Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Chalchitra Ekhon Film Review

অঞ্জন দত্তের শ্রদ্ধার্ঘ্যে ‘চালচিত্র এখন’ যেন সময়কে অতিক্রম করা এক জাদু

অঞ্জন দত্তের সিনেমায় গান নিয়ে একটা প্রত্যাশা থেকেই যায়। ‘একটা দিন’, ‘এই পোড়া শহর’ কোথাও যেন মৃণাল সেনের ছবির কথার প্রতিধ্বনি।

Review of Bengali film Chalchitra Ekhon directed by Anjan Dutta

‘চালচিত্র এখন’ ছবির একটি দৃশ্যে সুপ্রভাত দাসের সঙ্গে অঞ্জন দত্ত। ছবি: সংগৃহীত।

পায়েল বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ মে ২০২৪ ১৮:৫৮
Share: Save:

বহু দিন পরে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, সিনেমাহল থেকে ওটিটি মঞ্চ, এমনকি বং-ডায়াস্পোরার মধ্যে সাড়া ফেলে দিয়েছে মৃণাল সেনের জন্মশতবার্ষিকীতে অঞ্জন দত্তের শ্রদ্ধার্ঘ্য ‘চালচিত্র এখন’! ভারতীয় চলচ্চিত্রে স্বাভাবিকতাবাদী চলচ্চিত্র ধারার নির্মাতা মৃণাল সেনের মতো ‘নাম’-এর চরিত্রায়ণ! তাঁর ছবি ‘চালচিত্র’ এবং সেই ছবির মূল কুশীলব ও বর্তমান ছবির পরিচালক অঞ্জন দত্তের নস্ট্যালজিয়া— সবটা নিয়ে হাইপ তৈরির যথেষ্ট উপকরণ ট্রেলারেই মজুত ছিল। ছবিতে আমাদের মতো ফেসবুকি দুনিয়ায় মেরুবিভাজিত সাধারণ মানুষ দেখতে পেল, চরিত্র থেকে সিনেমার ফরম্যাটে কতকটা এক রকম, মানে অগোছালো-ইরেস্পন্সিবল-ছকভাঙা-ডোন্ট কেয়ার মৃণাল-অঞ্জনকে, ভীষণ রকম আলাদা (সমষ্টি বনাম ব্যক্তি) দু’টি বিপরীত সত্তার সুন্দর ও সৎ সহাবস্থানকে। সিনেমা তৈরি থেকে পর্দার বাইরের এ জীবন্ত গল্পে তাই উহ্য থেকে যায় সময়।

সিনেমা নিয়ে ‘কে বলছে’ এবং ‘কী বলছে’, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ‘বায়োপিক’, ‘ট্রিবিউট’, ‘সিনেম্যাটিক অবিচুয়ারি’— শব্দগুলির পাশ কাটিয়ে ‘চালচিত্র এখন’ দূর থেকে দেখা অঞ্জনের লেন্সে বছর ২৬-এর তরুণ (ছবির রঞ্জন দত্ত) আর তার ৫৮-র মেন্টর (ছবির কুণাল ওরফে মৃণাল সেন)-এর জায়মান বন্ডিংয়ের গল্প। যে মৃণাল সেনকে আমরা চিনি না বা দেখিনি, তাকে হিউমারাসলি রিপ্রেজেন্ট করার গল্প। যেখানে অভিনেতা অঞ্জন দত্ত ম্লান হয়ে যান কালো চশমার গায়ক ইমেজের আড়ালে, ফিকে হয়ে যায় তাঁর ঝকঝকে-স্মার্ট-কেতাবি থিয়েটারি অতীতের গল্প। ছোট ছোট ‘গল্পের মধ্যে গল্প’-এর চলন আখ্যানকে গতি দিয়েছে। তবে গোটা আখ্যানের উপর চাঁদোয়ার মতো পড়ে থেকেছে আমাদের শহর কলকাতা। ছবির প্রথম দিকে মৃণাল সেনের সংলাপ( “আই হেট ক্যালকাটা, আই লাভ ক্যালকাটা/ আই অ্যাম এক্সাইটেড অ্যাবাউট ক্যালকাটা/ আই অ্যাম ডিজ়অ্যাপয়েন্টেড অ্যাবাউট ক্যালকাটা/ ক্যালকাটা ইজ় মাই এলডোরাডো”)-এ বা অঞ্জন দত্তের গান (‘এ পোড়া শহরে’)-এ, এমনকি শেষ দৃশ্যে, “কেমন লাগছে শহর‍টা?”— প্রশ্নের উত্তরে সিনেমার রঞ্জনের (শাওন চক্রবর্তী) “দারুণ”টুকুর প্যাশনেট এক্সপ্রেশনে।

বায়োপিকে ‘ইমিটেট’ সে ভাবে সম্ভব নয় বলে ‘লুক’ ব্যাপারটাকে ‘অ্যাটিটিউডে’ উড়িয়ে অবিকল মৃণাল সেন হয়ে উঠেছেন অঞ্জন। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, কালো মোটা ফ্রেমের চশমা আর সিগারেটের জ্বলন্ত ধোঁয়ায় মোড়া আদ্যোপান্ত জঙ্গম বাঙালি ‘মৃণাল সেন’কে ইন্টেলেকচুয়াল অহং বিবর্জিত সহজ অথচ প্রত্যয়ী করেছেন তিনি। কয়েকটা শটে বোধ হয় জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয় করেছেন অঞ্জন। যেমন শুটিংয়ের ফাঁকে এক জায়গায় রঞ্জনকে (‘চালচিত্র’-এর দীপু) জীবনের গল্প বলছেন কুণাল সেন! (“সাইকেল করে যাচ্ছি যাচ্ছি, রোদ্দুরের মধ্যে যাচ্ছি যাচ্ছি যাচ্ছি। যাচ্ছি আর ফিরে আসছি! তার পর একদিন আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজেকে কমপ্লিট উলঙ্গ দেখে মনে হল, সিনেমা বানাবে তুমি! তুমি!”) স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণার সুর গলায় এনে মুহূর্তেই নেতিবাচক আত্মসমালোচনায় ভেংচি কেটে “ঘণ্টা বানাবে তুমি”-র অভিব্যক্তি স্তম্ভিত করে দেয় দর্শককে। ঘোর কাটতে না কাটতে যন্ত্রণার অনুষঙ্গে মিলিয়ে দেন রঞ্জনের আত্মদর্শনের থিয়েট্রিক্যাল ভাষাকে! এটাই তো ‘নিজেকে নিজের চুল ধরে হেঁচড়ে টেনে দাঁড় করানো, নিজেকে ওলটপালট করে ঝাঁকানো, তার পর গোটা পৃথিবীটাকে তরতাজা দৃষ্টিতে দেখার ‘বাস্তব নির্মাণ’! শেষ দিককার একটা সিনে কুণাল বোঝাচ্ছেন, যে শটে ক্যামেরার কন্ট্রিবিউশন ৫০ শতাংশ, এডিটিং দেয় ৩০ আর মিউজিক ২০, সেখানে অভিনেতার কিছু না করাটাই শটটাকে বাঁচিয়ে দেয় আর ক্যামেরা তখন আস্তে আস্তে বড় ফ্রেমে ধরছে দু’জনকে! ঠিক এইখানেই পরিচালক অঞ্জন দত্তের পার্সপেক্টিভ মারাত্মক। কমিউনিস্ট-হিপোক্রিট-গিমিক, সব কাটাছেঁড়ার ঊর্ধ্বে উঠে শিল্পী মৃণাল সেন আসলে শিল্প ও সৃষ্টির সারকথা ‘হয়ে ওঠা’র দর্শনের প্রতিবিম্ব। শিল্প ও সমাজের প্রতি এই কমিটমেন্ট অতুলনীয়।

Review of Bengali film Chalchitra Ekhon directed by Anjan Dutta

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

ছবিতে রঞ্জনের চরিত্রাভিনেতা শাওন চক্রবর্তী সম্পর্কে যে কোনও প্রশংসা যেন কম পড়ে। ‘চালচিত্র’-এর অঞ্জন দত্ত হয়ে উঠতে রীতিমতো হোমওয়ার্ক করেছেন বোঝা যায়। চলা-বলা, তাকানো, রুক্ষ-কর্কশ এক্সপ্রেশন থেকে কান্নায় ভেঙে পড়ার দৃশ্যে নিজেকে যন্ত্রণায় দুমড়ে-মুচড়ে নিংড়ে দিয়েছেন তিনি। গীতা সেনের ভূমিকায় বিদীপ্তা চক্রবর্তী বা গোকুলের ভূমিকায় শুভাশিস যথাযথ। নতুন ছেলেমেয়েরা সকলে উজ্জ্বল। মহাজন ওরফে মাধবনের ভূমিকায় সুপ্রভাত দুর্দান্ত। টানটান সম্পাদনার গুণে ছবির কোনও অংশকে বাড়তি মনে হয়নি। তবে সত্তরের দশকের কলকাতাকে খুঁজতে বেগ পেতে হবে দর্শককে। শহরের ভিস্যুয়াল নির্মাণের ক্ষেত্রে আর একটু সচেতন এবং যত্নশীল হতে পারতেন পরিচালক।

অঞ্জন দত্তের সিনেমায় গান নিয়ে একটা প্রত্যাশা থেকেই যায়। ‘একটা দিন’, ‘এই পোড়া শহর’ কোথাও যেন মৃণাল সেনের ছবির কথার প্রতিধ্বনি। আপাত ভাবে মনোটোনাস লাগলেও সর্বশেষ ইংরাজি গান ‘অল আই হ্যাভ টু ডু’ অঞ্জনের মাস্টারস্ট্রোক।

সময়কে ব্যাকড্রপে রেখে সৃষ্টির ক্ষেত্রে স্রষ্টার আত্মসমালোচনা সব সময় আধুনিক পদক্ষেপ। নিজেকে পশ্চাৎপক্ক বলাটা অবশ্য এ ছবির অঞ্জন দত্তের ক্ষেত্রে জাস্টিফায়েড নয়। কাম্যু বা সার্ত্র্‌না-পড়া সাধারণ জীবনকে যখন বুঝতে শিখছে রঞ্জন, তখন তার কঠিন ব্যক্তিত্বে একটা মোলায়েম পরত পড়েছে ইতিমধ্যেই। জীবনকে ‘দেখা’র বদল এক ধরনের আশাবাদকে প্রশ্রয় দেয়। ব্লকবাস্টার যুগের হিজিবিজি কন্টেন্টের মধ্যে এই প্রাপ্তি মন্দ নয়। এমন একটা মাইলস্টোন কাজের জন্য অঞ্জন দত্তকে অভিনন্দন জানাই।

অন্য বিষয়গুলি:

Film Review Anjan Dutt New Bengali Film
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy