আন্তর্জাতিক ক্যুরিয়র সংস্থার কর্মচারী, বিমান ভেঙে পড়লেন মানবশূন্য এক দ্বীপে। সেই নির্জন দ্বীপটা থেকে গেল, যেমন ছিল ঠিক তেমনই— আমাদের মনের ভিতর। ঘুমের গভীর থেকে যখন-তখন জেগে উঠে ভয় দেখাতে লাগল আমাদের। খাঁ খাঁ নির্জনতার ভয়। যেখানে একা আমি ছাড়া আর কেউ নেই।
যোগাযোগ, যোগাযোগের যন্ত্র আর মাধ্যম তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ইন্টারনেট জেনারেশনের কাছেও নির্জন দ্বীপটা রয়ে গেল একই রকম। নির্জনতায় হারিয়ে যাওয়ার...একলা হয়ে যাওয়ার এই ভয়ের নতুন নাম—নোমোফোবিয়া। নো মোবাইল ফোবিয়া। কলেজপড়ুয়া থেকে সেলেব্রিটি — এই ফোবিয়ায় আক্রান্ত।
সুরকার জয় সরকার বললেন, ‘‘হ্যাঁ, আমি তো এই সময়েরই মানুষ। ইন্টারনেট, স্মার্টফোনের অ্যাপগুলোর সুবিধা নিতে দারুণ অভ্যস্ত। এগুলোই তো আমার যোগাযোগের মাধ্যম। কাজের ক্ষেত্রেও। যেখানে একদম হাতেকলমে কাজ, সেখানটা ছাড়া পুরোটাই ওসবের মাধ্যমে হয়। ওগুলো না থাকলে কী হবে ভাবতেই পারছি না। কিন্তু যখন পাহাড়ে যাই, তখন কারও সঙ্গে যোগাযোগ থাকে না। সে সময় নিজেকে খুব স্বাধীন লাগে। চারপাশটা সাঙ্ঘাতিক ভাবে উপভোগ করি। ডিজিটাল যোগাযোগের জগতের বাইরে থাকলে নিজেকে আবিষ্কার করা যায়, আবিষ্কার করা যায় জীবনকে। তখন কিন্তু ওই যন্ত্রগুলিকে মিস করি না। কিন্তু সেটা তো সাময়িক। জানি, ফিরে এসে ফোনটা অন করলেই আবার সব যোগাযোগ ফিরে পাব, সেগুলো হারাচ্ছে না। হারিয়ে ফেলা তো দূরের কথা, হারানোর কথা ভাবার মতো সাহসটাও যে আমার নেই।’’
অভিনেতা ঋত্বিক চক্রবর্তী অবশ্য এ সব নিয়ে একেবারেই চিন্তিত নন। বলে দিলেন, ‘‘আমি বরং বীতশ্রদ্ধ। সারাক্ষণ কোনও না কোনও ভাবে আমি কানেক্টেড— এই ব্যাপারটাই আমার ভয়ের কারণ। হয় হোয়াটসঅ্যাপ, নয় ফোন, নয় মেল করে যখন তখন যে কেউ আমাকে ধরে ফেলতে পারে। এই ব্যাপারটায় চিরকালই আমার বিরক্তি। এখন সেটা আরও বেড়েছে। আজকাল মনে হয় আমার যেন বিশাল বড় লম্বা একটা টিকি হয়ে গিয়েছে। আর সবাই সেটা ধরে টানছে। ফোনটা হারিয়ে গেলে বা কনট্যাক্টগুলো উড়ে গেলে অসুবিধার একটা জায়গা তৈরি হবে ঠিকই, তবে সেটা ফোবিয়ার চেহারা নেবে না। কাজের বা প্রয়োজনের যোগাযোগগুলো আমি ঠিকই পেয়ে যাব। আর আমাকে যাদের প্রয়োজন, তারাও আমাকে ফাইনালি পেয়ে যাবে। এখন এটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। অবশ্য খুব বেশি ডিপেন্ডেন্ট হয়ে পড়াটা একটা বদভ্যাস। ইন্টারনেট না থাকলে আমার সঙ্গে পৃথিবীর কানেকশন খানিকটা চলে যাবে ঠিকই, আবার থাকবেও। বাইরের জগতের সঙ্গে আমরা অনেকটাই ম্যানুয়ালি কানেক্টেডও। আর নোমোফোবিয়া যদি সত্যিই একটা বড় চেহারা নেয়, তার সমাধান সাইকিয়াট্রিস্টদের কাছেই থাকবে।’’
গায়িকা সোমলতা বললেন, ‘‘ইন্টারনেট ছাড়া আমি ভাবতে পারি, কিন্তু মোবাইল আর কনট্যাক্টস ছাড়া...পারব না। কাজের ক্ষেত্রে এত লোকজন, এত যোগাযোগ, প্রত্যেকের ফোননম্বর মাথায় স্টোর করে রাখার ক্ষমতা আমার অন্তত নেই। শুধু কনট্যাক্টস স্টোর করে রাখার ব্যাপারও নয়, আগে যেমন কেউ কোথাও গেলে চিঠি পাঠাত। লোকে সাত-আট দিন ধরে অপেক্ষা করে থাকত। জানত চিঠি আসবেই। টেনশনের বালাই ছিল না তখন। আর এখন আমাদের মা-বাবারাও মোবাইলে এমন অভ্যস্ত যে, পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে ফোন না করলে টেনশন শুরু। তাই মোবাইল ছাড়া থাকা মুশকিল। ইন্টারনেটটা আমার কাজের সঙ্গে রিলেটেড। হঠাৎ করে কোনও গানের দরকার, সিডিটা কাছে নেই, পাঁচ মিনিটের মধ্যে স্টেজে গাইতে হবে, লিরিকস মনে পড়ছে না, তখন ইন্টারনেট সার্চ করে সেটা দেখে নিতে পারি। তাও... ইন্টারনেট ছাড়া আমার ফোবিয়া হবে না, মোবাইল ছাড়া হতেই পারে।’’
‘‘আমি একটু টেকনোলজিক্যালি চ্যালেঞ্জড,’’ বললেন অভিনেতা-নাট্যকার কৌশিক সেন। তাঁর কাছে বাইরের জগতের খবর জানার জন্য ইন্টারনেট নিশ্চয়ই একটা বড় উপায়। কিন্তু তা একমাত্র রাস্তা নয়। তিনি এও বললেন, ‘‘ইন্টারনেট না থাকলে আমি খুব যে একটা ক্রাইসিসে পড়ব তা নয়। পৃথিবীতে এত রকমের বই আছে, এত গল্প, উপন্যাস— পৃথিবীর খবর রাখার জন্য সেগুলো পড়তে পড়তেই আমার একদিন মৃত্যু হবে।’’ ইন্টারনেটকে সেভাবে গুরুত্ব না দিলেও মোবাইল যে যোগাযোগের একটা অন্যতম মাধ্যম সেটা সাফ জানালেন তিনি। স্ত্রীর উপহার দেওয়া মোবাইলেই সিনেমার ট্রেলর দেখা থেকে নাটকের কাজকর্ম সারেন কৌশিক।
‘‘মোবাইল না থাকার ফোবিয়া! এমন ফোবিয়া কারও হলে বলব বেশ হয়েছে। কিছু দিন ভুগুক। আমি তো ফোন হারাতে অভ্যস্ত। অসুবিধা হয়। আবার অভ্যেসও হয়ে যায়।’’ হাসতে হাসতে বললেন অভিনেত্রী অনন্যা চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায় ‘‘মোবাইল তো কিছুদিন আগেও ছিল না। এখনও শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় মোবাইল ব্যবহার করেন না। দিব্যি তো চলছে। আর মোবাইলের অ্যাপসগুলো আমি প্রায় ব্যবহার করি না বললেই চলে। করলেও নামমাত্র। ইন্টারনেট লাগে শুধু মেল করতে বা কখনও কোনও ইনফরমেশন দরকার হলে। মোবাইল না থাকার ফোবিয়াটা আমার কাছে হাস্যকর’’।
লেখাটা শুরু করা অবধি একটা গানের লাইন কানের পাশে মশার মতো ভোঁ ভোঁ করছিল। ‘‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে, স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে ড্রইংরুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দি...’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy