গল্পের শুরু রাষ্ট্রকূটদের উপর চোল যুবরাজ আদিত্য কারিকলনের আক্রমণ দিয়ে। ফাইল চিত্র ।
থোড় বড়ি খাড়া, কিন্তু খাড়া বড়ি থোড় নয়।
‘পনিয়িন সেলভান’ (পিএস-১) ছবির প্রথম পর্ব দেখে খানিকটা এই রকমই অভিজ্ঞতা হল। কী নেই এই ছবিতে! এই ছবিতে মণি রত্নমের নির্দেশনা আছে, এ আর রহমানের সঙ্গীত পরিচালনা আছে, চিয়ান বিক্রম-কার্থি-তৃষা-জয়ম রবির অভিনয় আছে। আর আছেন ঐশ্বর্যা রাই বচ্চন। ঐশ্বর্যার কথা আলাদা করে বলার কারণ হল, প্রায় চার বছর পর আবার পর্দায় দেখা দিলেন বচ্চন-বধূ। মণি রত্নমের হাত ধরলেন প্রায় ১২ বছর পর।
এই ছবির গল্প আবর্তিত হয়েছে চোল সাম্রাজ্য এবং সিংহাসনকে ঘিরে। গল্প চেনা চেনা লাগল? ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে রাজারাজড়াদের যত ছবি তৈরি হয়েছে তা ওই সিংহাসন দখলকে ঘিরেই।
গল্পের শুরু রাষ্ট্রকূটদের উপর চোল যুবরাজ আদিত্য কারিকলনের আক্রমণ দিয়ে। যুদ্ধ শেষে যুবরাজ আদিত্য (বিক্রম) নিজের অন্যতম বিশ্বস্ত সেনাপতি ভান্থিয়াথেবন (কার্থি)-কে গুপ্তচর হিসাবে পাঠিয়ে দেন চোল রাজ্যের উপর কাদের কুনজর রয়েছে তা খুঁজে বার করতে। রাজার প্রতি অগাধ ভরসা থেকে আমতা আমতা করেও গুপ্তচরবৃত্তিতে বেরিয়ে পড়েন তিনি। সেখান থেকেই আস্তে আস্তে খুলতে থাকে ছবির জট। গল্পের মাঝে আসেন যুবরাজ আদিত্যের ভাই যুবরাজ পনিয়ন সেলভান (জয়ম রবি)। গল্প যত গড়ায় ততই বোঝা যায়, বাইরের শত্রুর থেকে ভিতরের শত্রুর সংখ্যা বেশি। চোল বংশ ছাড়া আরও কিছু দক্ষিণ ভারতীয় রাজবংশের উল্লেখ রয়েছে এই ছবিতে। তবে তাদের অধিকাংশই চোলদের শত্রু।
ক্যামেরার পিছনে ছিলেন ‘জগ্গা জাসুস’ এবং ‘সঞ্জু’র মতো হিন্দি ছবির চিত্রগ্রাহক রবি বর্মণ। চিত্রগ্রাহক হিসাবে তাঁর হাতের কাজ নিয়ে কোনও প্রশ্ন এক বারের জন্যও মনে আসেনি। সম্পাদনা করেছেন একাধিক জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এস শ্রীকর প্রসাদ। বলা ভাল, মেদহীন সম্পাদনা গল্পের উত্তেজনা ধরে রাখতে সাহায্য করেছে।
ছবির ‘অ্যাকশন’ দৃশ্যগুলি কিন্তু খুব একটা মনে রাখার মতো নয়। বরং যুবরাজ পনিয়ন সেলভানের সিংহল সাম্রাজ্য আক্রমণ করার দৃশ্যের সঙ্গে ‘ট্রয়’ (২০০৪) ছবির সমুদ্রসৈকতে একটি লড়াইয়ের দৃশ্যের বেশ মিল পাওয়া যায়।
এই ছবির সঙ্গীত নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। মণি রত্নম-রহমান জুটি এর আগেও বহু বার পর্দায় জাদু তৈরি করেছে।
‘পিএস-১’-এর সেটও খুব পরিপাটি করেই সাজানো হয়েছে। প্রতিটি দৃশ্যে যতখানি দরকার ঠিক ততটুকু প্রপের ব্যবহার দেখার মতো। কিছুই অতিরিক্ত মনে হয়নি। তবে যাঁদের ইতিহাসের প্রেক্ষাপট নিয়ে সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর তৈরি ছবিগুলির সেটসজ্জা পছন্দ, তাঁদের এই সেটসজ্জা খুব একটা এলাহি লাগবে না।
তা হলে নতুনত্ব কী রয়েছে এই ছবিতে? গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে কেনই বা আপনি এই ছবি দেখতে যাবেন? চোল সাম্রাজ্যের গল্প? উঁহু, তা নয়। অন্য ইতিহাসের রাজারাজড়াদের ছবির মতো এই ছবিতে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া নেই কে ভাল, কে খারাপ। প্রতিটি চরিত্রেই একটা ধূসর ছায়া রয়েছে। প্রত্যেকেরই নিজস্ব উদ্দেশ্য, লোভ আর স্বার্থ রয়েছে। কাউকে খারাপ বলে দাগিয়ে দেওয়ার বিষয় এই ছবিতে নেই।
চিত্রনাট্যে চরিত্রের সংখ্যা অনেক বেশি। সেই চরিত্রগুলিকে পর্দায় মেপে মেপে জায়গা করে দিয়ে তাদের গুরুত্ব বোঝানোর বিষয়েও মণি রত্নম নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। আবার ছবির শেষে বেশ কিছু রহস্যও রেখে দিয়েছেন মণি রত্নম। বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তরও না-পাওয়াই থেকে গিয়েছে।
আরও কয়েকটি সূক্ষ্ম বিষয় রয়েছে বটে। গল্পের পুরুষ চরিত্রেরা কেমন জৌলুসহীন। মহিলারা বেশি সপ্রতিভ, তীক্ষ্ণ। রাজনীতিতেও পারদর্শী। পুরুষদের যুদ্ধ করার সাহস-শক্তি রয়েছে। কিন্তু ঘটে বুদ্ধিটা কেমন যেন কম বলেই মনে হল। কিন্তু সেই জায়গায় তৃষা-ঐশ্বর্যা অভিনীত চরিত্রদের বুদ্ধি (পড়ুন, কূটবুদ্ধি) অনেকটাই বেশি। তাঁদের মধ্যে পরিস্থিতি বদলানোর ইচ্ছা যেন পুরুষ চরিত্রগুলির চেয়ে একটু বেশি। মহিলা নৌচালকের একটি চরিত্রে অভিনয় করে নজর কেড়েছেন ঐশ্বর্যা লক্ষ্মী। ইতিহাস ঘাঁটলেই পাওয়া যায়, চোলেদের শাসনকালে মহিলাদের সম্ভ্রম অনেক বেড়ে গিয়েছিল। পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাঁরাও বিভিন্ন বিষয়ে অংশগ্রহণ করতেন। এ ছবিতে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।
আবার চোল সাম্রাজ্যের রাজত্বকালে সমাজের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি এই গল্পে খুব একটা বোঝা না গেলেও ধর্মীয় ভাবনা খুব ভাল ভাবে ফুটে উঠেছে। চোলেরা ছিলেন কট্টর শৈব। তাদের শাসনকালে বৈষ্ণবরা যে খানিক অস্তিত্বসঙ্কটে পড়েছিলেন, তা-ও এই ছবিতে বোঝানো হয়েছে।
এ বার আসা যাক এই ছবি দেখার মূল কারণে— ঐশ্বর্যা। ছবিতে তিনি চোল সাম্রাজ্যের কোষাগারের কোষাধ্যক্ষ পেরিয়া পঘুভেত্তারাইয়া (আর শরথকুমার)-র স্ত্রী নন্দিনী। তার প্রতি দুর্বল যুবরাজ আদিত্যও। এই ছবিতে ঐশ্বর্যার সৌন্দর্যকে আরও ফুটিয়ে তুলেছে দক্ষিণ ভারতীয় রাজবেশ। ছবিতে চোল সাম্রাজ্যের রাজনীতিতে ক্ষমতার হাতবদল করানোর চেষ্টাও করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। কিন্তু ঐশ্বর্যার অভিনয় দক্ষতা সে ভাবে লক্ষ করা যায়নি। যে দু’একটি দৃশ্যে চোখ দিয়ে অভিনয় (যাতে ঐশ্বর্যা বেশ পারদর্শী বলেই মনে করা হয়) করেছেন, তা-ও সে ভাবে মনে দাগ কাটেনি। সব মিলিয়ে ‘রাবণ’ ছবিতে ঐশ্বর্যাকে যে ভাবে মণি রত্নম ব্যবহার করেছিলেন, এই ছবিতে ততটা পারেননি।
আলাদা ভাবে যাঁদের নাম উল্লেখ না করলেই নয়, তাঁরা কার্থি এবং তৃষা। বিরতির আগে পর্যন্ত পুরো ছবিকে কার্থি একা টেনে নিয়ে গিয়েছেন। চোল পরিবারের রাজকুমারী কুন্দাভাইয়ের চরিত্রে বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয় করেছেন তৃষা। রূপে ঐশ্বর্যাকে টেক্কা দিতে না পারলেও অভিনয় করেছেন পাল্লা দিয়ে। কয়েকটি দৃশ্যে কেবল বুদ্ধির জোর দেখিয়ে তাঁর করা চরিত্র দর্শকের মন জয় করেছেন।
আরও একটি বিষয় বলতেই হয়। মণি রত্নমের বেশির ভাগ ছবির প্রধান চরিত্রগুলিই খুব উদ্দাম প্রকৃতির। সে তাঁর ‘রাবণ’ ছবির ‘বীরা’ চরিত্রই হোক কিংবা ‘যুবা’র ‘লল্লন সিংহ’। পিএস-১ ছবিতে যুবরাজ আদিত্যের চরিত্রে বিক্রমের অভিনয় সেই ধারা বজায় রেখেছেন।
বিক্রম উদ্দাম হলেও কার্থির চরিত্র প্রাণোচ্ছল। রবির চরিত্র আবার অনেক শান্ত, প্রয়োজনে ক্ষিপ্ত, নিয়ম মেনে কাজ করে।
এই বার আসি ছবির নামকরণ নিয়ে। কেন এই ছবির নাম রাখা হল ‘পনিয়িন সেলভান’? এই ছবি দেখতে গিয়ে সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। পনিয়িন সেলভনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন রবি। কিন্তু তাঁকে জুড়েই যে গল্প এগিয়েছে তেমনটাও নয়। তিনি বৃহত্তর গল্পের একটি চরিত্র মাত্র। তাই ছবির প্রথম ভাগের নামকরণ একেবারেই সার্থক হয়নি। ছবির দ্বিতীয় পর্ব মুক্তি পাবে আগামী বছর, ২০২৩-এ। সেই ছবি দিয়ে প্রথম গল্পের নামকরণের যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় কি না, তা সময়ই বলবে।
কিন্তু এই ছবিতে কি চোল সাম্রাজ্যের ইতিহাস সত্যিই প্রতিফলিত হয়েছে? এই ছবি তৈরি হয়েছে লেখক রামস্বামী কৃষ্ণমূর্তির লেখা বইয়ের গল্প অনুসারে। সেই গল্পের সঙ্গে আসল ইতিহাসের বিস্তর ফারাক। রামস্বামীর লেখা এই বই নিয়ে আগেও অনেক পরিচালক ছবি বানানোর কথা ভেবেছেন। তবে বাজেটের কারণে পিছিয়ে আসতে হয়েছে। সফল হয়েছেন মণি রত্নম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy