‘মর্দানি’ এক মহিলা পুলিশ অফিসারের লড়াইয়ের গল্প। একজন মহিলার ভিতরের পৌরুষকে জাগিয়ে তোলার গল্প। রিলিজের আগেই এটুকু তথ্য আপামর ভারতবাসীর কাছে ছিল। তবে ছবির প্রোমোশনে কলকাতায় গাঢ় নীল ব্লাউজ আর নীল পাড় সাদা ঢাকাই শাড়িতে রানি মুখোপাধ্যায়কে দেখে একটু প্রমাদ গুনেছিলাম। কেন জানি না, ছোটবেলা থেকেই শাড়ি-পরা মহিলা- পুলিশদের দেখলে কেমন যেন অসহায় মনে হত আমার। মনে হয়, এই পেশার চাহিদা অনুযায়ী যথেষ্ট স্মার্টনেস... মানে যথেষ্ট ‘ইয়ে’... মানে যথেষ্ট ‘মর্দানি’টা যেন ওঁরা প্রকাশ করতে পারেন না পোশাকের জন্য।
ছবিটা দেখতে বসে আশ্বস্ত হলাম। জিন্স আর চেক শার্টে ছিপছিপে চেহারার স্লিক এন’ স্মার্ট রানি। মেকআপ আছে, আবার নেইও। হাসি-কান্না-দুঃখ-রাগ কোনওটাতেই বাড়াবাড়ি নেই। অসম্ভব ঠান্ডা মাথার আপাত নিষ্প্রভ একজন পুলিশকর্মী শিবানী শিবাজি রায়। সারাদিন গুন্ডা পেটানো, রেড করা, কাজের ফাঁকে সহকর্মীদের সঙ্গে স্ল্যাং-সমৃদ্ধ ইয়ার্কি-ফাজলামি করা আর দিনের শেষে প্যাক করা খাবার বাড়িতে এনে পরিবারের সঙ্গে খাওয়া। তার মধ্যেও ফোন কল অ্যাটেন্ড করা। মানে পুলিশদের জীবন যেমন হয় আর কী। তেমনই চলতে থাকে তার জীবনও। স্বামী আর বোনঝিকে নিয়ে তাঁর পরিবার। আর আছে পিয়ারি, ট্র্যাফিক সিগনালে ফুল বিক্রি করা, অনাথ আশ্রমে থাকা, অনাত্মীয় এক রাস্তার মেয়ে যাঁকে সে নিজের বোনঝি বা বলা যায় নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করে। আসল গল্প শুরু হয় যখন পিয়ারি একদিন হঠাত্ হারিয়ে যায়। আর তাকে খুঁজতে গিয়ে শিবানী খোঁজ পায় এক আন্তর্জাতিক নারী/শিশু-পাচারকারী চক্রের।
স্নেহ-বলে তিনি মাতা, বাহু-বলে তিনি রাজা...
শিবানী শিবাজি রায়কে দেখে রবিঠাকুরের ‘চিত্রাঙ্গদা’র এই লাইনটাই মনে পড়ল। ‘মৌসি’ হয়েও বোনঝির প্রতি তার মাতৃসুলভ আচরণ। পিয়ারির প্রতি তার মমতার টান যেমন আছে, আবার তাকে খুঁজে বার করতে নিজের জীবন বাজি রেখে ভিলেনের ডেরায় সোজা ঢুকে পড়তে সে দু’বার ভাবে না। ভিলেনের হাড়হিম করা ঠান্ডামাথার টেলিফোন শাসানি সে ঠান্ডা মাথাতেই হজম করে। আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়। হিন্দি ছবিতে এত বাহুল্যবর্জিত পুলিশ অফিসারের চরিত্র... তাও আবার মহিলা পুলিশ... বড় একটা দেখা যায়নি। রানির অভিনয়ে সেই নির্লিপ্ত ভাব বড় ভাল লাগে।
মর্দ কো দর্দ নহি হোতা...
তাই বোধহয় শিবানী শিবাজি রায় নিজের কাছের মানুষটার (যিশু সেনগুপ্ত স্বামী না ‘লিভ ইন’ পার্টনার, ঠিক বুঝিনি) জনসমক্ষে অপমান দেখেও চোখের জল পড়তে দেয় না। আই পেনসিলের বর্ডারের মধ্যেই আটকে রাখে। শুধু ওই শটটার জন্যই অ-নে-ক-টা হাততালি আপনার প্রাপ্য, রানি।
বেশ করেছি (ছোট) পার্ট করেছি
এটা যিশু (সেনগুপ্ত)-র ডায়লগ হওয়া উচিত। যা হইচই হচ্ছে ওর এই পার্টটা করা নিয়ে! হ্যাঁ, বাঙালি দর্শক হিসেবে অতটুকু পার্টে যিশুকে দেখে একটু মন খারাপ যে হয়নি, তা নয়। আজকাল ওকে স্ক্রিনে দেখতে বেশ ভাল লাগে, আর অভিনয়ও খুব মন দিয়ে করে ও। এখানেও তার অন্যথা হয়নি। কিন্তু এটা তো বাংলা ছবি নয়। একটা অন্য ইন্ডাস্ট্রি যেখানে ওকে কেউ চেনে না। একটা অন্য ভাষা যেটা ওর মাতৃভাষা নয়। এবং ভারতের অন্যতম বড় ব্যানারের ছবিতে সুযোগ পাওয়া। আর ভারতের অন্যতম সেরা অভিনেত্রীর সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করা। এমনিতেই বেশ বড় ব্যাপার। বন্ধু বা সহকর্মী হিসেবে তো আমার বেশ গর্বই হচ্ছিল ওকে দেখে। হোক না ছোট পার্ট।
তবে খটকাটা অন্য জায়গায়। শিবানীর কে হয় বাঙালি ডা. বিক্রম রায়? স্বামী? তা হলে শিবানীর বোনঝি তাঁকে ‘কাকু’ আর শিবানীকে ‘মৌসি’ ডাকে কেন? শিবানীর জন্য না-খেয়ে বাড়িতে অপেক্ষা করা আর টেলিফোনে শিবানীকে ‘ছোড় না মত’ বলে ভিলেনের পিছনে ধাওয়া করতে উত্সাহ দেওয়া ছাড়া তার কি কোনও কাজ নেই? নিজের ডিসপেনসারিতে গুন্ডাবাহিনীর দ্বারা মিথ্যে অভিযোগে মার খেয়ে এবং মুখে কালি মেখে বাড়ি চলে আসার পর কী হল তার?
প্রশ্ন আরও অনেক তোলা যেতে পারে। তবে সেগুলো নিয়ে বোধহয় আমরা বাঙালিরাই বেশি ভাবছি। বাকিরা নয়।
দ্য অ্যাওয়ার্ড গোজ টু...
তাহির ভাসিন। কোথায় ছিলেন ভাই? এত কম বয়স (২৭ বছর) ও অভিজ্ঞতা (বড় পর্দায়) নিয়ে আপনার এত ভাল স্ক্রিন প্রেজেন্স এবং রানির মতো পোড়খাওয়া অভিনেত্রীর সঙ্গে প্রায় সমানে সমানে টক্কর দেওয়া তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলাম। একজন মহিলাকে ‘ম্যা’ম’ সম্বোধন করেও শুধু ডাকার ধরন দিয়েই তাকে এতটা অসম্মান আর হেয় করা যায়, না শুনলে বিশ্বাস হত না। আপনার অভিনয়ে থিয়েটারের ছাপ স্পষ্ট। ম্যানারিজম আক্রান্ত অভিনয় আমি ব্যক্তিগত ভাবে অপছন্দ করলেও, তাহির, আপনাকে দিব্যি লাগল।
গল্পের গরু...
না। গাছে ওঠেনি। চারণভূমিতে ঘুরে ঘুরে দিব্যি ঘাস চিবিয়েছে। নিন্দুকরা বলছে, গোপী পুথরান নাকি ‘টেকেন’ থেকে টুকেছেন। লিয়াম নিসনের মহিলা সংস্করণই নাকি আমাদের রানি মুখোপাধ্যায়... থুড়ি চোপড়া। এটা অফিশিয়াল, না আন-অফিশিয়াল, ঠিক জানি না। তবে তাই যদি হয়, মাঝ নদীতে লঞ্চের উপর ভিলেনের ডেরায় গিয়ে সেই রুদ্ধশ্বাস ক্লাইম্যাক্সটা মিস করছি। এখানকার ক্লাইম্যাক্সটা কেমন যেন জোলো লাগল। নিজের যাত্রা পথ মসৃণ করতে শুধু একটা ছোট ছুরির ভয় দেখিয়ে গোটা ভিলেন সাম্রাজ্যকে দিয়ে যা যা করিয়ে নিলেন শিবানী, তা একটু অবিশ্বাস্য ঠেকল। যেখানে ভিলেনের কোমরে আগ্নেয়াস্ত্র লুকানো আছে। সেই অস্ত্র বেরোল বটে, তবে বড্ড দেরিতে। ততক্ষণে শিবানী ভিক্টরি স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে। গল্পের শেষ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
শেষ হইয়াও হইল না শেষ...
পপকর্নের খালি গামলা ফেলে যেই না সবাই উঠব উঠব করছে... ব্যস্! ছন্দপতন। শিবানী ‘মর্দ-রানি’ রায় পঞ্চতন্ত্রের বই খুলে বসল। বন্দুকের নলের সামনে ভিলেনকে দাঁড় করিয়ে রেখে গল্প বলতে শুরু করল কী ভাবে সে জিতল এই টম অ্যান্ড জেরি খেলায়। উত্তেজনাটা হঠাত্ পড়ে গেল।
শেষ পাতে আগমনী
ছবির শেষ সিনটা দেখতে গিয়ে হঠাত্ মনে পড়ল দুর্গাপুজো এসে গিয়েছে। কেন মনে পড়ল? ওহ্.... মনে পড়েছে। রানি মুখার্জি এবং পিয়ারির সঙ্গে আরও এক হতভাগী পিয়ারি সবে ছাড়া পেয়েছে সেক্স র্যাকেটের হাত থেকে। পুলিশ টেনে টেনে বার করছে সব ক’টা বদমাশকে। আর ঠিক তখনই ব্যাকগ্রাউন্ডে ‘ইয়া দেবী সর্বভূতেষু...’ বেজে উঠল। এত স্মার্ট একটা ছবির শেষে এটা না হলেই কি চলছিল না?
কোথা কোথা খুঁজেছি তোমায়
পুরো ছবি ধরে খুঁজলাম ‘পরিণীতা’র পর্দায় বলিউডি প্রকাশের কারিগরকে। কী জানি কেন, পেলাম না। দর্শক পছন্দ করছে ছবিটাকে। সমালোচকরাও। ছবি যেন দিনের শেষে ‘রানি চোপড়ার ছবি’ হয়ে রয়ে গেল। প্রদীপ সরকারের হল কই?
পুনশ্চ
মোনা আম্বেগাঁওকরকে অনেক দিন পরে বড় পর্দায় দেখলাম। ওইটুকু ক্যামিওতে চরিত্রের দু’রকম শেড বের করাটা অভিনেত্রী হিসেবে আপনি নিচয়ই খুব উপভোগ করেছেন। আমরাও করেছি। কাস্টিং ডিরেক্টর শানু শর্মার একটা বড় ‘রাউন্ড অব অ্যাপ্লস’ প্রাপ্য। আর এ ছবিতে প্রদীপ সরকার, রানি মুখোপাধ্যায় আর যিশু সেনগুপ্ত ছাড়াও বাঙালির গর্ব করার মতো কাজ আর এক জন করেছেন। এডিটর সঞ্জীব দত্ত। আপনি জাস্ট ফাটিয়ে দিয়েছেন। ব্রাভো!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy