‘পিপ্পা’ ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত।
ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেয়েছে রাজা কৃষ্ণ মেনন পরিচালিত ছবি ‘পিপ্পা’। আর মুক্তির পর থেকেই নানাবিধ কারণে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে সেই ছবি। তবে মূল বিতর্কের নেপথ্যে ছবিতে ব্যবহৃত একটি গান। কাজী নজরুল ইসলাম সৃষ্ট ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’। ছবিমুক্তির পর সেই গানের খোলনলচে একেবারে বদলে দেওয়ার অভিযোগ তুলে সরব হয়েছেন বাংলার শিল্পী মহল এবং সঙ্গীতপ্রেমীদের একাংশ। নজরুলগীতি ‘ভাঙার গান’ একেবারে ভেঙে ফেলার দায় এসে পড়েছে দেশের অন্যতম ‘শ্রেষ্ঠ’ সঙ্গীত পরিচালক এ আর রহমানের ঘাড়ে। কারণ, ছবিতে যে সুরে এই গান গাওয়া হয়েছে, সেই সুরের স্রষ্টা রহমানই। সেই অর্থে, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’-এর নতুন ‘রূপকার’ তিনিই। সঙ্গীতশিল্পী এবং প্রেমীদের অধিকাংশেরই দাবি, রহমান গুণী হলেও নজরুলের গান নিয়ে সঠিক বিচার করেননি তিনি। গানের সুর বিকৃতি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে এক যোগে প্রতিবাদও শুরু হয়েছে। উদারবাদীদের কেউ কেউ সেই সুর ‘হজম’ করে নিলেও বাংলার শিল্পী মহলের অধিকাংশই প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। বিস্তর লেখালেখি শুরু হয়েছে সমাজমাধ্যম থেকে সংবাদমাধ্যমে। কেন সেই সুর বিকৃতি হল, কী ভাবে হল তা নিয়ে তর্ক চলছে। হয়তো আরও কিছু দিন চলবে। আরও পরে সেই বিতর্কে প্রলেপও পড়বে। তবে ছবিতে গানটির প্রয়োগ নিয়ে সে ভাবে কাউকে কথা বলতে দেখা গেল না। কোন দৃশ্যে সেই গান ব্যবহার হয়েছে, কতটা ব্যবহার হয়েছে, তার হিসাব কষল আনন্দবাজার অনলাইন।
ছবির প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালের ভারত-পাক যুদ্ধ। গল্পের মূল হিরো ‘পিপ্পা’ অর্থাৎ, পিটি-৭৬ ট্যাঙ্ক। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাক সেনাদের নাস্তানাবুদ করতে রাশিয়ার থেকে কেনা এই ট্যাঙ্ক রণপ্রাঙ্গণে নামিয়েছিল ভারত। ট্যাঙ্ক সামলানোর দায়িত্ব ছিল ভারতীয় সেনার ৪৫ ক্যাভালরি রেজিমেন্টের উপর। মাটির পাশাপাশি জলেও চলতে পারত ট্যাঙ্কটি। আর সেই কারণেই রেজিমেন্টের তরফে ট্যাঙ্কের নামকরণ করা হয় ‘পিপ্পা’। পঞ্জাবিতে যার অর্থ ‘ফাঁকা ঘিয়ের কৌটো’। বাংলাদেশের গরিবপুরের যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল ‘পিপ্পা’। সেই গল্পই মোটামুটি ভাবে তুলে ধরা হয়েছে ছবিতে। পাশাপাশি এই ছবিতে ধরা পড়েছে এক সেনা পরিবারের তিন ভাইবোনের গল্প, তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্কের বোঝাপড়া এবং কী ভাবে একসঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন তিন জনেই। তিন ভাইবোনের চরিত্রে ঈশান খট্টর, প্রিয়াংশু পাইনুলি এবং ম্রুনাল ঠাকুরের অভিনয় ভাল হলেও তা মনে দাগ কাটার মতো নয়।
এই ছবিতে যুদ্ধ নিয়ে আহামরি কিছু নেই। খুব নতুনত্ব নেই ছবির গল্পেও। তবে ইতিহাসের ছোঁয়া রয়েছে। এই বিষয়ে এর আগে ভারতবর্ষে যে ছবি তৈরি হয়নি তেমনটা নয়। ইতিহাসের বই ঘেঁটে এবং প্রায় এক ডজন সিনেমা দেখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি অনেকেরই জানা। তাই যুদ্ধ নিয়ে নতুন কিছু দেখার নেই ছবিতে। ছবিতে, তিন ভাইবোনের সম্পর্কের যে ওঠানামা দেখানো হয়েছে, তা-ও সে ভাবে মনে ধরেনি।
এ বার আসা যাক ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গান এবং সেই গান নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্কের কথায়। ছবিতে পুরো গান ব্যবহার করেননি রহমান। ছবিতে মেরেকেটে ৪৭ সেকেন্ড রয়েছে নতুন সুরের নজরুলগীতি। সেই সুর নিয়েই যত বিতর্ক। তবে গানের প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সুবিচার করেননি নির্মাতারা। ছবির যে দৃশ্যে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি ব্যবহার হয়েছে, তাতে গানটির ঐতিহাসিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। গুরুত্বও হারিয়েছে।
ছবির গল্পে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করতে নাম ভাঁড়িয়ে বাংলাদেশে যান এক ভারতীয় সেনা। এক দৃশ্যে দেখা গিয়েছে, সেই ভারতীয় সেনাকে নিয়ে আনন্দে মেতেছেন জনা কয়েক মুক্তিযোদ্ধা। তাঁকে ‘সর্ষে ইলিশ’ রেঁধে খাওয়ানোর কথা ভাবছেন। একই সঙ্গে চলছে আমোদপ্রমোদ। গলা ছে়ড়ে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গান গাইছেন (অন্য সুরে) মুক্তিযোদ্ধারা। গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বনফায়ার ঘিরে নেচেও চলেছেন। সুর নিয়ে বিতর্ক তো হয়েছে, ব্যবহার নিয়েও কম বিতর্ক হওয়ার কথা নয়। কিন্তু হয়নি।
ইতিহাস বলছে, নজরুল ইসলামের যে সব সৃষ্টির কারণে তিনি ব্রিটিশ রাজশক্তির রোষে পড়েছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ‘ভাঙার গান’। সেই সৃষ্টিরই অংশ ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’। নজরুলের এই সব রচনাই তাঁকে ‘বিদ্রোহী’ কবির তকমা এনে দিয়েছিল। অথচ বাঙালি চিত্তে আগুন জ্বালানো সেই গান ব্যবহার হলে আগুন ঘিরে নাচার জন্য!
১০০ বছরেরও বেশি আগে এই গান রচনা করেছিলেন বাঙালি কবি নজরুল। ১৯২১ সালে জেলে যেতে হয় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে। নজরুল ‘ভাঙার গান’ লিখেছিলেন চিত্তরঞ্জনের স্ত্রী বাসন্তী দেবীর অনুরোধে। শোনা যায়, ১৯২২ সালের ২০ জুন কবিতা হিসাবে প্রকাশিত হয় সেটি। পরে নাকি হুগলির জেলে দেশবন্ধু ও অন্য বন্দিরা একসঙ্গে এই গান গাইতেনও। রোষে পড়েন নজরুল। গানের কথায় বন্দিশালায় আগুন জ্বালানো, তালা ভাঙার মতো শব্দ এবং তার প্রভাব জনমানসে পড়তে দেখে তড়িঘড়ি ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ করে এই গান।
ইতিহাস বলছে, পরবর্তী কালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল ‘ভাঙার গান’। সংশ্লিষ্ট মহল এ-ও বলছে, ‘পিপ্পা’ ছবিতে যেমন দেখানো হয়েছে, তেমন ভাবে অনুপ্রেরণা জোগায়নি। জুগিয়েছিল আরও উঁচু সুরে। আরও উঁচু লয়ে। যে সুর এবং লয় এক সময় ভারতের হাজার হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং পরবর্তী কালে মুক্তিযোদ্ধাদের গর্জে উঠতে সাহায্য করেছিল ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি সেনার বিরুদ্ধে। এমন যার ইতিহাস সেই গানের সুর বদলে দিয়েছেন রহমান। যা নিয়ে এখন বিতর্ক। নির্মাতাদের দলে কোনও বাঙালি রয়েছেন কি? থাকলে কি বিতর্ক আটকানো যেত? থেকেও কি আটকাতে পারেননি? কোনও উত্তরই জানা নেই। তবে ‘লৌহ কপাট’ বিতর্কের পাঁচ দিন পর ক্ষমা চেয়েছেন ছবির নির্মাতারা। বিবৃতিও প্রকাশ করেছেন। চাওয়া উচিতও ছিল বলে অধিকাংশের মত। তবে যাঁর বিরুদ্ধে সুর বিকৃতির মূল অভিযোগ, সেই রহমান কিন্তু এখনও চুপ রয়েছেন। তবে চাইলে এক বার মুখ খুলতেই পারতেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy