রাষ্ট্র বনাম দেশের মাটি, ইতিহাসের নির্মিত তথ্য বনাম সত্য, পুরুষের তৈরি নির্মাণ বনাম মেয়েদের নিজস্ব লৌকিক বয়ান, পুঁথিগত পড়াশোনা বনাম মাঠের বাস্তব, ক্ষমতা বনাম ক্ষমতাহীনতা— এই সবগুলি বিরোধ ছবিতে উঠে আসে খুব সাবলীল ভাবে, কোথাও দর্শকের উপভোগ্যতাকে আঘাত না করে।
'মহানন্দা' ছবির একটি দৃশ্য।
মহানন্দা একটি নদীর নাম। একটি মেয়েরও নাম। নিছক জীবনযাপন নয়; গভীর চলাকে গোপন না রেখে বয়ে চলা, মোহনার অপার লক্ষ্যে যাত্রা করা তার কাজ। মহাশ্বেতা দেবীর জীবনের আধারে অরিন্দম শীল -এর ‘মহানন্দা’ যথার্থ অর্থে একটি রাজনৈতিক ছবি। রাজনৈতিক, কিন্তু দলীয় ছবি নয়।
বিরসা মুণ্ডার বিদ্রোহী জীবন,এক আদিবাসী বিপ্লবীকে রাষ্ট্রের হত্যা আর ‘উলগুলান এর মরণ নাই’ সংলাপে ছবির শুরু। রাষ্ট্রীয় হননে মৃত আদিবাসীর ভুয়ো ডেথ সার্টিফিকেটে সিলমোহরের পর অমোঘ মুহূর্তে আসে আদিবাসী গান। যে গানের পংক্তিতে ভাসে, ‘এ ধরণীর পিতা’র প্রতি ভালবাসা। আসে নাগরিক ভারতে গণনাট্য আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টির সূচনা, স্বপ্ন ও হেনস্থার আখ্যান। তথ্যের প্রতি অনুগত থেকে চরিত্রের কাল্পনিক (কখনও প্রতীকী) নামের আড়ালে আমরা চিনে নিতে পারি মহাশ্বেতা ঘটক (ছবিতে মহানন্দা) ও বিজন (ছবিতে বিধান) ভট্টাচার্যের যৌথ জীবন, দাম্পত্য ও তার ভাঙনকে।
আসে দলীয় সাম্যবাদের স্বপ্নভঙ্গের আখ্যান। রাষ্ট্র বনাম দেশের মাটি, ইতিহাসের নির্মিত তথ্য বনাম সত্য, পুরুষের তৈরি নির্মাণ বনাম মেয়েদের নিজস্ব লৌকিক বয়ান, পুঁথিগত পড়াশোনা বনাম মাঠের বাস্তব, ক্ষমতা বনাম ক্ষমতাহীনতা— এই সবগুলি বিরোধ ছবিতে উঠে আসে খুব সাবলীল ভাবে, কোথাও দর্শকের উপভোগ্যতাকে আঘাত না করে। তার প্রধান কারণ চিত্রনাট্যকার ও পরিচালকের নিটোল গল্প বলার ক্ষমতা এবং তার সঙ্গতে শক্তিশালী চিত্রগ্রহণ ও সম্পাদনার কাজ। ছবিকে অন্য এক আলো দিয়ে ভরে রেখেছে বিক্রম ঘোষের অনবদ্য সঙ্গীতরচনা। নিজের শিল্পীজীবনে বাংলার আদিবাসীদের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গবেষণার কাজ করে আসা বিক্রম দাপটের সঙ্গে রেখে যান মাটির ঘ্রাণ। অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে ব্যবহার করেন পরিমিত আধুনিক সাঙ্গীতিক গড়ন। সমস্ত ক্ষয় আর সংশয়ের বিপরীতে পরিচালক অরিন্দম শাশ্বত প্রতীকের মতো ব্যবহার করেন মহাশ্বেতার পড়ুয়াবেলার শান্তিনিকেতন আশ্রমকে। আর ব্যবহার করেন রবীন্দ্রনাথের গানকে। ব্যক্তিগত ও আদর্শগত পথ আলাদা হওয়ার আবহে অমোঘ ভাবে আসে সাহানা বাজপেয়ীর মেধাবী স্বরে ‘আমার এ পথ’ গানটি। গানটির সঞ্চারীকে নিপুণ সৌকর্যে ব্যবহার করেন বিক্রম। যখন সত্যিই বিশ্বাসভঙ্গে আমাদের পায়ে পায়ে শ্রান্তি লাগে, সেই মুহূর্তে নির্দিষ্ট সময়কালের সীমা পেরিয়ে এই ছবি হয়ে ওঠে সর্বকালের।
ছবিতে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মহানন্দার (মহাশ্বেতা) চরিত্রে গার্গী রায়চৌধুরীর অভিনয়। যে মানুষ সেদিনও আমাদের চোখের আলোয় ছিলেন, তার চরিত্রের গাঢ় আর দুরূহ বাঁকগুলি গার্গী ধরেছেন অত্যন্ত গহীন বিশ্বাসে আর আধুনিক অভিনয়ে। বাংলা ছবিতে অনেক দিন পর এত অনুচ্চ অথচ উচ্চ মানের অভিনয় দেখবেন দর্শক। তার পাশে কখনও ম্লান হয়ে যায় দেবশঙ্কর হালদার বিধান (বিজন) ভট্টাচার্যের ভূমিকা। তাঁর মুখে জগাখিচুড়ি বাঙাল ভাষা কানে আঘাত করেছে।
ভাল অভিনয় করেছেন বিহানের ভূমিকায় অর্ণ মুখোপাধ্যায়, মহালের চরিত্রে ইশা সাহা। রূপসজ্জায় সোমনাথ কুণ্ডুর অসাধারণ কাজে মুগ্ধ হবেন দর্শক। বিশেষত জমি আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ধর্ষিত ও অগ্নিদগ্ধ মেয়ে মানসীর পোড়া শরীরের মেকআপ শিউরে ওঠার মতো। কিন্তু অরণ্যগভীরে আদিবাসী নাচে নীল ব্লাউজ, নীল আঁচল আর সোনালি গয়না খুব ‘সাজানো’ মনে হয়েছে। মৃণাল সেনের ‘মৃগয়া’ বা সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’-এ পোশাক পরিকল্পনায় যদি বিশ্বস্ত বাস্তবতার প্রতি আনুগত্য থাকে, তা হলে এ রকম একটি সিরিয়াস ছবিতে তা কেন থাকবে না? সেই প্রশ্ন জাগে। বিশেষত যখন প্রান্তবাসী মানুষের অধিকার এই ছবির মৌল আধার।
গণনাট্যের নাটক ‘নবান্ন’ থেকে সাম্প্রতিক কালের নন্দীগ্রাম, সবই উঠে এসেছে ছবিতে। মহাশ্বেতার ‘অরণ্যের অধিকার’, ‘হাজার চুরাশির মা’-র বিষয় ভাবনা পিরিয়ড পিসের মতো ব্যবহার করেছেন পরিচালক। এর সবটাই এসেছে ‘সিরিয়াস’ ছবির দাবি মেনে। তর্ক হবে এই ছবি নিয়ে। অবশ্যই হোক। এই ছবি আমাদের ভাবায়। যাদের হাতে ক্ষমতা আছে আর যাদের হাতে ক্ষমতা নেই— এই দু’টি শ্রেণির কথাই ঘুরেফিরে আসে ভাবনায়। ছবিটির রেশ থেকে যায় অনেক ক্ষণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy