গল্পের প্রেক্ষাপট বেগমপুর। আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত সে এলাকায় আতঙ্কে দিন কাটায় অখিলবন্ধু (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)। ফাইল চিত্র।
তখন কুয়াশা ছিল
পরিচালক: শৈবাল মিত্র
অভিনয়: সৌমিত্র, শাশ্বত, বাসবদত্তা, বরুণ
৭/১০
গত কয়েক বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত সমসময়ের রাজনীতিকেন্দ্রিক বাংলা ছবির নাম ভাবতে বসলে একটু কষ্ট করতে হবে। অনীক দত্তর ‘ভবিষ্যতের ভূত’ বা অনিকেত চট্টোপাধ্যায়ের ‘হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী’র মতো ছবিতে রাজনীতি থাকলেও, গল্প বলার মোড়ক রাজনীতি-নির্ভর ছিল না। সে দিক দিয়ে দেখলে, শৈবাল মিত্রর ‘তখন কুয়াশা ছিল’ আদ্যন্ত রাজনৈতিক ছবি। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ়ের ‘তখন কুয়াশা ছিল’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ছবিটি সমসময়ের রাজ্য-রাজনীতির জ্বলন্ত এক দলিল। ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে বাংলায় নির্বাচনকেন্দ্রিক হিংসার বাস্তব চিত্র থেকে হিটলার শাসনের ফুটেজ। ছবির অবস্থান স্পষ্ট করতে কোনও রকম আপসের পথে হাঁটেননি পরিচালক।
গল্পের প্রেক্ষাপট বেগমপুর। আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত সে এলাকায় আতঙ্কে দিন কাটায় অখিলবন্ধু (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)। ‘মাস্টারমশাই’ নামে এলাকায় পরিচিত অখিলের সঙ্গে থাকে তার দৌহিত্রী মৌ (বাসবদত্তা চট্টোপাধ্যায়)। পাড়ায় ‘নষ্ট মেয়ে’ বলে বদনাম রয়েছে তার। অখিলের এক ছাত্র পুটু (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়)। বেকার, চালচুলোহীন পুটুও এক সময়ে রাজনীতি করত। এখন সে হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজে বেড়ায়। আর এক ছাত্র শচীন (বরুণ চক্রবর্তী), ‘গলা-কাটা-শচীন’ নামে যে এলাকার ত্রাস।
মাস্টারমশাইয়ের চরিত্রে সৌমিত্রকে দেখলে, তপন সিংহের ‘আতঙ্ক’ ছবির কথা বলতেই হয়। তবে এই ছবিতে অখিলের লড়াই ভাল বনাম মন্দের নয়। ধর্মসঙ্কট তার দুই ছাত্রকে ঘিরে। সেখানে কে ‘ইভিল’, কে-ই বা ‘লেসার ইভিল’? ছবি তা স্পষ্ট করে দেয়নি। দর্শকের বিচারবুদ্ধির উপরে ছেড়ে দিয়েছেন পরিচালক।
ছবির প্রথম দৃশ্য থেকেই রাজনীতির কেন্দ্রে প্রবেশ করেন দর্শক। মাসকয়েক আগেই রাজ্যে নির্বাচনের সময়ে সংবাদপত্রে বা টেলিভিশনের পর্দায় যে ধরনের খবরের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন মানুষ, ছবির প্রতিটি ছত্রে যেন সেই স্মৃতির রোমন্থন। তবে ছবির গল্পের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে সংলাপ লেখা হয়েছে। রংবদল, পালাবদল, ‘বাংলা বাঁচাও পার্টি’র মতো উপমাগুলি কোথাও আরোপিত মনে হয়নি। দ্বিতীয়ার্ধে গল্প বলায় আবেগ প্রাধান্য পেয়েছে। তাতে ছন্দপতন হয়নি। তবে দু’-একটি জায়গায় ছবির গতি খানিক স্লথ হয়েছে।
মুখ্য চরিত্রে যে অভিনেতারা রয়েছেন, তাঁরা কখনও দর্শককে নিরাশ করেন না। এ ছবি আগাগোড়া শাশ্বতর। চোখের ভাষায়, ন্যূনতম অভিব্যক্তিতে তিনি যে কত কথা বলতে পারেন, তা দর্শক জানেন। সৌমিত্র ছবির অন্যতম স্তম্ভচরিত্র। বাসবদত্তার সৌন্দর্যে চিরন্তন বাঙালিয়ানা রয়েছে। পরিচালক তাঁকে যে ভাবে ছবিতে ব্যবহার করেছেন, তা তারিফযোগ্য। লণ্ঠন হাতে অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা যে কত ব্যঞ্জনাপূর্ণ হতে পারে, তা সংবেদনশীল দর্শক বুঝতে পারবেন। তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদারের আবহসঙ্গীত এবং অশোক দাশগুপ্তের ক্যামেরা ছবির দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে যথাযথ সঙ্গত করেছে। ছোট ছোট চরিত্রে অরুণ গুহঠাকুরতা, সোহাগ সেন, পার্থসারথি দেব, অঙ্কিতা মজুমদার, তন্নিষ্ঠা সিংহের অভিনয় সুন্দর।
পরিচালকের কাছে একটি অভিযোগ, শচীনের চরিত্রে বরুণ চক্রবর্তীকে আরও বেশি ব্যবহার করতে পারতেন। বিশেষত, যে দৃশ্যে সে ‘কমন ম্যান’ হয়ে ওঠার কথা বলে, তা যেন তার বোধোদয়ের দ্যোতক হয়ে ওঠে না। কারণ গোটা ছবিতে শচীন নিয়ে অন্যরা যত বেশি বলে, ততটা তাকে ছবিতে দেখা যায় না। শচীনের চরিত্রাভিনেতাকে যদি একেবারেই দেখানো না হত, তবে তা অন্য প্রসঙ্গ ছিল।
বিষয়বস্তুর সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতার নিরিখেও অনেক ছবি এগিয়ে থাকে। বাংলার আকাশে যত দিন রাজনীতি কুয়াশাচ্ছন্ন থাকবে, তত দিন অবধি সে অচলায়তনের ‘জগদ্দল’ পাহাড়কে ধাক্কা দেবে এই ছবি। আশা জাগাবে, কুয়াশামুক্ত এক ফালি রোদের!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy