উত্তরণের রক্ত গরম করে দেওয়া ইতিহাস জীবন্ত করে তোলে ‘গোলন্দাজ’।
ফুটবল নিয়ে গল্প। ইংরেজ-শাসিত পরাধীন ভারতের প্রেক্ষাপটে এ কাহিনি বাঙালির সংস্কৃতি, আবেগ, লড়াইয়ের। প্রতিদিন হেরে যাওয়া, অপমান আর অবহেলার আগুনে ঝলসে মরা বাঙালির তলানিতে ঠেকা আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার কাহিনি। সেই উত্তরণের রক্ত গরম করে দেওয়া ইতিহাস জীবন্ত করে তোলে ‘গোলন্দাজ’। ব্রিটিশের তাচ্ছিল্য, কটাক্ষ, এ দেশের মানুষকে অপদার্থ ভাবার দম্ভকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার ইতিহাসে কখনও যে ফুটবলও হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল, সেই বিশ্বাস ও তৃপ্তি দেয় এই ছবি।
গোলন্দাজ ছবির পরিচালক ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়। সংলাপে সহযোগিতা করেছেন অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য। ছবির প্রযোজনায় এসভিএফ। তাদের অন্য ছবিগুলির মাথা রেখেও বলা যায় ‘গোলন্দাজ’ এক অন্য ধাতুতে গড়া মাইলফলক। শুধু বিষয়ের নিরিখে নয়, উপস্থাপনার দৃষ্টিকোণ থেকেও।
প্রতিবাদ সর্বাধিকারী পরিবারের রক্তে। সেই শিক্ষিত মননশীল বাড়ির ছেলে নগেন্দ্রপ্রসাদ। তাঁর রক্তে-মজ্জায় বিশ্বাস, খেলার মাঠ মানুষকে বাঁধে, ভাঙে না। যে ক্রীড়া সংস্কৃতি নিয়ে ইংরেজদের এত অহঙ্কার, তাতেই আঘাত হানলেন তিনি। বেছে নিলেন এক অসম্ভব লড়াই। আর সে ভাবেই জাতি-ধর্ম-শ্রেণির বৈষম্যকে হেলায় অস্বীকার করে, অত্যাচারী ইংরেজদের চক্ষুশূল হয়েও গড়ে তুললেন এক নতুন ইতিহাস। সে ইতিহাসে মিশে ছিল স্বাধীন ভারতের স্বপ্নও। ঠিক এই জায়গাতেই কিংবদন্তি পুরুষ নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী।
কে এই নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী? কতটা পরিচিত মানুষ এই নামটার সঙ্গে? তাঁর সাহসিকতা, তাঁর বিপ্লব, তাঁর নেতৃত্বদানের অসামান্য দক্ষতা এবং ফুটবলের প্রতি নিরন্তর সাধনা খুব সামান্যই প্রচারের আলো পেয়েছে। তাঁর নাম না জানাটা তাই দুর্ভাগ্যের, কিন্তু লজ্জার নয়। নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী বাংলা তথা ভারতীয় ফুটবলের জনক। তিনিই বুঝিয়েছিলেন, শুধু খালি পায়ে ফুটবল খেললেই হবে না। চাই সঠিক পরিকাঠামো, দরকার নিয়মিত অনুশীলন। আর প্রয়োজন দলবদ্ধ হওয়া। তার জন্য চাই একে অপরের প্রতি বিশ্বাস এবং নাছোড়বান্দা মনোভাব।
নগেন্দ্রপ্রসাদের হাতেই গড়ের মাঠে জন্ম ওয়েলিংটন ক্লাবের, খোদ ইংরেজদের ক্লাবের তাঁবুর পাশেই। ১৮৮৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন শোভাবাজার ক্লাব। সাহস বা আবেগ থাকলেও শুরুর দিককার বেশ কিছু খেলায় হার মানতে হয়েছিল খুনে মানসিকতার অভাবে। জেদ চেপে যায় তাতেই। ১৮৯২ সালে শক্তিশালী ইংরেজ ক্লাবকে হারিয়ে দেয় শোভাবাজার। বাঙালিও বুঝতে শেখে, বিশ্বাস করতে শেখে— তারাও জিততে পারে। ফুটবলের মতো খেলায় তারাও হারাতে পারে বিদেশিদের। ১৯১১ সালের আগে মোহনবাগানের শিল্ড জয়ের আগে এটাই কোনও বাঙালি ক্লাবের সবচেয়ে বড় সাফল্য।
