আদিল খান, সাদিয়া।
ছবি: শিকারা
অভিনয়: আদিল খান, সাদিয়া প্রমুখ
নির্দেশনা: বিধু বিনোদ চোপড়া
শোয়ের সময় হয়ে গিয়েছে। কিন্তু টিকিট দেওয়া হচ্ছে না। ক’জন আসবেন দেখতে, তা দেখে চালানো হবে ‘শিকারা’। হলের বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে সাংবাদিক। বাকিরা এক জন-দু’জন করে বেছে নিচ্ছেন অন্য ছবি।
‘‘হঠাৎ শিকারার রিভিউ করবেন কেন, ম্যাডাম? কাশ্মীর বলে? এ ছবি নিয়ে সমস্যা আছে। বেশি লোক না দেখলেই ভাল। যা দেশ, আবার অশান্তি না বাড়ে!’’ ম্যানেজারের কাছে গিয়ে শো চালু করার অনুরোধ জানাতে এমনই উত্তর মিলল। কথাগুলো তখনও যথেষ্ট প্রয়োজনীয় মনে হয়নি। তার পরে অনুরোধের কণ্ঠে চিঁড়ে ভিজেছে। চার জনের জন্য শো চালু হয়েছে। সাজানো কাশ্মীর মন ভরিয়ে দিয়েছে। ছবি শেষ হয়েছে প্রেমের বার্তা দিয়ে।
কাশ্মীরকে লেখা এক প্রেমপত্র। নিজের পরিবারের জন্য। নিজের জন্মভূমির জন্য। ভালবাসার জন্য এ চিঠি। বিধু বিনোদ চোপড়ার ‘শিকারা’ সে বার্তা দিয়েই শেষ হয়েছে। হিংসা আজকাল ঢাকা হয়ে থাকে মিষ্টি কথার মোড়কে। সে ভাবনা উপেক্ষা করে এ ছবিটি দেখে সুখে থাকাও যেত, যদি অনুভূতিতে কিছু কাঁটাতার লাগিয়ে দেওয়া সম্ভব হত। অথবা যদি কাশ্মীরের পরিস্থিতির ছবিটা একটু পরিষ্কার করার চেষ্টা দেখা যেত ‘শিকারা’য়। যদি সত্যের রাজনীতিকরণ না হত আবার করে। যদি না এ ভূখণ্ডের সব সমস্যার বিশ্লেষণে ব্যবহৃত সেই অতি পরিচিত, অতি সরল এক সমীকরণ আবারও ব্যবহার করা হত। ‘হিন্দু বনাম মুসলমানের’ রাজনীতিতে যদি না সহজে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হত কাশ্মীরী পন্ডিত সমাজের ইতিহাসকে।
ছবির দৃশ্যে আদিল খান ও সাদিয়া
উপত্যকা ছেড়ে কাশ্মীরী পন্ডিতদের চলে যেতে হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখের। তাঁদের ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, বাড়ির মেয়েদের অসম্মানিত হওয়া, যত্রতত্র খুন-জখম-লুঠ— সবটাই অতি দুর্ভাগ্যের। এ অন্যায়। সে কথা এ ভাবে বলাও বাহুল্য। তবে এ সমস্যা হঠাৎ এক দিনের নয়। হঠাৎ একটি গোষ্ঠীরও নয়। এ সমস্যা কাশ্মীরের বৃহত্তর সঙ্কটেরই একটি অংশ। স্বাধীনতা পরবর্তী কাশ্মীরের এটা নিত্যদিনের চেহারা। এ সমস্যা সকল মানুষের। গোটা উপত্যকার। শুধু পন্ডিত বা শুধু কাশ্মীরী মুসলমানের নয়। কাশ্মীরী পন্ডিত পরিবারের কলেজ শিক্ষক নায়ক সেই বৃহত্তর সমাজেরই এক জন। তাঁর স্বজন বিয়োগের দুঃখের সঙ্গে কোথাও ফারাক নেই সন্তানহারা হাজার হাজার মায়ের কান্না, ‘হাফ-উইডো’দের হাহাকারের। সে কথা কেন কোথাও ধরা দেয় না? যখন কোনও এলাকা বা সমাজ হিংসায় জ্বলে ওঠে, তখন সেখানকার মানুষ নানা ভাবে আক্রান্ত হন। সেখানে আসলে ধর্ম থাকে না। সে যন্ত্রণা ধর্মের রাজনীতির উর্ধ্বে। সে কথা বার বার যেন ভুলে গিয়েছে দেশভাগ চর্চা, রোহিঙ্গাদের সঙ্কট নিয়ে চর্চা, কাশ্মীর সমস্যা চর্চাও। এবং তেমনটাই আবারও হল। সময় বুঝেই যেন হল।
আরও পড়ুন: মুভি রিভিউ ‘মলং’: ক্লাইম্যাক্স আর অভিনয়ের মুন্সিয়ানাই বাঁচিয়ে দিল এ যাত্রা
অর্থাৎ, এত দিনের জল্পনা, ভয়, এক অর্থে সত্যিই হল। জনস্বার্থ মামলা হয়েছে এই ছবিটি আটকানোর জন্য। দেশের মানুষের মধ্যে আরও হিংসার আগুন না জ্বালানোর জন্য আর্জি জানানো হয়েছে। তবু ‘শিকারা’ দর্শন দিয়েছে পর্দায়। অবশ্যই দেবে। ছবি আটকে যে মন বদলানো যায় না। ভুল ধারণাও ভঙ্গ করা যায় না। কাশ্মীরী পন্ডিতদের ঘর ছেড়ে আসার কথা তবে বলা হবে না কেন? অবশ্যই হবে। তবে কখন হল? কী ভাবে হল? সে দিকেও যেন একটু নজর রাখি আমরা।
আসলে এই সময় বুঝে কিছু কথা বলা আর কিছু না বলা শুধু ভারতের নয়, গোটা বিশ্বের সমস্যা। রাজনীতি বিভিন্ন সময়ে ধর্মকে নানা ভাবে ব্যবহার করে। কাশ্মীরে তা বার বার হয়েছে। আরও অনেক বার হবে। তবে এত দিন পরে যখন কাশ্মীরী পন্ডিতদের নিয়ে বড় পর্দায় কথা উঠেছে, তখন বোধহয় এ ভূখণ্ডের ইতিহাসটা আর এক বার ভেবে দেখার সময় এসেছে। হঠাৎ মোদী-শাহের রাজত্বে উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজের উপরে অত্যাচার নিয়ে একপাক্ষিক হাহাকার করা চলচ্চিত্র বিশেষ সুবিচার করে না সে ইতিহাসের প্রতি। তাকে আর যা-ই বলা হোক না কেন, কাশ্মীরকে লেখা প্রেমপত্র তো বলা চলেই না। খুব বেশি হলে বলা যেতে পারে, কাশ্মীরীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রশক্তির হাতে তুলে দেওয়া আরও এক হাতিয়ার। যেখানে ফুলের মতো সুন্দর দুই যুবক-যুবতীর সুখের সংসার বয়ে যায় একটি হিংস্র জাতের মানুষের হিংসার আগুনে। সে আগুন কোথা থেকে এল, সে আগুনে ওঁদের মতো পন্ডিত সমাজের কিছু মানুষ ছাড়া আর কারা পুড়লেন? সে সবের দিকে ফিরেও যাতে না তাকাতে হয় দর্শককে, তার ব্যবস্থা করা আছে অতিরিক্ত গ্লিসারিন ঢেলে চোখে জল আনা সে প্রেমগাঁথায়।
রাহুল পন্ডিতা-র লেখা ‘আওয়ার মুন হ্যাজ ব্লাড ক্লটস’ অবশ্যই অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ এ সময়ের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে। সে লেখার উপরে ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে ‘শিকারা’র কাহিনি। রাহুল পন্ডিতা নিজেও কাজ করেছেন এ ছবি তৈরির জন্য। তাতে অবশ্যই পেশাদার দেখিয়েছে কাশ্মীর নিয়ে পেশ করা গবেষণা। আর তাতেই কি আরও দূরে চলে গিয়েছে কাশ্মীরের একটি সম্প্রদায়ের মানুষ? আরও জটিল হল কি ভাবনা? এ সময়ে এ দূরত্বের খুব প্রয়োজন ছিল কি?
আরও পড়ুন: ডিসেম্বরেই বিয়ে করছেন আলিয়া-রণবীর
দিনের শেষে রুপোলি পর্দার একটি এন্টারটেনমেন্ট ভ্যালু থাকে। কতটা বিনোদনমূলক হল সে ছবি, তাতেই ধরা থাকে সাফল্য। সুন্দর ফ্রেম, সুন্দর নায়ক-নায়িকা সে কাজের অনেকটাই করে দিয়েছেন। অভিনয়ের দিক থেকে অবশ্যই অতি উন্নত নয় তাঁদের কাজ, তবে কখনও কখনও মন্দ লাগে না সাদিয়া আর আদিলের রসায়ন। প্রায় আশিটি ফ্রেমে তাঁদের দু’জনের একসঙ্গে উপস্থিতিই কি আসলে ছিল সেই ম্যাজিক বড়ি, যার মধ্যে দিয়ে কখন কান্নার ছলে নতুন করে হিংসা ঢুকে গেল মনে?
অবশ্যই কষ্ট করেছেন তাঁরা। রিফিউজি ক্যাম্পে কেটেছে বছর কুড়ি। রাহুল পন্ডিতা-র গল্প নিশ্চয় নাড়া দেয়। কাশ্মীর থেকে দেশের অন্য প্রান্তে আসার পরে শরণার্থীদের পরিস্থিতি, ক্যাম্পের জীবনঅবশ্যই দেখানো প্রয়োজন ছিল। কী ভাবে কেটে গিয়েছে এতগুলো বছর, যা কি না কারও কারও ক্ষেত্রে অর্ধেক জীবন— দেখা দরকার। শুধু সব আখ্যান ধর্মের গেরোয় ফেঁসে না থেকে শিল্পের উপযোগী কিছু কাজ করতে পারত। বিভিন্ন যুগেই তো ঋত্বিক ঘটকদের প্রয়োজন পড়ে। যাঁরা কি না দেখাবেন মানুষের জীবন, শুধু মানুষ হিসেবে। হিন্দু বা মুসলমান হিসেবে নয়। সে খামতিটাই আসলে চোখে পড়ে বারবার রিফিউজি ক্যাম্পের জীবন, মুসলমান বন্ধুর আচরণ, বারবার রক্তপাত আর হাহাকারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy