যখনই নতুন কাজটাকে কঠিন বলে মনে হত, আরতি ভাবতেন পারিশ্রমিকের কথা। তখন মাসে মাসে সাতশো টাকা তাঁর কাছে ছিল কুবেরের ভাণ্ডার।
নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৫:২৭
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
শুধু নামই নয়। জীবনযাপনেও তিনি ছিলেন ‘শেফালি’ বা শিউলি ফুলের মতোই। সকাল এগোতেই যেমন শিউলি ঝরে যায়, ঠিক তেমন তাঁকেও সবাই ভুলে যেত রাত ফুরোলেই। রাতের তারা ‘মিস শেফালি’ আড়ালে চলে যেতেন দিনের ভদ্র ও সামাজিক ‘আলো’র।
০২১৯
কে আর রাতজাগা বারের ক্যাবারেরানি ‘মিস শেফালি’ হতে চায়? চায়নি পাঁচ বছরের আরতি দাসও। ছ’মাসের আরতিকে নিয়ে দেশভাগের কয়েক বছর আগে কলকাতায় এসেছিলেন তাঁর বাবা-মা। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরতির চারপাশে শুধু কঠোর অনটন। চিরশয্যাশায়ী বাবা। লোকের বাড়ি থেকে কাজ করে মা ঘরে ফিরলে তবেই দু’টো খাবার জুটত ভাইবোনদের।
০৩১৯
স্বাধীনতা আসতে তখনও কয়েক বছর বাকি। কলকাতার রাস্তায় তখনও লাল পাগড়ি পরা পুলিশ। সাহেবপাড়ার বাড়িগুলিতে সন্ধ্যা নামতেই তখন জমে উঠত পার্টি। পর্দার ফাঁক থেকে দেখত এগারো বছরের আরতি। চৌরঙ্গির এক ফিরিঙ্গি বাড়িতে সে ঘরের টুকিটাকি কাজের জন্য বহাল হয়েছিল যে।
০৪১৯
পার্টির লোভনীয় খাবারের থেকেও আরতির নজর আটকে যেত মেমসাহেবদের নাচের ছন্দে। অপলকে দেখত আর নিজে নিজে মহড়া দিত। একদিন আরতি দেখল সে নিজে নিজেই বেশ পারছে। অনেক রকম নাচ তুলে নিয়েছিল সে। নাম জানত না। কিন্তু নাম না জেনেও তো নাচা যায়।
০৫১৯
সে বাড়ির পার্টিতে নিয়মিত আসতেন জনৈক ভিভিয়েন হ্যানসেন। তিনি পার্ক স্ট্রিটের ‘মোক্যাম্বো’ রেস্তরাঁয় গান গাইতেন। একটা ভাল কাজ দেখে দেওয়ার জন্য হ্যানসেনকে প্রায়ই বলতেন আরতি। একদিন কপালে শিকে ছিঁড়ল। গোপনে ধর্মতলায় দেখা করলেন দু’জনে।
০৬১৯
আরতিকে নিয়ে হ্যানসেন গেলেন চৌরঙ্গির ‘ফারপোজ’-এ। হ্যানসেনের সুপারিশে কাজ পেলেন আরতি। মাসিক বেতন ঠিক হল ৭০০ টাকা। তার আগে আরতিকে পরতে দেওয়া হল শাড়ি আর উঁচু হিলের জুতো। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলেন আরতি। কিন্তু বুঝলেন, অনভ্যাসকেই এ বার অভ্যাসে পরিণত করতে হবে।
০৭১৯
যখনই নতুন কাজটাকে কঠিন বলে মনে হত, আরতি ভাবতেন পারিশ্রমিকের কথা। তখন মাসে মাসে সাতশো টাকা তাঁর কাছে ছিল কুবেরের ভাণ্ডার। যে পরিবারের মুখ চেয়ে এই কৃচ্ছ্রসাধন, তাকেই অস্বীকার করতে হয়েছিল লালবাজারে গিয়ে। পুলিশ অফিসারের সামনে গিয়ে বলতে হয়েছিল, তিনি অনাথ। না হলে লাইসেন্স পাবেন কী করে!
০৮১৯
কাঠখড় পুড়িয়ে হাতে এসেছিল লাইসেন্স। প্রতি রাতে বার-নর্তকী হওয়ার ছাড়পত্র। কাগজেকলমে ছাড়পত্র পেলেও মনের সায় আসতে সময় লেগেছে অনেক। দর্শকদের সামনে আসার আগে চলেছে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ।
০৯১৯
সেই প্রশিক্ষণেই দেওয়া হয়েছিল পোশাক। যা পরে প্রতি রাতে নাচতে হবে। দেখে অঝোরে কেঁদেছিলেন আরতি। এতটা নিরাবরণ হয়ে আসতে হবে রাতের আসরে! ধীরে ধীরে একদিন সেই লজ্জাটুকুও ভুলে গেলেন। মন দিলেন অনুশীলনে।
১০১৯
বুঝতে পেরেছিলেন, পার্টির নাচ দেখে নিজে নিজে নাচা একরকম। আর, পারফর্ম করা সম্পূর্ণ অন্যরকম। জানতে হল পশ্চিমী নাচের ব্যাকরণ। প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে একদিন উদ্বাস্তু আরতি দাসের পায়ে উঠে এল ক্যান ক্যান, চার্লসটন, টুইস্ট, হাওয়াইয়ান হুলা এবং বেলি ডান্স।
১১১৯
এখানেই শেষ নয়। হতে হল ইংরেজি আর হিন্দিতে চোস্ত। জানতে হল আদবকায়দা। শিখতে হল পোশাকের সঙ্গে মানানসই মেকআপ। সঙ্গে ছিল কঠোর শরীরচর্চা। মেনে চলতে হত খাওয়াদাওয়া নিয়ে কড়া রুটিন। একমাত্র ফলের রস খাওয়ায় কোনও বাধা ছিল না।
১২১৯
নিজেকে যখন আমূল বদলে ফেললেন, নামই বা বাকি থাকে কেন! ‘আরতি’ মুছে গিয়ে নতুন পরিচয় হল ‘মিস শেফালি’। তখন কলকাতা থেকে ক্রমে বিদায় নিচ্ছেন বিদেশি নর্তকীরা। তাঁদের শূন্যতা ভরাট করার দায়িত্ব এসেছিল মিস শেফালির উপরেই।
১৩১৯
শূন্যতা পূর্ণ করে মিস শেফালি-ই হয়ে উঠেছিলেন রাতের কলকাতার মূল আকর্ষণ। ‘ফারপোজ’-এ মুগ্ধতা তিনি বয়ে নিয়ে গেলেন ‘ওবেরয় গ্র্যান্ড’-এও। সতেরো বছর সেখানে তিনি ছিলেন ক্যাবারেরানি। সেই সত্তরের দশকে মিস শেফালি ওবেরয় গ্র্যান্ডের প্রিন্সেস ডিস্কোর স্টার ডান্সার। রাতের কলকাতা সম্মোহিত তাঁর নামে। থিয়েটারে যোগ দেওয়ার পর হেসেখেলে মাসে ২০-২২ হাজার টাকা রোজগার করতেন।
১৪১৯
তার মাঝেই এল সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ফিল্মে কাজ করার সুযোগ। নামের পাশে বসল ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ এবং ‘সীমাবদ্ধ’তে কাজের অভিজ্ঞতা। বড় পর্দায় অভিনয়ের পাশাপাশি এল থিয়েটার। তরুণকুমারের উদ্যোগে মঞ্চেও দেখা গেল মিস শেফালিকে। এমন সময়ও গিয়েছে, যখন মিস শেফালির নামে বিক্রি বাড়ত টিকিটের।
১৫১৯
শুধু ক্যাবারেই নয়। ব্যক্তিগত জীবনও ছিল রাজসিক। ওবেরয় গ্র্যান্ডে মিস শেফালির নিজস্ব সুইট ছিল। আর সার্কাস এভিনিউতে মহার্ঘ্য ফ্ল্যাট। মাঝ দুপুরে ঘুম থেকে উঠে সেখানে সুদৃশ্য খাবার টেবিলে বসতেন শেফালি। পরিচারিকা দুর্গা সাজিয়ে দিতেন কড়া করে ভাজা পাকা পোনামাছের টুকরো।
১৬১৯
শেষ জীবনেও তাঁর কাছে ছিলেন দুর্গা। তখন সব বিলাসিতা বিদায় নিয়েছে। অতীতের রানি মিস শেফালি তখন উত্তর শহরতলিতে ছোট্ট ফ্ল্যাটবন্দি। যেখানে সূর্যের আলো, আর আর্থিক সচ্ছলতা, দু’য়েরই প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। একসময় কোনওদিন হিসেব করে টাকা দেননি। জীবনের উপান্তে এসে তাঁকেই কুরে কুরে খেয়েছে অর্থচিন্তা।
১৭১৯
কিন্তু জীবনের বেলাশেষ তো অন্যরকমও হতে পারত। জীবনভর প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছিলেন প্রচুর। কিন্তু নিজে ভালবেসেছিলেন একজনকেই। সেই মার্কিন নাগরিকের নাম ছিল রবিন। শেফালিকে বিয়ে করে তিনি আমেরিকায় চলে যেতে চেয়েছিলেন।
১৮১৯
সায় আসেনি শেফালির দিক থেকেই। তিনি বিয়ে করে চলে গেলে তাঁর পরিজনকে কে দেখবে? তাই নিজের সংসার আর শুরু হল না। নর্তকী পরিচয়েই রয়ে গেলেন ‘মিস শেফালি’।
১৯১৯
ঘর সংসারের মতো অধরা থেকে গেল ‘শিল্পী’ পরিচয়ও। আরতি দাস নৃত্যশিল্পী নন। অভিনেত্রী নন। তিনি শুধুই মদিরা-আসরের ‘মিস শেফালি’। পরিচয় নিয়ে আক্ষেপ ছিল না। আক্ষেপ ছিল স্বীকৃতি না পাওয়া নিয়ে। শেষ জীবনে তার কিছুটা প্রশমিত হয়েছিল প্রকাশিত জীবনীতে। বাকি কষ্টটুকু নিয়ে ৬ ফেব্রুয়ারি চলে গেলেন তিনি। যেখানে যেতে সামাজিক স্বীকৃতির প্রয়োজন হয় না। (ছবি: আর্কাইভ)