বাঙালির ফুটবল নিয়ে অসম্ভব উন্মাদনা এক দীর্ঘ সময়ের সফর। কিন্তু এর শুরু কোথায়? কী ভাবে? এই ভুলে যাওয়া ইতিহাসের টগবগে নাটকীয়তার সঙ্গে ‘আত্মবিস্মৃত বাঙালি’র পরিচয় ঘটাবে “গোলন্দাজ”। পরিচালক ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখ দিয়ে দেখা নগেন্দ্রপ্রসাদের জীবনের নানা ঘটনার দুর্দান্ত বুনোট উপহার দেবে এই ছবি। ব্রিটিশ শাসনে নিজস্বতা হারানো, অস্তিত্বের চরম সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়ানো মানুষ শুনেছিল নগেন্দ্রপ্রসাদের দৃঢ়চেতা শপথ – “মরে যাব, কিন্তু হেরে ফিরব না”। ইংরেজদের সঙ্গে খেলা তখন আকাশকুসুম স্বপ্ন। তাদের মাঠে নামলেই যে বাঙালিকে চাবুক খেতে হতো, সেখানে নগেন্দ্রপ্রসাদ শুধু সম-মর্যাদা দাবি করে ক্ষান্ত থাকেননি। সবুজ ঘাসে ঘাম ঝরিয়ে সম্মান ছিনিয়ে এনে প্রমাণ করে দিয়েছেন, কোথায় তিনি শ্রেষ্ঠ। তিনি ঠিক কতটা আলাদা অন্য সকলের থেকে।
“গোলন্দাজ” এর আর এক বড় আকর্ষণ বিক্রম ঘোষের সঙ্গীত। তাঁর তালবাদ্যের প্রয়োগ ও আবহ ছবির দৃশ্যগুলিকে সমৃদ্ধ করে। অনবদ্য কাজ করেছেন তিনি। ইতিহাস-নির্ভর ছবির গল্প এবং চিত্রনাট্যর পাশে কী ভাবে সমান্তরালে সঙ্গত করে যেতে হয়, সেই মুন্সিয়ানা দেখিয়ে দিয়েছেন বিক্রম। ছবির গীতিকার শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুগত গুহ।
অনবদ্য এ ছবির ক্যামেরার কাজও। চরম নাটকীয় মূহূর্ত থেকে চরিত্রদের আবেগ আলাদা ভাষা পায় আলো-আঁধারির খেলায়। আলোর ব্যবহারে ছবি জুড়ে যেন কবিতা বুনেছেন চিত্রগ্রাহক সৌমিক হালদার।
এ ছবির একটি বড় চমক নরেন্দ্রপ্রসাদের বাবা সূর্যকুমার সর্বাধিকারীর চরিত্রে গায়ক শ্রীকান্ত আচার্যর অভিনয়। ছবিতে নগেন্দ্রপ্রসাদের চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন দেব। সম্ভবত তাঁর জীবন অন্যতম সেরা। এমন এক বিরল যুগপুরুষের চরিত্রে অভিনয় করতে তিনি যে ভাবে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন, তার প্রতিফলন প্রতিটি দৃশ্যেই ফুটে উঠেছে। শোভাবাজারের রানি, নগেন্দ্রপ্রসাদের স্ত্রী কমলিনীর ভূমিকায় ইশা সাহার অভিনয়ও দর্শকদের মনে ছাপ ফেলতে বাধ্য। সীমিত পরিসরে তাঁর সংলাপ ও ভঙ্গিমা চরিত্রটিকেও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। তেমনই সাবলীল অভিনয় পদ্মনাভ দাশগুপ্তর, রাজা আনন্দকৃষ্ণ দেব এর ভূমিকায়।
ভার্গব নামে এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর চরিত্রে অনির্বাণ ভট্টচার্য যথারীতি প্রত্যাশা পূরণ করেছেন। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে নানা সময় হরেক ছদ্মবেশ ধারণ করে আসা অনির্বাণের দৃশ্যগুলি গোটা ছবিটিই এক নতুন প্রাণ সঞ্চার করে। নতুন মোড় আসে গল্পে।
‘গোলন্দাজ’ ছবিটিতে চরিত্রের সংখ্যা অনেক। প্রসন্নকুমারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন পরিচালক –অভিনেতা জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। নগেন্দ্রপ্রসাদ ছিলেন তাঁর সন্তানসম। নরেন্দ্রপ্রসাদের মা তথা সর্বাধিকারী পরিবারের বধূর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তুলিকা বসু। ইংরেজদের সুবিধাভোগী এক ঘাতকের চরিত্রে দেবরঞ্জন নাগও চমৎকার। ভাল কাজ করেছেন উজান চট্টোপাধ্যায়, অনির্বাণ শিকদার, বিশ্বজিৎ দাস, অমিতাভ আচার্য-রাও।
ইতিমধ্যে ইউ টিউবে ‘গোলন্দাজ’-এর প্রচার-ছবি দেখে আমির খানের ‘লগান’-এর সঙ্গে তুলনা টানতেই পারেন কেউ কেউ! এ সব অনুমান সরিয়ে রেখে ছবিটি দেখে আসাই বরং ভাল। তাই নয় কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy