মৃণাল সেনের জন্ম শতবার্ষিকীতে প্রয়াত পরিচালকের স্মৃতিচারণায় বর্ষীয়ান অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিক। ফাইল চিত্র।
মৃণাল সেনের জন্ম শতবার্ষিকী! ভাবতেই মনের মধ্যে একরাশ স্মৃতি ভিড় করে আসছে। কিন্তু এই বিশেষ দিনে ওঁর স্মৃতিচারণ করতে গেলে প্রথম থেকেই শুরু করা উচিত। আজকে আমার যে পরিচিতি বা অভিনয়ে আসা, তাঁর পিছনে ওঁর অবদান অনস্বীকার্য। অভিনয়ে আসার আগে মৃণালবাবুর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। পরিচয়টা করিয়ে দিয়েছিলেন আমার কাকা বিমল চন্দ্র মল্লিক। আমি কারও মাধ্যমে জানতে পেরেছিলাম যে মৃণালবাবু কলকাতার নতুন প্রজন্মের সমস্যা নিয়ে ছবি তৈরি করবেন। ১৯৭০ সালে সেই সূত্রে ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ।
কাকার নির্দেশ মতো এক দিন মৃণালবাবুর কাছে গিয়ে হাজির হলাম। জিজ্ঞাসা করলেন কখনও অভিনয় করেছি কি না। এ দিকে আমি তো কোনও দিন অভিনয় করিনি। দুর্গাপুজোর সময় বাড়িতে নাটকে কিছু অভিনয় করেছি, সে কথা ওঁকে জানালাম। সেই সঙ্গে ওঁকে এটাও বললাম যে উনি যে বিষয়ে ছবি করতে চলেছেন সেটা কিন্তু আমার জানা। কারণ চারপাশে আমার বন্ধুদের কাছেও আমি একই সমস্যা শুনেছি— বেকারত্ব বাড়ছে। শুনে একটু গম্ভীর হয়ে কিছু ভাবতে শুরু করলেন। তার পর আমাকে স্ক্রিন টেস্ট নেওয়ার জন্য একটা ডেট দিলেন। আমি তো খুশি হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
দিন কয়েক পর স্ক্রিন টেস্ট। লোকেশন— লেকের ধার। সকাল সকাল মৃণালবাবু সেখানে উপস্থিত। ক্যামেরাম্যান ছিলেন কে কে মহাজন। মৃণালবাবু ক্যামেরার পিছন থেকে বললেন, ‘‘রেগে যাও, হাসতে থাকো, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকো।’’ আমিও সেই মতো করতে থাকলাম। পরে জানতে পারলাম আমি নির্বাচিত হয়েছি। ছবির নাম ‘ইন্টারভিউ’। আমার কেরিয়ারের প্রথম ছবি। সত্যি বলতে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। কারণ এর আগে আমাদের বাড়িতে কেউ সিনেমায় কখনও অভিনয় করেননি। আমারও কোনও প্রশিক্ষণ ছিল না। কিন্তু বাড়িতে সংস্কৃতি চর্চার একটা পরিবেশ ছিল। বাবা, কাকা, দাদা— প্রত্যেকেই অল্পবিস্তর গান বা আবৃত্তি করতে পারতেন। তার পর তো মাস খানেক বাদে শুটিংও শুরু হয়ে গেল।
মৃণাল সেনের ছবি। এ দিকে আমি অভিনয় জানি না। আবার অভিনয় করলেই তো হল না, প্রযুক্তির বিষয়টাও বুঝতে হবে। মুখে লাইট নেওয়া, ট্রলির সঙ্গে হাঁটা— এ দিকে আমি সে সব কিছুই জানি না। খুবই ভয়ে ভয়ে ছিলাম। কিন্তু উনিও বুঝতে পেরেছিলেন, ছেলেটার পিছনে খাটতে হবে। ওঁর সঙ্গে শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা বলতে হলে আমি তিনটে বিষয় উল্লেখ করতে চাই। তা হলে আজকের তরুণ পরিচালকেরাও হয়তো অনুপ্রাণিত হবেন। ইন্ডাস্ট্রিতে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অভিনয় করছি, কিন্তু এই জিনিসগুলো আমার আজও মনে আছে।
১) বাস্তব জীবন এবং পর্দার জীবনকে কী ভাবে মিলিয়ে দিতে হয় সেটা আমি ওঁর থেকেই শিখেছিলাম। ‘ইন্টারভিউ’ ছবিতে ট্রামের মধ্যে একটা দৃশ্য, যাঁরা ছবিটা দেখেছেন তাঁদের হয়তো এখনও মনে থাকবে। সেখানে আমি নিজের সম্পর্কে কথা বলছি। ছবিতে আমার নাম, পদবি, এমনকি, বাড়ি ভবানীপুর, সেটাও মৃণালবাবু এক রেখেছিলেন। খুব মজা পেয়েছিলাম। এ রকম ঘটনা আমার কেরিয়ারে আর কখনও ঘটেনি।
২) ছবিতে বাসের মধ্যে একটি পকেটমারকে ধরে আমি থানায় নিয়ে গিয়েছিলাম। থানার সিকুয়েন্সের শুটিং হবে। সহকারীকে বললাম, ভাই কী কী সংলাপ আছে? উনি বললেন, সংলাপ তো কিছু নেই। আমি তো অবাক। ভাবলাম উনি মজা করছেন। বার বার বললাম যে আমি নতুন, অতটা এক্সপার্ট নই। মৃণালবাবুকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, ‘‘ধুর, পুলিশ যা প্রশ্ন করবে, তার উত্তর দিয়ে দেবে।’’ পরে শুধু বললেন, ‘‘মাথায় রাখবে তোমায় তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। কারণ বিকাল ৩টে নাগাদ তোমার একটা ইন্টারভিউ আছে। আর পুলিশ অফিসারের অভিনেতাকে বলে দিলেন যে, এমন অভিনয় করতে যেন উনি আমাকে একটু দেরি করিয়ে দিতে চাইছেন। পুলিশি ফরম্যালিটিজ় সম্পূর্ণ করতে আমাকে একটু আটকে রাখতে চাইছেন। এই করতে করতে শটটা ওকে হয়ে গেল!
৩) আরও একটা মজার বিষয় বলি। এক দিন শুটিং চলছে। মৃণালবাবুকে সংলাপের কথা জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, ‘‘কিছু নেই! যা পারো বলে যাও।’’ আমি ফের অবাক। কিছুই বুঝতে পারলাম না। যাই হোক, উনি যেমন বললেন আমিও সেই মতো করে চললাম। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের ম্যাচ, উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেনের ছবি— যা মুখে এল বলে গেলাম। পরে ছবি দেখতে বসে আমি তো তাজ্জব! ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড পুরো বন্ধ করে দিয়ে আমার ওই অভিব্যক্তিগুলোকে উনি মন্তাজ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। অভিব্যক্তিতে সঙ্গীত জুড়েছেন, কিন্তু কোনও সংলাপ রাখেননি। এ রকম ভাবনা ওঁর মতো একজন জিনিয়াসের পক্ষেই সম্ভব।
পরে মৃণালবাবুর কলকাতা সিরিজ়ের ‘কলকাতা ৭১’ ছবিতেও আমি একটা ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। তবে ‘ইন্টারভিউ’-এর জন্য আমার কেরিয়ারে প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাই। চেক প্রজাতন্ত্রের কার্লোভি ভ্যারি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আমি সেরা অভিনেতার পুরস্কার পাই। দিনটা ছিল ২ অগস্ট। তার পর থেকে শুরু হল এক অন্য সফর। প্রতি বছর ওই দিনে আমি সকাল সকাল মৃণালবাবুর সঙ্গে দেখা করতে ওঁর বাড়িতে যেতাম। একটানা ৪০ বছরেরও বেশি সেই রীতিতে ছেদ পড়ে ২০১৮ সালে ওঁর প্রয়াণে।
দুঃখের বিষয়, মৃণালবাবুর মাত্র দুটি ছবিতেই আমি অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলাম। ওঁর স্ত্রী গীতা বৌদির থেকেও আমি অনেক কিছু শিখেছি। বৌদি খুব ছবি দেখতে পছন্দ করতেন। আমাকে খুব উৎসাহ দিতেন। যখন ওঁদের বাড়ি যেতাম, কুণাল (মৃণাল সেনের পুত্র কুণাল সেন) তখন খুবই ছোট। ওদের দেশপ্রিয় পার্কের পিছনের বাড়িতে অনেক বার গিয়েছি। প্রচুর আড্ডা দিয়েছি। এই প্রসঙ্গেই বলি, অনেকেই হয়তো ভাবেন যে, মৃণালবাবু ছিলেন গুরুগম্ভীর মানুষ। কিন্তু আদতে উনি ছিলেন অত্যন্ত রসিক। শট দিতে না পারলে যেমন বকুনি খেয়েছি, আবার ফ্লোরে মজাও করতেন।
১৪ মে। মৃণালবাবুর জন্মদিন। এই দিনটায় ওঁর কথা খুব মনে পড়ে। এখনও মিস করি। তা ছাড়া বৌদি চলে যাওয়ার পর মৃণালবাবু মনের দিক থেকে খানিকটা ভেঙেও পড়েছিলেন। শেষের দিকেও যখন ওঁর বাড়িতে যেতাম, তখন একটু চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন। প্রাণবন্ত আমুদে মানুষটা যেন হারিয়ে গিয়েছিল। আমাকে দেখে হাসলেও ওঁর চোখ দুটোর মধ্যে ক্লান্তি এবং শূন্যতা বিরাজ করত। ওঁর সব ছবিই আমার দেখা। কাকে ছেড়ে কাকে এগিয়ে রাখব! আমি এখন খুব বুঝেশুনে একটা-দুটো ছবি করি। আগের সেই দর্শকও এখন বদলে গিয়েছেন। মাঝেমাঝে নিজেই একটু ধাঁধায় পড়ে যাই। আন্তর্জাতিক মানের বাংলা ছবির সংখ্যাও কমেছে। তবে বুঝতে পারি, আজকে টালিগঞ্জে মৃণাল সেনের মতো পরিচালকের বড্ড দরকার। আবার ২ অগস্ট আসবে। খুব মনে পড়বে মৃণালবাবুর কথা। শুধু ওঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার কোনও উপায় থাকবে না।
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy