অন্ধকার, একাকিত্ব সরিয়ে রেখেছেন রাখি গুলজ়ার। ছবি: সংগৃহীত।
মুখোমুখি প্রথম দেখা। প্রণাম আটকাতে চেপে ধরলেন হাত। মা বা মাসিদের মতো বলে উঠলেন, “কোন মাছ ভাজতে গিয়ে হাত পুড়ল?” গোয়ার বিলাসবহুল হোটেলের মানুষ আচমকা তাঁকে দেখে তখন নিজস্বী তুলতে চাইছে। সে সবে নজর নেই তাঁর।
প্রথম দেখায় মাছ রান্নার কথা বলতে পারেন যিনি তিনি আর কেউ নন, অভিনেত্রী রাখি। রাখির হাতের রান্নার কথা কে না জানে! স্বয়ং গুলজ়ার মাছ খাওয়া শেখা থেকে মাছের বাজার যাওয়ার উৎসাহ তাঁর কাছ থেকেই তো শিখেছিলেন। বললেন, “পাবদা যখন রাঁধবে আঁচ কমিয়ে রাখবে। আর তেলে দেওয়ার আগে ভাল করে জল ঝরাতে হবে। রান্না করলেই তো হল না! রান্নার পিছনে বিজ্ঞান বুঝতে হবে। মাছে জল ছিল বলেই তেল হাতে এসেছে। এ বার থেকে মাছগুলো শুকনো করে নিয়ো। আর তেলে হলুদ দিয়ে চাপা দিয়ে দিয়ো।”
ঘিয়ে রঙের লক্ষ্ণৌ চিকনের কাজ করা সালোয়ার কামিজ। ঘিয়ে রং তাঁর সবচেয়ে পছন্দের। বাঙালি অভিনেত্রী, পঞ্জাবি পরিবারের বৌ, ইন্ডাস্ট্রিতে রাখির পরে কোয়েল মল্লিক।
অনেকটা রাস্তা ঘুরে হোটেলে আসতে হয়েছে তাঁকে। একটু বিরক্তও। তবে মুখে ক্লান্তির ছাপ নেই। নেই কোনও রূপটান। দেখনদারির গয়নাও নেই কোনও। তাঁর চামড়ার রঙেই চার দিক যেন আলো। এর মাঝেই শোনা গেল চাপা শোরগোল।
ব্যাপার কী? পাঁচতারার চার কামরার এলাহি ব্যবস্থা দেখেও তিনি খুশি নন! পরিচালক শিবপ্রসাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এত বড় ঘরে একলা থাকা যায় নাকি! তুই আর জিনিয়া যেখানে থাকবি আমি তার ঠিক পাশে থাকব। কথা তো তাই ছিল। নয়তো আমি মুম্বই ফিরব এখনই।”
কথামাফিক কাজ করেন তিনি। অভিনেত্রী রাখি মজুমদার। এক অনুরাগী তিনি বাঙালি কি না সংশয় প্রকাশ করায় ধমক দিয়ে বলেছেন, “আমি আসলে রাখি মজুমদার। গুলজ়ারকে বিয়ে করায় আমি রাখি গুলজ়ার হয়েছি। নামের পাশে রেখেছিলাম ‘গুলজ়ার’। আমার মেয়ে মেঘনার নামের পাশেও তাই ‘গুলজ়ার’-এর নাম ব্যবহার হয়।”
ছবিতে অভিনয় শুরুর সময়ে রাখি অবশ্য কোনও পদবি ব্যবহার করতেন না। পঞ্চাশ বছর পর মুম্বই থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে গোয়ায় বসে যখন তিনি ‘২৭ ডাউন’ ছবি দেখছেন, তখন সেই ছবির নাম তালিকায় লেখা ছিল শুধুই রাখি। বিষয়টি ছুঁয়ে গেল বর্ষীয়ান অভিনেত্রীকে। তিনি বললেন, “আমি তখনও শুধুই রাখি। ভাল লাগল পুরনো দিনে ফিরে যেতে।”
কিন্তু কোনও মতেই গোয়ায় পাঁচতারা হোটেলের ঘর পছন্দ হচ্ছিল না তাঁর। বহু শর্তের বিনিময়ে নন্দিতা রায় আর শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘আমার বস’ ছবির প্রথম প্রদর্শনে তিনি গোয়ায় এসেছিলেন। শর্ত ছিল পরিচালক শিবপ্রসাদকে মুম্বই থেকে তাঁর গোয়া যাওয়া- আসার দায়িত্ব নিতে হবে। অন্য কেউ তাঁকে নিতে এলে তিনি যাবেন না। শিবপ্রসাদের কাছেই তাঁর যত আবদার। যত রাগ। তাঁদের ছবি ‘আমার বস’ এর মতোই বাস্তবেও যেন তাঁদের মা-ছেলের সম্পর্ক। সকলের সামনে শিবপ্রসাদের কান মুলে দেখিয়ে দিলেন তাঁর অধিকার। প্রায় সারা সন্ধে ধরে চলল ঘর বাছাই। শর্ত মেনে শিবপ্রসাদ আর জিনিয়ার ঘরের কাছাকাছি থাকলেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক মুহূর্ত পর ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন তিনি। পরবর্তী কালে নিজের জীবনেও স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস করেননি কোনও দিন। বাঁচতে চেয়েছেন নিজের শর্তে। হুকুম এল সকলকে রাতের খাবার তাঁর সঙ্গে, তাঁর ঘরে বসে খেতে হবে। তিনি তখনও জানেন না একজন সাংবাদিক তাঁর আমন্ত্রণের তালিকায় যুক্ত হয়েছেন। রাখি সাংবাদিক দেখলেই রেগে যান। তাই অন্য পরিচয়ে তাঁর সামনে আমাকে হাজির করা হয়েছিল। সময় মতো পৌঁছে গেলাম তাঁর ঘরে। আমি আর ভাগ্যশ্রী। রাখির খেয়াল রাখার ভার পড়েছিল উইন্ডোজ প্রযোজনা সংস্থার কর্মী ভাগ্যশ্রীর উপর। পোশাক বদলে প্যাস্টেল শেডের নরম কাপড়ের কো-অর্ড সেট পরেছেন তিনি। সামনে টেলিভিশন খোলা। খবর দেখছেন।
ভাবা হয়েছিল রাতের গোয়া দেখতে যাওয়া হবে। সে সব পরিকল্পনা বাতিল করে রাখি সকলের সঙ্গে খাওয়া আর গল্প করার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন।
শুরু হল রাতের খাওয়া। ভাত খেতে পছন্দ করেন রাখি। তবে নন্দিতা রায় জাসমিন রাইস খেতে যাবেন এমন সময় তাঁর দিকে চেয়ে রে-রে করে উঠলেন, খানিক যেন ধমকের সুরেই বললেন, “একদম খেয়ো না। ওই ভাতে মারকারি দেওয়া থাকে। সব বাজে। খবরদার খেয়ো না।” এর পর সকলেই চুপ।সন্ধে থেকেই দেখছিলাম রাখি কোনও বিষয় আপত্তি জানালে তাঁকে সম্মান দিয়ে কেউ তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বলছেন না। শিবপ্রসাদ পরিবেশ হালকা করলেন। বললেন, “আচ্ছা, মহারাষ্ট্রে শিন্ডে ভাল কাজ করেছিলেন বলছিলে তুমি…।” রাখি শিবপ্রসাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “শিন্ডেরই মুখ্যমন্ত্রী হওয়া উচিত ছিল এত ভাল কাজ করেছে।”
শহর নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবার খাবারের গল্প চলে এলেন তিনি। ‘গ্রিন থাই চিকেন কারি’, ‘রেড থাই চিকেন কারি’, ‘ভেজিটেবল সতেঁ’, ‘নুডল্স’— সে দিকে তাকিয়ে বললেন, “এখন বাড়িতে কেউ রান্না করে না। সবাই বাইরে খাবার খায় বা আনিয়ে নেয়, তবে আমিও আজকাল মাঝেমাঝে খাবার আনাতে আরম্ভ করেছি। বাড়ির সামনেই খুব সুন্দর উপমা পাওয়া যায়। আর একটা চমৎকার বিরিয়ানির দোকান খুলেছে। বড় বড় আলু, মাংস…।” বলেই ‘গ্রিন থাই চিকেন কারি’ মুখে তুললেন রাখি। ভোরবেলা ভরপেট ফল খেয়ে প্রাতরাশ করেন তিনি।
খাবারের গল্প থেকেই পুরনো দিনে ফেরা। তিনি ফিরে গেলেন শশী কপূর আর ‘কভি কভি’র জমানায়। নন্দিতা, শিবপ্রসাদ, জিনিয়া সকলেই রাতের খাবার ছেড়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে। “কভি কভি’ ছবির শুটিং চলছে। আমরা সকলেই বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম সঙ্গে। অমিতাভের বাচ্চারা ‘সসেজ’ খাচ্ছে দেখে আমিও মেয়েকে খাওয়াতে গেলাম। ও কী ভয় পেয়ে গেল। ‘জুজু’ বলে পালাতে যাচ্ছিল। ‘জুজু’ মানে ওর কাছে ভয়, আমি পরে বুঝিয়ে সেই ভয় কাটিয়েছিলাম।” ঘুরে ফিরেই আসছিল মেয়ে আর নাতির সময়ের কথা। নাতিও মনে হল তাঁর দিদিমার মতো, নিজের শর্তে বাঁচেন। রাখি জানালেন ওর সংখ্যা ৮। খুব জেদ।
সংখ্যাতত্ত্ব মানেন বুঝি রাখি? এই প্রথম প্রশ্ন করলাম।
নন্দিতা-শিবপ্রসাদ-জিনিয়ার স্বাভাবিক বন্ধুত্বের মাঝে আমি এক মাত্র বহিরাগত। যে কোনও সময় রাখি বলতেন পারেন বাইরে চলে যেতে। যদিও একবার দেখেই সহজ করে নিয়েছিলেন। কথা প্রসঙ্গে বুঝেছি আনন্দবাজার অনলাইনও দেখেন তিনি। সঙ্গে জেনেছি সাংবাদিকদের একেবারেই পছন্দ করেন না। প্রশ্নের জবাব এল, “সংখ্যাতত্ত্ব এক বিজ্ঞান।” বলেই কেমন করে নিজের সংখ্যা বার করতে হবে, তা নিয়ে পড়াশোনা করতে হবে, সব শিখিয়ে দিলেন নন্দিতা রায়কে ।
পুরনোকে নতুন করে জীবন কাটান রাখি।তাঁর প্রিয় বাগান বাড়িই যেন তাঁর নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জায়গা। সেখানে ‘ধন্বো’ আছে। শোলে ছবিতে হেমা মালিনী ঘোড়ার গাড়ি চালাতেন। সেই ঘোড়ার নাম ছিল ‘ধন্বো’। রাখি তাঁর গরুর নাম রেখেছেন ‘ধন্বো’। মুম্বইয়ের বাড়িতে চিল আর কাকের দল তাঁর কাছে ভিড় করে আসে। রাখির হেঁশেলে তাঁদের জন্য ডিম সেদ্ধ হয়। সেই ডিম নিজের হাতে খাইয়ে দেন।মানুষের চেয়ে প্রকৃতি আর পোষ্যই তাঁর কাছে বেশি প্রিয়।
মানুষের কাছ থেকে সরে আসতেই কি ছবির দুনিয়া থেকে বেরিয়ে যাওয়া?
জানালেন, যে পরিচালকদের সঙ্গে ছবি করতে সবচেয়ে পছন্দ করতেন, সেই সত্যেন বসু, বিজয় আনন্দ, যশ চোপড়া— তাঁরা কেউ আর নেই। তাঁর কাছে পরিচালক মানে, “সেই মানুষ যিনি বলবেন, এটা ভুল হয়েছে, আবার করো।” মনে করেন, এখনকার পরিচালকেরা নিজেদের মর্যাদা ভুলে গিয়েছেন। এখন নাচ-গান-চাকচিক্যটাই যেন প্রধান।বললেন, “তাই যে দিন দেখলাম, আমার দ্বারা আর হচ্ছে না, সরে গেলাম।” তবে ‘আমার বস’-এর চিত্রনাট্য শুনেই চোখ ছলছলিয়ে উঠেছিল। অধিকাংশ পরিচালককে স্বেচ্ছায় ফিরিয়ে দেন। ‘আমার বস’-এর ক্ষেত্রে তা হয়নি।
একটু একটু করে জেগে উঠছিল গোয়ার রাত। তাঁর ইচ্ছে সমুদ্রের ধারের দোকান থেকে দুপুরের খাবার খাবেন। তাঁর ইচ্ছে গোয়ার ‘নাইট মার্কেট’ ঘুরে এটা সেটা কিনবেন। তাঁকে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল বন্ধুবান্ধব নিয়ে সাধারণ হয়ে হারিয়ে যেতে চান তিনি। সিনেমার আলো, লাল গালিচা, তাঁকে দেখার জন্য উপচে পড়া ভিড়, অসংখ্য নিজস্বী তাঁর যত বিরক্তির কারণ।
এ বার ঘুমোতে চান তিনি। ঘরের পর্দা টেনে দেব? বললেন, “না সকালের আলো আমার চোখে এসে পড়বে। আমি দেখব।” এ বার প্রশ্ন করলেন আমাকে, “কী, আমি মানুষটা অদ্ভুত তো? তোমার এমনটাই মনে হবে।”
অন্ধকার, একাকিত্ব সরিয়ে রেখেছেন তিনি। যেখানেই থাকুন রাতে তাঁর ঘর ভরে যাবে পুরনো হিন্দি গানের সুরে। সুরকে সঙ্গী করেছেন তিনি। “গান থাকলে আর একলা লাগে না, জানো। মনে হয় কী আমার পাশে আছে,” নরম হয়ে এল তাঁর কণ্ঠস্বর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy