আমার বাবার কাজ, পরিচালক-প্রযোজক-অভিনেতা সুখেন দাস কোনও দিন কোনও সম্মানই পেলেন না! সরকারি পুরস্কার দূরে থাক, বেসরকারি পুরস্কারও না। রাজ্য সরকারের কাছে আন্তরিক অনুরোধ, এ বার অন্তত মানুষটাকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হোক! সুখেন দাসের রেট্রোও কি হতে পারে না?
সুখেন দাসের স্মৃতিচারণে মেয়ে পিয়া সেনগুপ্ত
আমার কিন্তু অভিনয়ে আসার কোনও কথাই ছিল না। পড়াশোনায় ভাল ছিলাম। বাবা বলতেন, ‘‘তোকে অভিনয়ে আনব না। মন দিয়ে পড়। তার পর ভাল ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেব।’’ বাবার নজর ছিল আমার থেকে ৫ মিনিটের বড় যমজ দিদির দিকে। ঠিক করেছিলেন, দিদিকে পর্দায় আনবেন। কিন্তু মাত্র ১৩ বছর বয়সে ক্যানসারে চলে যায় দিদি। তখনই বাবার মাথায় চাপল, যে করেই হোক আমায় অভিনয়ে আনবেন। আমিও তখন মাত্র ১৩!
সুজিত গুহ-র ছবি ‘দাদামণি’ দিয়ে আমার অভিনয়ে হাতেখড়ি। বিপরীতে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। পর্দায় আমার বাবা আমার দাদা! স্টুডিয়োয় গিয়ে বাবাকে দেখে প্রথম আবিষ্কার করলাম, এ বাবা সে বাবা নন! বাড়িতে সুখেন দাস এক রকম। বাইরে একদম আলাদা। হয়তো খুব জোরে ধমকাতে পারতেন না। কিন্তু অভিনয় নিয়ে, সময়ানুবর্তিতায় কোনও ছাড় নেই। একে প্রথম অভিনয়। তার উপরে পর্দায় বাবাকে ‘দাদা’ ডাকতে হবে। আমার খালি গুলিয়ে যাচ্ছে। এ দিকে, বাবার সামনে ভুল করলেই সমস্যা। প্রথম প্রথম বেশ অসুবিধে হয়েছিল। শেষে সেটে বাবাকে ‘দাদা’ বলেই ডাকতে শুরু করলাম। তার পর থেকে আর ভুল হয়নি!
বাবার পরিচালনায় আমার প্রথম ছবি ‘মিলন তিথি’। জয় বন্দ্যোপাধ্যায় নায়ক। সে ছবি ব্যাপক জনপ্রিয়। বাবা এবং সেই সময়ের বাকি পরিচালকদের দৌলতে আমি বাংলা ছবির পরিচিত মুখ হয়ে গেলাম। জনপ্রিয় নায়িকার তকমা আমার গায়ে। কিন্তু, ‘স্বজনপোষণ’ শব্দটি কেউ সেঁটে দেননি! একা আমি নই, আমার দাদা রজত, কাকা অজয় দাস--- সবাই এই ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। জামাই অনুপ সেনগুপ্ত তো ওঁর সহকারী পরিচালক ছিলেন। তবু, এমন অপবাদ কেউ দেননি। সেই সময়ে বাকি পরিচালকরাও তাঁদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসেছেন। যেমন, অঞ্জন চৌধুরী। চুমকি, রিনা তো আমার বন্ধু ছিল। এখনও ওদের সঙ্গে ভাল যোগাযোগ আমার।
আসলে, সেই সময়ের মানুষের মন এত জটিল ছিল না। এত নিরাপত্তার অভাবে ভুগতেন না কেউ। জীবনযাত্রাও অনেক সহজ ছিল। স্টুডিয়ো, সেখানকার মানুষেরা ‘পরিবার’ হয়ে যেতেন। খাওয়া-দাওয়া, হুল্লোড় করতে করতে কাজ করতেন সবাই। আমার বাবা-ই কী ভীষণ খাওয়াতে ভালবাসতেন! বাবার কারণে মাকে প্রায় সারা ক্ষণ রান্নাঘরেই কাটাতে হত। আমাদের বাড়িতে এলে কেউ না খেয়ে যেতে পারতেন না। মা নিজের হাতে রাঁধতেন। বাবা সামনে বসে খাওয়াতেন। যত দিন বাবা ছিলেন, তত দিন এই এলাহি খাওয়া-দাওয়া দেখেছে অনুপও। ও বাবার খুব কাছের ছিল। পরিচালনার কাজে বাবা ভরসা করতেন। পরামর্শ নিতেন। সেই অনুপ যখন জামাই, তখন তার আদর যেন আরও বেড়ে গেল। আমরা বাড়িতে যাব, খবর পেলেই বাবা দিন দুই আগে থেকে বাজার শুরু করতেন। ‘জামাই ষষ্ঠী’র ঘটা ছিল দেখার মতো।
বাংলা বিনোদন দুনিয়াকে কম দেননি আমার বাবা। জনপ্রিয় ছবি, সংলাপ, গান, বাণিজ্য— সব দিক থেকেই। অনেককেই বলতে শুনি, সুখেন দাসের ছবি মানেই ‘সেন্টিমেন্ট’-এ ঠাসা! বাবা জানতেন, বাঙালি দর্শককে বেশি টানে ভাবাবেগে ভরা ছবির দৃশ্য বা সংলাপ, গান। তাই বাবার ছবির মতো আজকের ছবি ব্যবসা করতে পারে না। অথচ আমার বাবার কাজ, পরিচালক-প্রযোজক-অভিনেতা সুখেন দাস কোনও দিন কোনও সম্মানই পেলেন না! সরকারি পুরস্কার দূরে থাক, বেসরকারি পুরস্কারও না। অথচ উত্তমকুমারের মৃত্যুর পরে অনেকটা সময় ইন্ডাস্ট্রিকে বাবা টেনে নিয়ে গিয়েছেন। রাজ্য সরকারের কাছে আন্তরিক অনুরোধ, এ বার অন্তত মানুষটাকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হোক! সুখেন দাসের রেট্রোও কি হতে পারে না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy