্ধকারতর গলিপথে ঠেলে দিতে থাকে। এবং এক সময় তার পরিক্রমার শেষ বিন্দুতে পৌঁছে জয় জানতে পারে, তার নিজেরই আর পালানোর পথ নেই। পরিত্রাণ বলে কিছুই হয় না, এমন এক গোলকধাঁধায় সে ঢুকে পড়েছে। সেই সময় তার পরিবার বলেও কিছু নেই আর প্রেমিকার সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্নের বুদবুদটিও ফেটে গিয়েছে। এর পর সে এগিয়ে যায় সেই অনির্দেশ্য পরিণতির দিকে, যার আঁচ বোধ হয় ছবির গোড়া থেকেই পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার দিয়ে রাখছিলেন।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, এ ছবির গতি মন্থর। ‘থ্রিলার’-এর রোমাঞ্চ বলতে যা বোঝায়, তা বিক্ষিপ্ত ভাবে ছবিতে থাকলেও তাকে কখনওই টানটান রূপ দেওয়ার প্রয়াস নেওয়া হয়নি। এমন একটি চিত্রনাট্যে জয়ের ভূমিকায় মনোজ বাজপেয়ীর উপরেই ভর করে থাকে সমস্ত কিছু। এ ছবিতে মনোজ আবারও প্রমাণ করলেন, এখনও বহু বিচিত্র খেলা তিনি দেখাতে পারেন। আগাগোড়া নিম্নগ্রামে অভিনয় করে যেতে হয়েছে মনোজকে। যার তীব্র ঘৃণা, সাময়িক আনন্দ, শান্তির পিছনে ধাওয়া করার প্যাশন— কোনও কিছুই উচ্চকিত নয়। উচ্ছ্বাসহীন এক চরিত্র, যে অনেক সময়েই প্রায় বালখিল্য কাজ করে বসে জীবনের সঙ্কট ডেকে আনে, অথচ তারও বেঁচে থাকার বিপুল ইচ্ছা— এমন এক জটিলতাকে ফুটিয়ে তোলা সহজ কাজ নয়। আর আড়াই ঘণ্টা ধরে মনোজ সেই কাজটিই করেছেন। তাঁর সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছেন শ্বেতার ভূমিকায় সাহানা গোস্বামী, প্রেরণার ভূমিকায় অর্চিতা আগরওয়াল। অনেক দিন পরে ঋতুপর্ণা সেনকে দেখা গেল এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। সেটাও এ ছবির বড় পাওনা।

Review of Manoj Bajpayee starer movie Despatch

কিন্তু কয়েকটি বিষয় নিয়ে একটু ধন্দ থেকে যায়। টু জি-কাণ্ডকে কি একেবারেই রাজনৈতিক প্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন হিসাবে দেখা যায়? অথচ ‘ডেসপ্যাচ’ আবর্তিত হয়েছে মুম্বই আন্ডারওয়ার্ল্ডকে ঘিরে, বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা তার ‘শুঁড়’গুলির ইঙ্গিত দিয়ে। এখানে পরিচালক কি বিতর্ক এড়াতে চাইলেন? না কি, টু জি-র সঙ্গে টি টোয়েন্টির সাজশ, তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাফিয়াচক্রের লিপ্তি ইত্যাদিকে প্রকাশ্যে রেখেই উহ্য হিসাবে রাখলেন এই কাণ্ডের ‘মেঘনাদ’দের? ছবিতে জয় একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ, নুরি নামের এক উচ্চাভিলাষী নারী তার বয়স নিয়ে ইঙ্গিতময় রসিকতাও করে এবং এ সময় জয় তার ইচ্ছা (অথবা অনিচ্ছায়) নুরির সঙ্গে শরীরী সম্পর্কেও লিপ্ত হয়। কেন? এ কি নিছক ‘মিড লাইফ ক্রাইসিস’, না কি এর পিছনেও খেলা করছে ‘অনিশ্চয়তা’ নামের এক প্রকাণ্ড অমঙ্গলের ভাবনা, যা মানুষকে ক্রমাগত বেপরোয়া করে তোলে? হয়তো এ সব বিষয়ের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন পরিচালক বোধ করেননি। বা করতে চাননি। সব মিলিয়ে ‘ডেসপ্যাচ’ এক তীব্র অস্বস্তিকে জারি রাখে তার গোটা পরসর জুড়ে। যে অস্বস্তি ছবি দেখার পরেও দর্শকের মাথা থেকে নামে না। এ দিক থেকে বিচার করলে ছবির আবহে সঙ্গীতের প্রায় অনুপস্থিতি, সঙ্কটবিন্দুকে ঘনিয়ে তুলতে চড়া বাজনা ব্যবহার থেকে বিরত থাকা ইত্যাদিকে যথযথ বলেই মনে হয়। আবার পাশাপাশি এ-ও মনে হয় যে, যে সময়ে ‘পুষ্পা ২’ মুক্তি পাচ্ছে, যার কিছু দিন আগেই ‘কল্কি ২৮৯৮ এডি’-র মতো উচ্চকিত ছবি মুক্তি পেয়েছে, যেখানে ‘পাঠান’ বা ‘জওয়ান’-এর মতো ছবিই ভারতীয়ত্বের মুল সুরকে ধ্রুবপদে বাঁধতে চেষ্টা করে, সেখানে ‘ডেসপ্যাচ’ একেবারেই ছকভাঙা একটি কাজ। এর অনিশ্চয়তাকে সইতে পারলে, এই দিশাহীন অনির্দেশতার কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেই এ ছবি দেখা সম্ভব। অন্যথায় বিড়ম্বনা বাড়বে।

অন্য বিষয়গুলি:

Despatch Manoj Bajpayee Kanu Behl
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy