‘শেষ পাতা’র আড্ডায় পরিচালক-অভিনেতা জুটিতে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
এত বছরে অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় এবং পরিচালক অতনু ঘোষের ‘ময়ূরাক্ষী’ এবং ‘রবিবার’-এর পর ‘শেষ পাতা’ তৃতীয় কাজ। তা-ও সারা বছর এই পরিচালকের ফোনের আশায় কেন বসে থাকেন প্রসেনজিৎ? আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে খোলামেলা আড্ডায় দু’জনে।
প্রশ্ন: প্রসেনজিৎ একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, উনি অতনু ঘোষের ছবির অপেক্ষায় থাকেন। এই বিষয়টা কবে থেকে হল?
অতনু: আমার সঙ্গে তো খুব বেশি অভিনেতা কাজ করতে চান না। সৌমিত্রবাবু (চট্টোপাধ্যায়) চাইতেন। এখন বুম্বাদা চায়। আমি যে ধরনের কাজ করি, সেখানে মুখ্য চরিত্র বলে তো কিছু হয় না, বরং চরিত্রগুলো আরও বড় কিছু। তাই সে ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, অভিনেতার ইচ্ছেটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। আমার মনে আছে, এই ঘরে বসেই ঋতুদা (ঋতুপর্ণ ঘোষ) বলেছিল, তোর বুম্বার সঙ্গে কাজ করা উচিত। আমি তো অবাক। তখন আমার চিত্রনাট্য কেউ শুনত না (হাসি)।
প্রসেনজিৎ: ‘উনিশে এপ্রিল’-এর পর ঋতুদার পরিচালক হিসাবে বেড়ে ওঠাটাও কিন্তু আমার চোখের সামনে। ও বন্ধু হিসাবে আমার সাইকিটা বুঝত বলেই অতনুকে এ কথা বলেছিল। অতনুর প্রথম কাজটাই (‘অংশুমানের ছবি’) খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময় আমি তিন শিফ্ট-চার শিফ্টে পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক ছবি করছি। একটুর জন্য অতনুর প্রথম ছবিটা করতে পারিনি। কিন্তু সে সময়ে একটা খুব অফবিট ছবি করেছিলাম ‘হাউসফুল’। বাপ্পা (বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়) কখনও স্ক্রিপ্ট লিখত না। আমায় পড়াবে বলে প্রথম লিখে এনেছিল।
প্রশ্ন: সে ছবিতেও তো আপনি একজন পরিচালকের ভূমিকায় ছিলেন?
প্রসেনজিৎ: শুধু পরিচালক নয়, এক জন ব্যর্থ পরিচালক। আমি কিন্তু তখন থেকেই একটু অন্য ধারার ছবি যারা করত, তাদের সঙ্গে কাজ করতাম। সে সময় আমি কোনও ছবি করছি মানে ধরে নেওয়া হত, সেই ছবির গ্যারান্টেড রিটার্ন। কিন্তু বাপ্পা বা অতনু সে কথা ভেবে আমার কাছে চিত্রনাট্য নিয়ে আসত না। পরবর্তী কালে অতনু যে ছবিগুলো করেছিল, যেখানে হয়তো যিশু বা ঋত্বিক অভিনয় করেছিল, সবগুলোর স্ক্রিপ্ট আমার জানা। ওর সঙ্গে আমার যোগসূত্র অনেক দিনের। যে গল্পগুলো আমার কথা ভেবে লেখা নয়, সেগুলোও ও এসে আমায় শোনাত। আমারও শুনতে ভাল লাগত। এই কালচারটাই এখন আমাদের ইন্ডাস্ট্রি থেকে উঠে যাচ্ছে। আগে ঋতুদারা চিত্রনাট্য লিখলে অর্ধেক ইন্ডাস্ট্রিকে ডেকে সেটা পড়াত। সকলে জানত, কী হচ্ছে। অন্যের স্ক্রিপ্টেও সবাই মিলে ইনপুট দিত। এখন আর সে সব নেই। অতনুর সঙ্গে আমার সেই সৃজনশীল যোগটা অনেক দিনের। পরবর্তী কালে ও বলল, খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনও কাজ না হলে আমায় প্রস্তাব দেবে না। এবং শেষ পর্যন্ত এমন একটা ছবি (‘ময়ূরাক্ষী’) আমাদের প্রথম কাজ হল, যা বাঙালি বহু দিন মনে রাখবে। সৌমিত্রবাবুর শেষের দিককার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসাবে থেকে গেল।
প্রশ্ন: ‘ময়ূরাক্ষী’ জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিল। তার পরই কি ‘রবিবার’-এর পরিকল্পনা?
প্রসেনজিৎ: দর্শক বড্ড তাড়াতাড়ি যে কোনও ছবিকে অন্য রকম বলে দাগিয়ে দেন। সে দিক থেকে দেখতে গেলে ‘ময়ূরাক্ষী’ কিন্তু বক্স অফিসেও যথেষ্ট সফল। তার পর অতনু ‘রবিবার’-এর চিত্রনাট্য নিয়ে এল। প্রসেনজিৎ আর জয়ার (আহসান) মতো কাস্টিং যে কোনও পরিচালকই চাইবেন। কিন্তু অতনু এল একদম অবাঙালি একটা স্ক্রিপ্ট নিয়ে! মনে হবে, যেন স্প্যানিশ ছবি। আসলে সিনেমার তো অনেক রকম ভাষা রয়েছে। অন্য ভাষা নিয়ে ছবি করার পরীক্ষা-নিরীক্ষাটা সব জায়গায় চলতে থাকে। সে দিক থেকে আমি বলব, অতনু একদম ‘শেষ পাতা’র মুখ্য চরিত্র বাল্মীকির মতো। ও এখনও পর্যন্ত কোনও রকম কম্প্রোমাইজ় করেনি। প্রার্থনা করি, ওকে যেন কখনও করতেও না হয়।
প্রশ্ন: আপনি করেছেন?
প্রসেনজিৎ: কম্প্রোমাইজ় না করলে এমন একটা বাড়ি হয়! আমায় তো আমার ছেলের কথা ভাবতে হয়, আমার সঙ্গে এত জন কাজ করেন, তাঁদের কথা ভাবতে হয়। তাই মাঝেমাঝে আমাকেও কম্প্রোমাইজ় করতে হয়। তবে বলতে পারেন, গত দশ-বারো বছরে কম করতে হয়েছে। তাই এখন বেছে কাজ করতে পারি।
প্রশ্ন: তাই এখন ‘শেষ পাতা’র মতো চরিত্রে অনায়াসে রাজি হয়ে যেতে পারেন?
প্রসেনজিৎ: (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) ‘শেষ পাতা’য় বাল্মীকির চরিত্রটা করার মতো যোগ্যতা আমার আছে কি না, আমি জানি না। যাঁরা অভিনয়ের শিক্ষক আমার চোখে, এটা তাঁদের জন্য লেখা। তবে আমি তো লোভী অভিনেতা। আমায় অতনু এই চরিত্রটা শোনানোর পরই আমি পাগলের মতো রাজি হয়ে যাই। পরে বুঝেছি, এটা কতটা পরিশ্রমের। চরিত্রটা দেখলেই বোঝা যাবে, মেকআপে হার্ডলি কোনও প্রস্থেটিক রয়েছে। বাল্মীকি একটা জলজ্যান্ত চরিত্র। যার পিছনে মেকআপের হয়তো অবদান অল্পই। কিন্তু আমার অবদান প্রচুর। এই চরিত্রটার যতগুলো লেয়ার রয়েছে, আমি আমার পরিচালকের হাত ধরে অল্প অল্প করে সেগুলো সব নিজের মধ্যে গেঁথেছি। অতনু এমনই একজন পরিচালক যে, কোনও অভিনেতা যদি ওর সঙ্গে কাজ না করতে চায়, তা হলে সেটা তারই দুর্ভাগ্য।
অতনু: আসলে আমার ছবির ক্ষেত্রে অভিনয়ের ধারাটা একটু অন্য রকম। এখানে যে ধরনের অভিনয় প্রচলিত, তাতে ৮০ শতাংশ প্রস্তুতি আর ২০ শতাংশ ইনট্যুশন। কিন্তু বাল্মীকির ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশই ইনট্যুশন ছিল। আমরা কোনও ওয়ার্কশপ করিনি, রিহার্সাল করিনি। বাল্মীকি পুরোটাই প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের ভিতর থেকে বেরোনো একটি চরিত্র। প্রত্যেক শিল্পীর ভিতরেই সেই যন্ত্রণা, হতাশা থাকে।
প্রসেনজিৎ: কিন্তু শিল্পীর সেই দিকগুলো এখন সিনেমায় খুব একটা আসে না। একমাত্র সত্যজিৎবাবু (রায়) ‘নায়ক’-এ দেখিয়েছিলেন। আর কিছুটা ঋতু দেখিয়েছিল ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’-এ।
প্রশ্ন: প্রসেনজিৎ তো বলে দিলেন তিনি এই ছবির যোগ্য নন। অতনু, আপনি নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তেই এই ছবির প্রস্তাব ওঁকে দিয়েছিলেন?
অতনু: ও তো সব ভাল অভিনেতাই বলেন! যত ক্ষণ কেউ মনে করছেন, আমার আরও কিছু শেখার আছে, তত ক্ষণ তিনি কিছু ধাপ এগিয়ে থাকবেন। বুম্বাদাও তেমনই। এই ছবি করতে গিয়ে মাঝে তো অনেক কাণ্ড। এক দিন অভিমান করে জ়ুম কলে বুম্বাদা বলল, ‘‘আমায় বাদ দে, মনে হয় না আমার দ্বারা হবে!’’ আসলে চরিত্রটাই এমন যে, ফ্রেমে আসার আগে বুম্বাদা একটুও প্রস্তুতি নেয়নি। পুরোটাই ইম্পাল্সে।
প্রসেনজিৎ: আমি একটু ভয়ে পেয়ে গিয়েছিলাম যে, এতটা ইম্পাল্সের উপর দাঁড়িয়ে আমি অভিনয় করতে পারব কি না।
প্রশ্ন: অতনু, আপনার ছবিতে অভিনয় করা কঠিন বলে যেমন অনেকে কাজ করতে রাজি হন না, তেমনই বক্স অফিসে চলবে না বলেও অনেকে করতে চান না। সেই দিকটা নিয়ে কিছু ভেবেছেন?
অতনু: সিনেমার ভাষা নিয়ে যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, তা হলে এখানে সেটার খুব একটা খোলামনে প্রশংসা হয় না। দক্ষিণে যেটার কোনও অভাব নেই। বুম্বাদা বহু দিন ধরে নানা রকম ছবি করছে। ১৯৮৬ সালে ‘আতঙ্ক’-র মতো একটা ছবি করেছে। ‘অমি, ইয়াসিন আর আমার মধুবালা’ করেছে, ‘ক্লার্ক’ করেছে। কিন্তু ওর সঙ্গে একটা স্টিগমা জুড়ে গিয়েছে। ইন্ডাস্ট্রির একাংশ সব সময়ই বলবে, ‘‘অনেকটা চেষ্টা করেছিল, কিন্তু শেষ অবধি হল না।’’ এই ধরনের মন্তব্য সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। এখানে এত তাড়াতাড়ি কোনও ছবিকে দাগিয়ে দেওয়া হয় যে, ছবিটা ভাল ভাবে সুযোগই পায় না। যে কোনও অভিনেতার কাজ একটু সৎ ভাবে দেখা খুব প্রয়োজন।
প্রসেনজিৎ:অভিনেতা হিসাবে আমার ৪০ বছর হল। আমি ‘অটোগ্রাফ’ আর ‘মনের মানুষ’-এর মতো ছবিতে দু’টো বিপরীতধর্মী চরিত্রের শুট করেছিলাম মোটে ১৫ দিনের ব্যবধানে। আমি জানি, আমাদের ব্যবসার দরকার। কিন্তু পেন্টিং, বই, উপন্যাসের সঙ্গে যখন আমরা সিনেমাকে একসঙ্গে রাখি, তখন তো শিল্পের কথাও ভাবা উচিত। কিছু কাজ তো করে যেতে হবে যাতে নিজের কাছে জবাবদিহি করতে পারি। সব সময় তো বাজার দেখলে চলবে না। এই লড়াইটা আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। অন্তত আমি তো চালিয়ে যাব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy