হলের মধ্যে বাজ পড়লেও হয়ত লোকে এর থেকে বেশি চমকে উঠতেন। আগের দিন বহরমপুর ফিল্ম সোসাইটি আয়োজিত চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছে সৈকত ভট্টাচার্য পরিচালিত ছবি দুলিয়া। তখন বামফ্রন্ট সরকার সবে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসেছে। বাংলায় প্রগতিশীল ছবি বানানোর একটা পর্যায় তখনও চলছে। দুলিয়া ছবিটিও তার ব্যতিক্রম ছিল না। এক হতদরিদ্র দম্পতি তাঁদের অসুস্থ শিশুপুত্রকে বাঁচানোর জন্য শহরের হাসপাতালে ঘুরে ঘুরেও ব্যর্থ হন। ছেলেটি মারা যাওয়ার পরে ওই দম্পতি গ্রামের বাড়িতে ফিরে খোলা উঠোনে আধো অন্ধকারে মিলিত হন। ছবির এই শেষ দৃশ্যকে ঘিরেই বিতর্ক। পরের দিন সকালে রবীন্দ্র সদনের সেমিনারে ছবির চিত্রনাট্যকার ধীমান দাশগুপ্ত যেই না দৃশ্যটির পক্ষে মার্গারেট মিড নামক নৃতাত্ত্বিককে উদ্ধৃত করে বলেছেন ‘Sex is the last resort of poor people’, অমনি শ্রোতারা তাঁকে প্রায় ছিঁড়ে ফেলেন আর কি। একের পর এক শ্রোতার পাল্টা প্রশ্ন ধেয়ে আসতে থাকে— দরিদ্র মানুষের শ্রেণি সংগ্রাম, ত্যাগ, তিতিক্ষা ইত্যাদির কি কোনও দাম নেই ইত্যাদি। ধীমানবাবুর তখন আক্ষরিক অর্থেই ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা।
ঘটনাটার উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, বহরমপুর তথা মুর্শিদাবাদে একটা প্রাণবন্ত চলচিত্র চর্চার পরিবেশ ছিল এটা বোঝাতে। সেটাকে আন্দোলন বলা হয়ত একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। কিন্তু যদি আন্দোলন মানে হয় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ, তবে সেই সময়ের ভরা প্রেক্ষাগৃহের সেমিনার কিছু উল্লেখের দাবি রাখে বইকি। যাবতীয় সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মুর্শিদাবাদের মধ্যবিত্ত মানুষ নাটক বা সাহিত্যের মত সিনেমাকেও যে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে চেয়েছেন তাই বা কম কি?
মুর্শিদাবাদের চলচিত্র চর্চায় বহরমপুর ফিল্ম সোসাইটির আলাদা গুরুত্ব আছে। ১৯৬৫ সালে এই সংস্থার প্রতিষ্ঠা। ধীরে ধীরে আড়ে বহরে কলেবরে বেড়েছে তাই নয়, নিজস্ব প্রেক্ষাগৃহ ঋত্বিক সদনের মালিক হয়ে এক অনন্য নজির তৈরি করেছে। এত কিছুর পরেও যার জন্য এত স্বপ্ন দেখা সেই চলচ্চিত্র সংস্কৃতির প্রসার কি হয়েছে বা কতটা বেড়েছে সে কথা ভাবলে মন খারাপ হয়ে যেতে বাধ্য। অথচ চেষ্টা যে হয়নি তা তো নয়। এক সময় বহরমপুর রবীন্দ্র সদনে দু’-দু’টো চলচ্চিত্র উৎসব হত। ফিল্ম সোসাইটির উৎসবের সঙ্গে বাড়তি পাওনা ছিল সেমিনার। সত্যি কথা বলতে কি, বহরমপুর শহরে বসে কুমার সাহানি বা জি অরবিন্দনের মত পরিচালকের ছবি দেখার সুযোগ এই উৎসব না হলে মানুষ পেতেন না।
অনীক পত্রিকার সম্পাদক দীপঙ্কর চক্রবর্তীর প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতি পরিষদের উদ্যোগে আর একটি চলচ্চিত্র উৎসবে বামপন্থী ছবির আধিক্য বেশি থাকত। ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন বা মাদারের মত বিখ্যাত রাশিয়ান ছবি এই উৎসবেই দেখার সুযোগ পায় মুর্শিদাবাদের মানুষ। হ্যাঁ, মুর্শিদাবাদের অনেক জায়গা থেকে মানুষ ছবি দেখে বাস ট্রেন ধরে বাড়ি যেতেন। তাই এই উৎসবগুলি শুধু বহরমপুরের ছিল না। আবার শুধু বিদেশি বা আঞ্চলিক ভাষার ছবি নয়, বহু পুরোনো ক্লাসিক ছবি দেখার সুযোগ করে দিত এই দু’টি উৎসব। মনে রাখতে হবে ১৯৮৪ সালের আগে টিভি আসেনি। তখন কিন্তু আমরা বড় পর্দায় দেখার সুযোগ পেয়েছি সত্যজিতের অপু ত্রয়ী, ঋত্বিকের সুবর্ণরেখা বা মেঘে ঢাকা তারা, মৃণাল সেনের ভুবন সোম বা কলকাতা ৭১। এ সবের মূল্য বড় কম ছিল না। বহরমপুর ফিল্ম সোসাইটির নিজস্ব প্রেক্ষাগৃহ গড়ে ওঠার আগে তাদের নিজস্ব প্রদর্শনের ছবিগুলি দেখানো হত কৃষ্ণনাথ কলেজের ফিজিক্স থিয়েটার হলে। নিজেদের সদস্য ছাড়াও নামমাত্র দক্ষিণার বিনিময়ে অতিথি দর্শক হিসেবে সে সব ছবি দেখার প্রবেশাধিকার পাওয়া যেত। গ্যালারি সিস্টেমের ঘরটায় বসে মান্ধাতা আমলের প্রোজেক্টর দিয়ে ১৬ মিমি ফরম্যাটের দুনিয়া কাঁপানো ছবিগুলি দেখতে দেখতে আমরা আন্তর্জাতিক এক সংস্কৃতিবোধে স্নাত হতাম যা আমাদের মফস্সলি দুনিয়ায় এক আশ্চর্য আলোর সন্ধান দিত। ক্রিসতফ জানুসি বা ইস্তভান জ্যাবোর ছবি দেখার সুযোগ পেয়ে মুর্শিদাবাদের মানুষ বুঝেছিলেন, চলচ্চিত্রর সীমানা কত দূর প্রসারিত হতে পারে। জঁ লুক গোদারের ‘প্রেনম কারমেন’ ছবিতে সুর্যরশ্মিস্নাত নায়িকার নগ্নবক্ষে মুখ গুঁজে তরুণটি যখন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘Why do women exist’, তখন দর্শক হিসেবে প্রকৃত প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছিলাম।
নগরায়ন, গতিজাঢ্য ও বিনোদনের এই সময়ে সিরিয়াস চলচ্চিত্র চর্চার সংস্কৃতিকে কতটা বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব? ফিল্ম সোসাইটির এক প্রবীণ কর্মকর্তা বলছিলেন, ‘‘আমাদের উল্লম্ব বৃদ্ধি যতটা হয়েছে, আনুভূমিক বৃদ্ধি তার ধারেকাছেও নয়।’’ হ্যাঁ, চলচ্চিত্র চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি বেড়েছে। এমনকি, বহরমপুর কলেজে ফিল্ম স্টাডিজ পাঠ্য হিসেবে আগেই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু যে সামাজিকতার গর্ভে লালিত হয় চলচ্চিত্র চর্চার প্রাথমিক বিকাশ, যে তর্কমুখরতা জন্ম দেয় সিনেমার প্রাণপ্রতিমাকে, যার একটা খণ্ডচিত্র এই লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছি তার ক্ষয়িষ্ণুতা আজ সর্বব্যাপ্ত। এখন আর সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত কোনও ছবিকে নিয়ে কলেজ ক্যান্টিনে, চায়ের দোকানে বা বৈকালিক আড্ডায় তর্কের তুফান ওঠে না। অথচ এই সামাজিকতার বোধকে পুঁজি করেই তো প্রথম পথ চলা শুরু করেছিলেন দীপঙ্কর চক্রবর্তী, অভিজিৎ ভট্ট এবং আরও কিছু স্বপ্নদ্রষ্টারা, অসীম প্রত্যয়ে ঋত্বিক সদন গড়ে তোলার দুঃসাহসী প্রকল্পে ব্রতী হয়েছিলেন অকালপ্রয়াত গৌতমবিকাশ চক্রবর্তী এবং তাঁর সহযোদ্ধারা, প্রতিকূল স্রোতের বিরুদ্ধে চলচ্চিত্র চর্চার আবহটুকু বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন বহরমপুর ফিল্ম সোসাইটির বর্তমান সম্পাদক সমীরণ দেবনাথ এবং তাঁর সতীর্থরা। সিনেমার অসীম সামাজিক শক্তিকে শনাক্ত করেই না বহরমপুর থেকে আলাদা করে সিনেমা বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশিত হত তরুণদের উদ্যোগে। এখান থেকে কলকাতায় গিয়ে সৌমেন গুহের কাছে সুপার এইট ফিল্ম নির্মাণের তালিম নিয়েছিলেন অমিতাভ সেনের মত উদ্যোগী তরুণ।
এ কথা ঠিক এখন নেটফ্লিক্স, মুবি প্রভৃতির সৌজন্যে ঘরে বসে বিশ্বের বিভিন্ন ঘরানার ছবি দেখা সম্ভব। একটু পুরনো ক্লাসিক তো বিনা দক্ষিণায় ইউটিউবেই দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু শুধু দেখতে পেলেই তো হল না, ভাল সিনেমা দেখা একটা পরিপূর্ণ বোধের সাধনা। তার জন্য দর্শককে প্রস্তুত হতে হয়। নয়তো আজ যদি আমি হঠাৎ কিম কি দুক বা তারকোভস্কির ছবি দেখতে বসি আমার মনোযোগ তা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারবে না। বর্তমান প্রজন্মের দর্শক বলতে পারেন আগেও কি সব দর্শক ভাল ছবির অনুরাগী ছিলেন? ঋত্বিক ঘটক কি নিজেই দর্শকদের সারি সারি পাঁচিল বলেননি? বিদেশি ছবি দেখার যে আগ্রহ দেখা যেত, তা চলচ্চিত্র উৎসবেই হোক বা ফিল্ম সোসাইটির প্রদর্শনীতে, তার মধ্যে আনসেন্সরড যৌনতা দেখার আগ্রহী দর্শকের সংখ্যাও কিছু কম ছিল না। এসব সত্ত্বেও সিনেমাকে ঘিরে যে মাদকতা ছিল তা মানুষকে স্বপ্ন দেখাত।
এই মুর্শিদাবাদের মাটিতে জন্মগ্রহণ করে গোটা বিশ্বকে আবিষ্ট করার মত সিনেমা তৈরি করেছিলেন ‘কিনোখ্যাপা’ ঋত্বিক ঘটক। এখানকার কৃষ্ণনাথ কলেজের ছাত্র প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য অন্য ভুবনের স্বপ্ন চোখে নিয়ে নির্মাণ করেছেন ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’- র মত ছবি। মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায় মলয় রায়চৌধুরীর বিতর্কিত কবিতা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ অবলম্বনে ছোট ছবি বানিয়ে অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতে নিয়েছেন। আজও হয়ত ডিজিটাল ক্যামেরা হাতে বিস্ফোরক কোনও ছবি তৈরির স্বপ্ন দেখছেন এই জেলার কোনও তরুণ সিনেপ্রেমী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy