Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
review

Mandar: মন্দ জনের মোহে

প্রথমেই গেয়ে রাখা ভাল যে, পাঁচ পর্বের এই ছোট্ট সিরিজ় আদতে একটি দীর্ঘ ছায়াছবি। পৃথক শিরোনাম দিয়ে ভেঙে ভেঙে বলা, এই পর্যন্তই।

সোমেশ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২১ ০৬:৪৫
Share: Save:

মন্দার (ওয়েব সিরিজ়)
পরিচালক: অনির্বাণ ভট্টাচার্য
অভিনয়: দেবাশিস, সোহিনী, দেবেশ, সজল, অনির্বাণ
৭/১০

অরসন ওয়েলস, আকিরা কুরোসাওয়া, রোমান পোলানস্কি, বি ভি করন্থ। বিশাল ভরদ্বাজ।

অনেক নামের মধ্যে দু’চারটে চেনা নাম যাঁরা এই স্বপ্ন ছুঁয়েছিলেন। বাকি আরও অগণিত নামের মিছিল। যশস্বী ও যশোপ্রার্থী নির্মাতার, বিখ্যাত ও স্বল্পখ্যাত নায়কের, এবং নায়িকার— মঞ্চে এবং পর্দায়।

এই একটি ট্র্যাজেডি গত চারশো বছর ধরে এত বার অভিনীত, চর্চিত, নবনির্মিত হয়েছে যে, এটা আর নিছক নাটক নেই বস্তুত, এপিক— যাকে ভেঙে-গড়ে নিজের মহল্লায় নিজের সময়ের মতো করে বলা যায়, অথচ শিকড় থেকে যায় মূলের গভীরেই।

ম্যাকবেথ।

উচ্চাকাঙ্ক্ষা, পাপ ও পতনের গল্প, আর অমোঘ নিয়তির। দেশকাল ভেদে তার ক্ষয় নেই। তারই দুর্মর রহস্য বারবার ঝুঁকির চোরাকুঠুরিতে ডাকে গল্প বলিয়েকে। অনির্বাণ ভট্টাচার্যকেও ডেকেছে।

ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সিরিজ় করার যে সব চালু ফর্মুলা আছে (‌‌যেমন প্রতিটি এপিসোড শ্বাসরোধী সাসপেন্সে শেষ হতে হবে, যে খাতে বয়ে যেতে যেতে রাতজাগা দর্শক টেরই পাবেন না কখন বাইরে কাক ডাকতে শুরু করেছে), ম্যাকবেথের জটিল উপজীব্য তার শর্ত পূরণ করতে পারে কি না, সেটাই একটা প্রশ্ন— ঝুঁকি তো বটেই।

বাজারসফল বাংলা ছবির নায়ক/ অভিনেতা হিসেবে অনির্বাণ এখন যথেষ্টই থিতু, তবু পরিচালনার লাগাম হাতে পেয়েই তিনি (তাঁর প্রযোজকও) ঝুঁকিটা নিয়েছেন। এটা সুখবর। তবে প্রথমেই গেয়ে রাখা ভাল যে, পাঁচ পর্বের এই ছোট্ট সিরিজ় আদতে একটি দীর্ঘ ছায়াছবি। পৃথক শিরোনাম দিয়ে ভেঙে ভেঙে বলা, এই পর্যন্তই।

ভাল ছায়াছবির প্রথম শর্ত ‘ছবি’, যা এক বার দেখে ফেললে গেঁথে যায়, ঘুরে-ফিরে আসে অবরে-সবরে। শুধু বর্শা-গাঁথা মাছ বা সাগর কিনারে পড়ে থাকা বডিতে ঢেউয়ের আগু-পিছু নয়। টিউবের আলোয় লাইলির (মন্দারের স্ত্রী, লেডি ম্যাকবেথ) চটচটে মুখ, আঁধার জলকিনার, মোক্ষম মুহূর্তে পা ফাঁক করে পড়ে থাকা গাছের যোনি। রাতের জঙ্গলে বাঁক কেটে ডাইনির (‘উইচ’-এর চালু বাংলাই রাখা গেল) ডেরায় মোটরবাইক যাওয়ার টপশট, নৌকার কিনারে গ্রস্ত লাইলি বা তার ঠিক আগে মেঝের ছাদ হয়ে ওঠা দর্শকের সম্ভ্রম দাবি করে। রচয়িতার সঙ্গে চিত্রগ্রাহক সৌমিক হালদারকেও অভিনন্দন, এ রকম কাজের সুযোগ তিনি ক’টি পান সে-ও এক প্রশ্ন।

ভাল ছায়াছবির দ্বিতীয় শর্ত ভাল শব্দ, আবহ এবং সঙ্গীত দুই-ই। একটু হোঁচট সেখানে। শুভদীপ গুহ যে দাগ কাটার মতো আবহসঙ্গীত করেছেন, টিজ়ার দেখেই মালুম হয়েছিল। তা বাদেও ছোট ছোট প্রায় অশ্রুত শব্দের কারুকাজ ছড়ানো সাউন্ডট্র্যাক জুড়ে। কিন্তু শব্দমিশ্রণ? ওটিটি-কে চলন্ত ফোন থেকে ঘুমন্ত টিভি, নানা মাধ্যমে উতরোনোর পরীক্ষা দিতেই হয়। ঝমঝম আবহসঙ্গীতের পরেই সংলাপ ফিসফিস করলে কেমন লাগে?

ম্যাকবেথ অভিনয় চার শতকে অজস্র অভিনেতার স্বপ্ন হয়ে থেকেছে। স্কটিশ পটভূমিকায় ব্রিটিশ নাটক, তাদেরই মোনোপলি ছিল অনেক দিন। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি ডেভিড গ্যারিক সাজতেন ম্যাকবেথ। আর তার দুশো বছর পরে লরেন্স অলিভিয়ের, বিপরীতে ভিভিয়েন লে। কুরোসাওয়ার ‘থ্রোন অব ব্লাড’-এ দুর্ধর্ষ তোশিরো মিফুনে, বিশাল ভরদ্বাজের ‘মকবুল’-এ ইরফান-তব্বু।

অনির্বাণের এই ছবিরও বড় সম্বল অভিনয়। ভেড়ির মালিক ডাবলু ভাইয়ের (ডানকান) চরিত্রে দেবেশ রায়চৌধুরী চমৎকার। বুনো বিড়ালের মতো চোখ টানতে বাধ্য ‘লাইলি’ সোহিনী সরকার, যদিও দিঘা উপকূলের টানটুন তাঁর জবানে ঠিক বসেনি। এই জবানই এ ছবির অন্যতম জান, অনভ্যস্ত কানে একটু খটোমটো বাজলেও। বাকিরা বেশির ভাগই কিন্তু বেশ সড়গড়। ‘মন্দার’ দেবাশিস মণ্ডলও তা-ই। খানিক তফাতে তিনি বেশ, তবে কাছে এলে ঈষৎ ফ্ল্যাট, ক্রোধের প্রকাশ কিছুটা মাত্রাও ছাড়ায়। তবে ম্যাকডাফের ছায়ায় গড়া মদন হালদার চরিত্রে দুর্দান্ত লোকনাথ দে। অনির্বাণের কথা আর আলাদা করে না-ই বা বললাম।

শেক্সপিয়রের নাটকে ডাইনি তিন জন। এখানে গোড়া থেকে দুই— মজনু বুড়ি আর কিশোর পেডো। আর তৃতীয় জন? ঘোর সন্দেহ হয় বাইরে থেকে আসা মিষ্টভাষী পুলিশ অফিসারটিকে (অনির্বাণ ভট্টাচার্য)। না হলে নামটি তার ‘মুকদ্দর’ কেন, যার মানে নিয়তি? কেন রক্তাভ সস মাখিয়ে তার ওই মাছ ভাজা চিবোনো বা বিড়াল নিয়ে ফস্টিনস্টি? কেন সে সাক্ষী থাকে সব কিছুর আর ফিসফাস খবর চালাচালি করে মন্দারদের এগিয়ে দেয় অমোঘ পরিণতির দিকে?

‌অনেকেরই মনে পড়বে, আঠারো বছর আগে মুক্তি পাওয়া ‘মকবুল’-এও ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা ‘ডাইনি’ ছিল পুলিশ। কিন্তু মুকদ্দর সম্পূর্ণ অন্য মাত্রার, অন্য উচ্চতার। আরও চমক লাগে যখন হাতের পেশি বা ক্লোজ-আপে চাঁছা-গোঁফের সুবাদে ক্রমশ স্পষ্ট হয় যে, মজনু বুড়ির চরিত্রে অভিনেতাটি পুরুষ (সজল মণ্ডল)। এবং খেয়াল হয়, মজনু তো প্রেমিক পুরুষেরই নাম! পেডোর (সুদীপ শুভম ধাড়া) ‘মা’ সে নয়। তিন ডাইনিই পুরুষ— অলক্ষে ডাকিনিতন্ত্রের চালু নারী আদলটাই খসে যায়।

তবে তার পরেও দু’একটি তেতো প্রশ্ন থাকে। যেমন, এত দূর যাঁরা ভাবতে পারেন দু’একটি অতিরেক তাঁরা সামলাতে পারেন না কেন? যেমন মাংস-পর্বের অনেকটা বা ঘরে মন্দারের বর্শা নিয়ে লাফঝাঁপ। কেন? দৃশ্যের মোহে? সহ-লেখক প্রতীক দত্ত রচয়িতাকে সতর্ক করতে পারতেন। বা সম্পাদক মশাই (সংলাপ ভৌমিক) খানিক কাঁচি চালালেও পারতেন।

আর এক ধন্দ একেবারে শিকড় নিয়েই। ম্যাকবেথের মূল নাট্য পাক খায় দু’টি শব্দ ঘিরে— ক্ষমতা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা। এ ছবিতে ডাবলু ভাই আছেন বটে, কিন্তু ভেড়ি শাসনের কুণ্ডলীচক্র প্রায় নেই। যৌন ক্ষমতা (বা অক্ষমতা) কি পুঁজি ও পেশির জোরে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার যথার্থ প্রতিকল্প? সন্তানের আকাঙ্ক্ষা কি উচ্চাকাঙ্ক্ষা বলে গণ্য হতে পারে? নাকি তা আসলে মূল প্রতিপাদ্যকেই দুর্বল করে, যাতে দুর্বল হয়ে পড়ে লেডি ম্যাকবেথ চরিত্রটিও?

আমরা মুখ্যুসুখ্যু পাবলিক অত বুঝি না, আমাদের কাছে ‘মন্দার’ শুধু মন্দের আভাস আনে। যেমন মন্দার বোস, মন্দা বৌঠান। অভিধান বলছে, ‘মন্দার’-এর অর্থ স্বর্গের পুষ্পবিশেষ, আর এক অর্থ মাদার গাছ।

যিনি যে ভাবে দেখবেন।

অন্য বিষয়গুলি:

review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy