Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Entertainment News

মুভি রিভিউ ‘অসুর’: শেষ পাতের ঝোড়ো চমকেই জমাটি ইনিংস

পাভেলের পরিচালনায় এ ছবিতে প্রাপ্তির তালিকাটা ছোট নয় মোটেই।

বছরের শুরুতেই তাক লাগিয়ে দিল জিৎ-আবীর-নুসরত অভিনীত ‘অসুর’। ছবি: নুসরতের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টের সৌজন্যে।

বছরের শুরুতেই তাক লাগিয়ে দিল জিৎ-আবীর-নুসরত অভিনীত ‘অসুর’। ছবি: নুসরতের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টের সৌজন্যে।

পরমা দাশগুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২০ ১৮:১১
Share: Save:

অসুর ঠিক কাদের বলে?

যারা সৃষ্টি ধ্বংস করে, তাদের? শুভ-অশুভের যুদ্ধে যারা অশুভ, তাদের?

নাকি যারা ‘ন কে ন আর হ কে হ’ বলে, তারাই অসুরের জাত?

হিসেবটা এক্কেবারে গুলিয়ে দিল স্বয়ং ‘অসুর’ই। আর তার হাত ধরেই বড়সড় চমক দিয়ে বছরের শুরুতেই তাক লাগিয়ে দিল জিৎ-আবীর-নুসরত অভিনীত এই আদ্যোপান্ত বাংলা বাণিজ্যিক ছবি। এবং গল্পে, অভিনয়ে, ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চিত্রায়ণে মূল ধারার ছবি হয়েও ভিন্ন স্বাদের বুননে বেশ খানিকটা অন্য রকম হয়ে উঠে কুড়িয়ে নিল হাততালিও।

পাভেলের পরিচালনায় এ ছবিতে প্রাপ্তির তালিকাটা ছোট নয় মোটেই। রাজনীতির ময়দানে পা দেওয়ার পরে এ ছবি নুসরত জহানের ফিরে আসার, ফের জিতের সঙ্গে জুটি বাঁধারও। এ ছবি জিৎ-আবীর কে একসঙ্গে ফিরে পাওয়ার। আবার আবীরকে ফের আর একটা ছাইরঙা চরিত্রে দেখারও। আর নিজের চতূর্থ ছবি ‘অসুর’কে পরিচালক পাভেল চেনাতে চাইছেন শিল্পী রামকিংকর বেজ-এর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবেই। যার কাহিনি এগিয়েছে শিল্পী-জীবনের ওঠাপড়া, টানাপড়েন, আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের থেকে এক্কেবারে আলাদা স্বত্ত্বা হয়ে বাঁচার লড়াই ঘিরেই।

অসুর

অভিনয়ে: জিৎ, আবীর, নুসরত

পরিচালনা: পাভেল

কিগান মান্ডি (জিৎ) আর্ট কলেজে পড়ান। শিল্পীস্বত্ত্বাই তাঁর অস্তিত্ব, ধ্যানজ্ঞান। তার বাইরের পৃথিবীকে তাই ‘থোড়াই কেয়ার’। আলুথালু, উস্কোখুস্কো, জটপাকানো চুলের কিগান তাই ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বসেই নেশা করতে পারেন, অর্ধেক পোশাকে ক্লাসে চলে আসতে পারেন, কথায় কথায় সংস্কৃত শ্লোক, রবীন্দ্রনাথ আওড়ান, ট্রেনের বাথরুমের দেওয়ালে ছবি আঁকেন, এমনকি রিকশাচালককে পাকড়াও করে ছাত্রীর সঙ্গে ন্যুড অভিনয় করাতে চেয়ে চাকরিও খোয়াতে পারেন। তাতে তাঁর কিচ্ছুটি যায় আসে না। কারণ তাঁর মন জুড়ে, মাথা জুড়ে শুধু সৃষ্টির ভাবনা। শিল্পের জগতে একেবারে আনকোরা কিছু করে ফেলার স্বপ্ন দু’চোখ ঢেকে।

আরও পড়ুন: ঘর ছেড়ে রাঙা মাটির পথে বহু বছর, অজয়ের বাঁকে সেই অনাথবন্ধুর সঙ্গে দেখা

কিগান তাই আর কিচ্ছু দেখতে পান না, শুনতেও পান না। বোঝা তো দূরের কথা। তাই তার প্রেমে পাগলিনী প্রায়, একদা সহপাঠিনী অদিতি (নুসরত) তাঁর কাছে শুধু বন্ধুই। আর অদিতি? কলেজ জীবন থেকেই কিগান-ই তাঁর সবটুকু। সেই টানে আর এক সহপাঠী বোধির (আবীর) ভালবাসাকে দেখেও দেখেন না তিনি। অনেকটা আদরে ঘেরা একটা রাতকে স্রেফ নেশার ঘোর বলে উড়িয়ে দেওয়া কিগানকে ভুলতে অদিতি বোধির হাত ধরেন বটে। কিন্তু বিয়ে সংসার, সন্তান সব ছেড়ে পতঙ্গের মতো ছুটে যান কিগান নামের আগুনরঙা মোহের দিকেই। বিয়ে ভাঙা, ছেলে বুবাইয়ের টান কিছুই সে মোহ ঘোচাতে পারে না। বোধির জন্য পড়ে থাকে শুধু বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণা আর ছেলেকে একলা মানুষ করার দায়িত্ব।

ভিন্ন স্বাদের বুননে বেশ খানিকটা অন্য রকম হয়ে উঠে হাততালি কুড়িয়ে নিল ‘অসুর’। ছবি: সংগৃহীত।

কিগানকে বিয়ের শর্তে বাবার কাছ থেকে তাঁর ক্লাবের দুর্গাপুজোর প্রতিমা ও মণ্ডপসজ্জার কাজের দায়িত্ব অদিতি পাইয়ে দেন ভালবাসার মানুষকে। কিগানও তিলতিল করে গড়ে তোলেন তাঁর জীবনের সেরা শিল্পকীর্তি- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রতিমা। কিগানের নাম শুনে হাত গুটিয়ে নেওয়া, কলকাতার ৫৬টা পুজোকে স্পনসর করা কর্পোরেট সংস্থার মাথা বোধি তা দেখে, সে পুজোর তুমুল প্রচারে, শহরজুড়ে তার চর্চার জোয়ারে আর প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায়। কিগানকেই চ্যালেঞ্জ ছোড়েন, ধুলোয় মিশিয়ে দেবেন তাঁর এই কীর্তি। আর কিগান বাজি রাখেন নিজের প্রাণ! ইতিমধ্যে ভরা পার্টিতে অদিতির বাবা কিগানকে তাঁর হবু জামাই হিসেবে পরিচয় দিতে গেলে সে হেসেই উড়িয়ে দেন পুরোটা। সেই অপমানে তিনি আচমকা স্ট্রোকে পঙ্গু হয়ে পড়েন, আর ফের এক বার প্রত্যাখ্যানে ফুঁসে ওঠেন অদিতি।

ইতিমধ্যে বোধির স্যাবোটাজেই কিগানের পুজোয় ঘটে যায় বড়সড় বিপর্যয়। লাখো লাখো মানুষের ভিড়ে ঠাসা মণ্ডপে হুড়োহুড়ি, পদপিষ্ট হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনা এবং তা ঘিরে শহরজুড়ে বিশৃঙ্খলা এড়াতে প্রশাসন বাধ্য হয় পুজো বন্ধ করে দিতে। এর পিছনে বোধির ভূমিকা টের পেয়েও, গোটা কলকাতা তবু তার পুজোরই চর্চা করছে জেনেও হাজার চেষ্টাতেও কিগান ফের সেই পুজো মানুষের জন্য খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন না।

আরও পড়ুন: তাইল্যান্ডে ছুটি কাটিয়ে ফিরলেন জুটি, বিমানবন্দরেও আলিয়াকে আগলে রাখলেন রণবীর

হেরে যাওয়া, বোধির দলবলের হাতে মার খাওয়া, বিধ্বস্ত কিগান বোধির উপর চড়াও হন শেষমেশ। জানা ছিল না সেখানেই তার জন্য অপেক্ষা করছে জীবনের সবচেয়ে বড় দুটো চমক। সবচেয়ে বড় ধাক্কাও বটে। আর এ বার তাই কিগান সত্যিই হার মানেন জীবনের কাছে। একদা দুই সহপাঠী, এখন সবচেয়ে বড় বন্ধু এবং সবচেয়ে বড় শত্রু অদিতি এবং বোধির চোখের সামনে নিজের সৃষ্টি নিয়েই আগুনে ছারখার হয়ে শেষ করে দেন নিজেকে। বেঁচে থাকে শুধু তাঁর সাধের শিল্পকীর্তি।

আর ক্লাইম্যাক্সে এসে এই চমক দুটোই দর্শককে ভাবায়, দুর্গাপুজোর আবহে এই অসুর আসলে কে? সৃষ্টি ধ্বংস করতে চাওয়া বোধি? অদিতির এমন জীবন বাজি রাখা ভালবাসাকে আগাগোড়া অস্বীকার করা কিগান? নাকি অন্য কেউ?

এ ছবিতে জিতের কিগান বড্ড অন্য রকম, মায়াকাড়া তো বটেই। ছবি: সংগৃহীত।

এত দিনকার চেনা নায়কের ইমেজ আমূল ভেঙেচুরে এলোমেলো, পাগলাটে, বিস্রস্ত চেহারার কিগানকে জীবন্ত করে তুলেছেন জিৎ। আত্মভোলা শিল্পীর কিছু কিছু রূপায়ণ মাত্রা ছাড়ালেও, কোথাও কোথাও খানিক অতি নাটকীয় হয়ে উঠলেও জিতের কিগান বড্ড অন্য রকম, মায়াকাড়া তো বটেই। আবীরের অভিনয় বরং কোথাও একটু আধটু সরলরেখায় হেঁটেছে। তবু কখনও নিষ্ঠু্‌র, কখনও ক্রুর, কখনও হেরে যাওয়া প্রেমিক, কিংবা স্ত্রীর একটু ভালবাসার জন্য তৃষিতহৃদয় স্বামী, এবং সব পেরিয়ে দায়িত্ববান, স্নেহশীল বাবা— আবীরের বোধিকে রক্তমাংসের মানুষ মনে হয়েছে গোটা ছবি জুড়েই।

আরও পড়ুন: মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অসুরের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়েছেন: নুসরত

আর নুসরত? রূপে, লাস্যে, প্রেমে-মোহে পাগল হয়ে ওঠা ব্যাকুলতায়, প্রতিহিংসার আগুনে— অদিতিকে তিনি গড়ে তুলেছেন বড্ড যত্নে। বেমানান তো লাগেইনি, বরং অদিতির লড়াই একাত্ম করে তুলতে পেরেছে দর্শককে। অদিতির সন্তান বুবাইয়ের চরিত্রে নজর কেড়েছে শিশুশিল্পীও। কিগানের পুজোর বিপর্যয়ে দেশপ্রিয় পার্কের পুজোর স্মৃতি উস্কে দেওয়াও বিফলে যায়নি মোটেই। বিক্রম ঘোষের সঙ্গীত পরিচালনায় এ ছবির গানও ভালই লাগে। বিশেষত ‘আমি রাধার মতো কলঙ্ক যে চাই’ হল থেকে বেরনোর পরেও খানিক ঘুরপাক খায় মাথার ভিতর।

আরও পড়ুন: বিবাহিত পরিচালকের সঙ্গে ব্যর্থ প্রেমপর্বের পরে পুনম ধিলোঁর দাম্পত্যও সুখের হয়নি

কয়েকটা প্রশ্ন থাকে অবশ্য। ঠিক-ভুলের ঊর্ধ্বে উঠে মেয়ের যাবতীয় কার্যকলাপে অদিতির বাবা কেন সায় দিয়ে যান, স্রেফ শিল্পী বলে কিগানের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কেন ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর নেশা করাও মাফ করে দেন, অদিতি ঠিক কিসের টানে কিগানের জন্য এত উতলা, বোধির সহকারী কোন রাগে নিজে থেকেই কিগানের উপরে হামলা করে বসে, তার যথাযথ কোনও ব্যাখ্যা নেই গোটা ছবিতে। নামমাত্র চরিত্রে কুশল চক্রবর্তী বা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়দের পর্দায় আসাও দাগ কাটে না বললেই চলে।

তবু টানটান বুনোটে, প্রাণবন্ত চরিত্রে এবং শেষপাতে মোড় ঘোরানো চমকে এ ছবি যথেষ্ট সম্ভাবনাময় দেখায়। বছরের শুরুতেই এমন সপাটে ব্যাট চালানো বাংলা ছবি বক্স অফিসে কতটা সাফল্য আনে, অপেক্ষা এখন তারই।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy