‘টনিক’-এ দেব-পরান।
দেব আমার বন্ধু? নাকি আমার সন্তান! সহ-অভিনেতা, প্রযোজক, আমার হৃত যৌবন পুনরুদ্ধারের টনিক!
কোন পরিচয় দিই দেবের? উপরে বলা সব কটা পরিচয়েই যে আমরা পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত। আমি বরং শুরু করি তারও আগে চেনা দেব-কথা দিয়ে। আমি তখন ‘মীরাক্কেল’-এর বিচারক। দেব এসেছিল অতিথি হয়ে। তত দিনে ভালই নাম করে গিয়েছে। শ্যুটের ফাঁকে বসে আমরা সবাই আড্ডা দিতাম। তখনই আমার গা ঘেঁষে বসেছিল। এ কথা সে কথার পরে হঠাৎ বলল, ‘‘আমার যেটা হওয়ার নয়, সেটা তো হয়েই গিয়েছে। এত নাম-ডাক হওয়ার কথা ছিল না। আমার এখন একটাই স্বপ্ন। বাবাকে নতুন বাড়ি করে দিতে হবে।’’ কী আবেগ নিয়ে দেব সে দিন কথাগুলো বলেছিল, নিজে না শুনলে কেউ বুঝবেন না। আমি সে দিন এক সন্তানের গলায় তার বাবার জন্য আকুতি ঝরা শুনেছিলাম। ওর কথায় বাবার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা, কৃতজ্ঞতা মিলেমিশে একাকার। দেবের আরও বড় গুণ, ও মাটির কাছাকাছি থাকতে ভালবাসে। উঁচুতে উঠেও নিজের অতীত ভোলেনি। আমি সে দিন থেকে দেবের অনুরাগী।
সেই দেব অধিকারী ‘টনিক’-এর সহ প্রযোজক। আমার সহ-অভিনেতা। ছবিতে সে-ই 'টনিক'। সেই সাক্ষাৎ আর এই সাক্ষাতের মধ্যে দিয়ে অনেকটা সময় বয়ে গিয়েছে। ‘পাগলু’, ‘পাগলু ২’, ‘চ্যালেঞ্জ’, ‘দুই পৃথিবী’র সীমানা পেরিয়ে দেবও পরিণত। তার ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘কবীর’, ‘চ্যাম্প’, ‘পাসওয়ার্ড’, ‘সাঁঝবাতি’ দেখে ফেলেছি। রাজনীতির পাশাপাশি একটি ছেলে পর্দাতেও কী অনায়াস! নিজেকে ক্রমশ ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে চলেছে। অন্য ধারার বাণিজ্যিক ছবির সঙ্গে যার বিন্দুমাত্র পরিচয়ই ছিল না। কিন্তু শিখে নিতে কতক্ষণ। কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা ছেলেটি শিখতে খুব ভালবাসে। আবার একা শেখে না! পাঁচ জনকে নিয়ে সব কিছু করে।
এই যেমন, ‘টনিক’-এর দৌলতে দেব আমায় আকাশে উড়তে শেখাল। ১৯৬৬-এর পরে আবার সাইকেলে চাপাল। পাহাড়ে চড়তে শেখাল। খরস্রোতা নদীর বুকে নিঃসংকোচে ঝাঁপিয়ে পড়তেও শেখাল। ফেনিল বাথটাবে গা ডুবিয়ে পানপাত্র হাতে ফ্যান্টাসি উস্কে দিতে আমার ভয়ানক আপত্তি ছিল। সেটাও করিয়ে নিল আমায় দিয়ে! দেখলাম, লোককে কী ভাল বশ করতে জানে। নির্দেশ নয়। অনুরোধ-আবদারও নয়। একদম বন্ধুর মতো মিশে যায়। ‘‘কাকা, তুমি এটা করবে না? বেশ, কোরো না। পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে কিন্তু এটা করছে। তুমি পারবে না তা-ও কি হয়!’’, এই সব বলে আমায় উস্কে দিত। তার পর দেখি, কখন যেন শটগুলো দিয়ে ফেলেছি। ছবি হওয়ার পর থেকে আমি বারবার স্বীকার করেছি, দেব না থাকলে আমার এই ছবিই করা হত না। এত সাহসী শট দিতে পারতাম না। হয়তো পারতাম ফেলে আসা কোনও এক সময়ে। ৮২-তে কোনও মতেই নয়!
‘টনিক’-এ একটা দৃশ্য ছিল। আবেগে ভরা। ওই ধরনের দৃশ্যে দেব অভ্যস্ত নয়। ও এর আগে এ রকম দৃশ্য হয়তো করেওনি। পর্দায় আমরা মুখোমুখি বসে। অতীত স্মৃতিতে ডুব দিয়েছি। একে অন্যের সমব্যথী। সংলাপ বলতে বলতে একে অন্যকে বুকে টেনে নেব। আমাদের চোখ ভিজবে চোখের জলে। দেবের গুণে ওই দৃশ্যে অভিনয় করতে করতে আমি বুঁদ। ২০০৯ সালে বাবাকে নিয়ে দেবের বলা কথাগুলো কানে বাজছে। সেই দৃশ্যে কাঁদতে আমার একটুও কষ্ট হয়নি! সে দিন অভিনেতা পরান বন্দ্যোপাধ্যায় কাঁদেনি। কেঁদে ফেলেছিল পিতা পরান বন্দ্যোপাধ্যায়। আমিও তো সন্তানের বাবা।
আমার মধ্যে অনেক স্বপ্ন ঘুমিয়ে ছিল। হয়তো অনেক ইচ্ছেও। সব অনুভূতি মরে গেলে আমিও তো আর অভিনয় করতে পারব না। কিন্তু কিছু জিনিস চাপা পড়ে গিয়েছিল। দেব সময়ের ধুলো সরিয়ে নতুন করে তাকে জাগিয়ে দিয়েছে। কখনও ভালবেসে। কখনও ‘কাকা’ বলে ডেকে। কখনও ছলে-বলে-কৌশলে। তবু জাগাল তো! কাজ শেষের পরে পুরোটাই আমি খুব উপভোগ করেছি। আরও একটা দৃশ্যের কথা কখনও ভুলব না। সেই দৃশ্যে দেব আমায় পাঁজাকোলা করে নিয়ে উঠে দাঁড়াবে। পুরোটা যখন ক্যামেরাবন্দি হল, মনে মনে আশীর্বাদ করেছিলাম ওকে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, এই প্রাণপ্রাচুর্য, অসীম শক্তি নিয়ে ছেলেটা যেন শতজীবী হয়। আমার মতো অনেককেই হয়তো নবজন্ম দিতে হবে হবে ওকে।
দেব, তোর এ বছরের জন্মদিনে আমিও যে আবার জন্ম নিলাম রে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy