‘শাস্ত্রী’ ছবির একটি দৃশ্যে মিঠূুন চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
পঞ্চমীর প্রবল ভিড় ঠেলে ‘শাস্ত্রী’ দেখতে আসছি শুনে বন্ধুরা অনেকেই খানিক হাসল। টিটকিরিও দিল, ‘‘তোর আবার জ্যোতিষ-টোতিষে বিশ্বাস হল কবে থেকে!’’... প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে মা দুর্গা এসে গিয়েছেন। বেশ ক’দিন ধরেই রাস্তাঘাটে যানজট। অন্য দিকে, শহরে অনশন চলছে। এই পটভূমিকায় জ্যোতিষ নিয়ে ছবি বললে লোকে হাসবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে ছবি দেখে বেরিয়ে মনে হল, ঠিক উল্টো। অর্থাৎ পরিমল শাস্ত্রী, থুড়ি মিঠুন চক্রবর্তী অভিনীত জ্যোতিষীকে দেখে বরং জীবন ও কর্মের প্রতিই বিশ্বাস ফিরে পেলাম। যে অন্যায়ের জন্য শহরে জমায়েত চলছে, যে অন্যায় ঘটে চলেছে দুনিয়া জুড়ে, সে সব কিছুর প্রতিকার যে স্রেফ মানুষই করতে পারে, ছবির শেষে সে বিশ্বাসকেই হাতে ধরে বাঁচিয়ে দিলেন স্বয়ং মিঠুন।
‘শাস্ত্রী’র পোস্টার আর হোর্ডিংয়ে শহর ছেয়ে গিয়েছে বেশ কিছু দিন হল। একটি সাক্ষাৎকারে মিঠুন বলছিলেন, তাঁর ভাগ্যে বিশ্বাসের কথা। বলছিলেন, ভাগ্য না থাকলে উত্তর কলকাতার একদা নকশাল মিঠুন আজকের বিশ্ববিখ্যাত তারকা হতেন কি না তিনি জানেন না। কিন্তু এটাও স্বীকার করলেন তিনি, এর পিছনে রয়েছে কঠিন শ্রমও। হাতে ক’টা আংটি পরে আর তাবিজ ঝুলিয়ে যদি জীবন বদলে যেত, তা হলে একনিষ্ঠ ও সৎ পরিশ্রমের কোনও দরকার পড়ত না তাঁর।
কথাগুলো ভাবছিলাম ছবিটি দেখতে দেখতে। অধ্যাত্মবাদের দেশ ভারত। হাজার হাজার বছর ধরে এ দেশ থেকে অধ্যাত্মবাদ ছড়িয়ে পড়েছে আবিশ্ব। হাজার হাজার বছর ধরেই অধ্যাত্মবাদকে খণ্ডনের চেষ্টাও হয়েছে। কিন্তু, পারা যায়নি। কারণ, জীবন রহস্যের গভীরে আছে এই নাড়ির যোগ। তা বলে তাই নিয়ে মূর্তিপুজো, ব্যবসা, চালাকি, মানুষকে বোকা বানানোর খেলা খেলে সভ্যতায় বিশেষ সুবিধে করা যায়নি। বারে বারেই ধরা পড়ে গিয়েছে এই সব ভণ্ড বাবা ও তাদের সাগরেদরা। প্রসঙ্গত, সত্যজিৎ রায়ের ‘বিরিঞ্চিবাবা’ ছবিটির কথাই ভাবা যেতে পারে বা ‘সোনার কেল্লা’।
‘শাস্ত্রী’ ছবিটি সেই একই তর্ককে আবারও প্রাসঙ্গিক করতে চেয়েছে। অর্থাৎ, এখানে মিঠুন এক প্রান্তিক জীবনের নায়ক। তাঁর একটা ছোট সংসার আছে। তাঁর স্ত্রী দেবশ্রী রায় অভিনীত চরিত্রটি এক সাধারণ গৃহবধূর, আর রয়েছে ছেলে। কারখানা লক-আউট হওয়ায় ভাগ্যের ফেরে তাঁকে নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি নিতে হয়। কিন্তু ক্রমেই ফুরিয়ে আসে তাঁর অর্থ, বাড়ে সংশয়। রজতাভ দত্ত অভিনীত প্রোমোটার চরিত্রটির নজর পড়ে তাঁর সেকেলে বাড়ির প্রতি। কিছুতে বাড়ি দিতে রাজি না হওয়ায় ছেলের প্রাণনাশের হুমকি দিতে থাকে সে। তবু নাছোড় হওয়ায়, পুত্রকে আক্রমণ করে কুচক্রীরা। অবশেষে ভগ্নপ্রায় মিঠুনের দেখা মেলে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় অভিনীত এক আশ্চর্য সেল্সম্যান চরিত্রটির সাথে। সে একটি দৈব চশমা দেয়। সেটি পরে নিয়েই ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে ধীরে ধীরে।
কিন্তু এই ভাগ্যের ফেরও সাময়িক। ফাটকা খেলে লটারি জেতা যায়, কিন্তু সত্যিকারের জীবনে বদল আনা সম্ভব নয়। তাই বাইরের জীবন বদলালেও, কাছের মানুষেরা ক্রমেই দূরে সরে যেতে থাকে তাঁর থেকে। এখান থেকেই বাকি ছবির গল্পে আসে চমক, যে চমকের জন্য আপনাকে প্রেক্ষাগৃহে যেতে হবে। তবে এ ছবির সম্পদ, মানুষের প্রতি বিশ্বাস। ছবির শুরু থেকে সন্দেহ ছিল, সোহম চক্রবর্তী অভিনীত যুক্তিবাদী যুবকটি জিতবে, না কি জয় হবে পরিমল শাস্ত্রীর? ছবি এগোতে এগোতে সে সন্দেহ বাড়ছিল, অর্থাৎ ক্রমশ অর্থবান হয়ে ওঠা, বন্ধুর পুত্রের রোগ সারিয়ে দেওয়া, অসংখ্য মানুষের ভাগ্য ফেরানো পরিমলই কি তবে জিতে যাবে? ছবির শেষে এসে আশ্বাস পেলাম, না তা নয়। নিজের অলৌকিক চশমা নিজে হাতেই ভেঙে নিজের ভাগ্যকে মেনে নিতে বাধ্য হলেন পরিমল তথা মিঠুন...!
রজতাভ দত্ত অভিনীত ধূর্ত নেতা চরিত্রটিকে ভাল লাগে। ভাল লাগে অনির্বাণ চক্রবর্তীর গরিব শ্রমিকের চরিত্রও। রজতাভ অভিনীত নেতাটির জ্যোতিষে অতিভক্তি যে তাঁর পতনের কারণ হল, দেখে বিশ্বাস বেড়ে যায়। এ ছাড়া, ছোট সময়ের জন্য হলেও সৌরসেনী মৈত্রকে মানিয়ে গিয়েছে সোহম অভিনীত যুক্তিবাদী যুবকের বান্ধবী হিসেবে। তবে দেবশ্রী রায়কে যে হেতু বহু দিন পর দেখা গেল মিঠুনের বিপরীতে, তাই তাঁকে আরও একটু ব্যবহার করা যেত। যেখানে বদলে যাওয়া স্বামীর চরিত্র মেনে নিতে না পেরে তিনি বাড়ি ছাড়ছেন, সেখানে তাঁর মুখে আরও সংলাপ দেওয়া যেত। মিঠুন অভিনীত পরিমল জ্যোতিষীর জীবনের ওঠাপড়ার মাঝে স্বাভাবিক ছন্দও কখনও কখনও ব্যাহত হয়েছে। একজন মানুষ রাতারাতি ফকির বা ভিখিরি কখনওই হয় না, তিলে তিলে সে জেতে বা হারে, এ ছবিতে অনেক ঘটনা দিয়ে তেমন জেতা আর হারা দেখানো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মিঠুনের চোখে সব সময় সেই আত্মবিশ্বাস ধরা পড়েনি। বরং কখনও কখনও মনে হয়েছে, তিনি ক্লান্ত ও যান্ত্রিক, স্রেফ অভিনয়ের জন্যেই গুছিয়ে সংলাপ বলছেন। তবু বলব, মিঠুনকে ছাড়া এ চরিত্রটিকে ধরা যেত না। কারণ, যান্ত্রিকতা নিয়েও কখনও কখনও যখন তিনি সংলাপ বলেন, উত্তর কলকাতার গৌরাঙ্গ বা ফাটাকেষ্টর সংলাপ, তখন সবটাই বড় বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।
অতিপ্রাকৃত বিষয়ে নবারুণ ভট্টাচার্য তাঁর ‘হারবার্ট’ উপন্যাসে বড় তর্ক রেখেছিলেন। সেখানে অবশ্য শেষে জেতে যুক্তির বাইরের এই অলৌকিক দুনিয়াই। এ ছবিতে এই তর্ককে বড় আপাত ভাবে দেখানো হল,তাই খেদ থেকেই যায়। জ্যোতিষ বা তন্ত্র এক প্রাচীন বিদ্যা। আপাত ভণ্ড মানুষকে দিয়ে তাকে কতটা বোঝা যাবে?হয়তো বাজার চলতি ছবির বিষয় হিসেবে এই আপাত বোঝাবুঝি চলতে পারে। কিন্তু যে মিঠুন ভাগ্যে বিশ্বাস করেন,তাঁর অভিনীত এ বিষয়ের ছবিতে আর একটু বেশি আশা রেখে,অল্প হলেও আহত হয়েছি। পুজোর বাজারে সেটুকু মনখারাপ হয়তো ক্ষণিকের,তবু..!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy