Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪

কাঠমান্ডুর আগের স্টেশন

নাম তার কাটমুন্ডু। তাপমাত্রা মাইনাস দশ। তার মধ্যেই সেলফি তুলছেন আবির-শ্রাবন্তী। রাতে খাচ্ছেন ব্র্যান্ডি। অভিনব সেই শ্যুটিং স্পট ঘুরে এসে লিখছেন অদিতি ভাদুড়ি।কে জানত, সাহেবদের এত ভাল নকল করেন আবির চট্টোপাধ্যায়। কে-ই বা জানত রাতে ডিনারের সময় রুটি-তরকার সঙ্গে এক বাটি কাঁচালঙ্কা খান শ্রাবন্তী। বাইরে বিকেল চারটের মধ্যেই অন্ধকার। তার পর সন্ধের আড্ডা থেকে ডিনার টেবিল—ক্রমাগত চলছে আবির-শ্রাবন্তীর খুনসুটি। আর তাতে গলা মেলাচ্ছেন বাকিরা।

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:০০
Share: Save:

কে জানত, সাহেবদের এত ভাল নকল করেন আবির চট্টোপাধ্যায়।

কে-ই বা জানত রাতে ডিনারের সময় রুটি-তরকার সঙ্গে এক বাটি কাঁচালঙ্কা খান শ্রাবন্তী।

বাইরে বিকেল চারটের মধ্যেই অন্ধকার। তার পর সন্ধের আড্ডা থেকে ডিনার টেবিল—ক্রমাগত চলছে আবির-শ্রাবন্তীর খুনসুটি। আর তাতে গলা মেলাচ্ছেন বাকিরা।

কিন্তু এ সব হচ্ছে কোথায়?

কাঠমান্ডু? নেপাল?

নাকি কাটামুন্ডু...

কাটামুন্ডু? সে আবার কী? কনফিউশনই বটে!

পরিচালক রাজ চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল ছবির নাম ‘কাটমুন্ডু’। এবং এর সঙ্গে নেপালের রাজধানীর সম্পর্ক নেই। এটা নিখাদ এক সম্পর্কের গল্প। ছবির প্রযোজক গ্রিনটাচ এন্টারটেনমেন্ট।

বিদেশিরা এই কারণেই মুখ খোলে কম

প্রথম দিন শ্যুটিংয়ে কলটাইম ভোর পাঁচটা। প্রথম স্টপ ওভার ইয়ুমথাং। ব্রেকফাস্ট ব্রেক। টয়োটা ফরচুনারের টেম্পারেচার ডিসপ্লেতে তখন মাইনাস চার। মোবাইলে কোনও নেটওয়ার্ক নেই। কাজেই ওয়েদার অ্যাপসে বাইরের তাপমাত্রা দেখার সম্ভাবনা দূর অস্ত।

প্লেটে ব্রেকফাস্ট নিয়ে একফাঁকে এগিয়ে এলেন আবির চট্টোপাধ্যায়। কানে ইয়ারপ্লাগ গোঁজা আর গায়ে থার্মালের ওপর স্রেফ একটা জ্যাকেট জড়ানো। অত ঠান্ডাতেও রসিকতার বিরাম নেই আবিরের। বললেন, “এই জন্যই তো ফরেনাররা কথা বলার সময় মুখটা অত কম খোলে। খুব ঠান্ডায় থাকে তো ওরা!” এক দিন আগেই আবিররা শ্যুট করেছিলেন ইয়ুমথাংয়ের আশেপাশে। বললেন, “সেদিন লাঞ্চ ব্রেক-য়ে প্লেট থেকে খাবার মুখে তুলতে গিয়ে দেখি আঙুলগুলো আটকে গিয়েছে। হাত আর মুখ অবধি পৌঁছচ্ছে না।” পরিচালক এ দিকে তাড়া দিয়ে সবাইকে গাড়িতে তুলতে ব্যস্ত।

অক্সিজেন কম...চলছে ঘনঘন হাই তোলা

সেদিন শ্যুটিং স্বীকারোক্তির দৃশ্যের। সিধু (রুদ্রনীল), সানি (সোহম), পাবলো (আবির) হিমালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের মনের গোপন কথা উজাড় করে দেয়। দৃশ্যটা যেমন গভীর, তেমনই মজার। তিন নায়ক রিহার্সাল করতে করতে গুছিয়ে নেন সংলাপ। শুরুতেই সিধুর মজার সংলাপ। মোবাইল ক্যামেরায় হিমালয়ের ছবি বন্দি করতে গিয়ে সে বলে, “টিপছি। কিন্তু উঠছে না তো...”। পাশ থেকে সানির পরামর্শ, “স্ট্যাটিস্টিক্স নয়, ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্সটা মাপ।” শ্যুটিং, রিহার্সালের ফাঁকে ফাঁকেই অভিনেতাদের এক ঢোক করে জলের জোগান দিচ্ছেন ইউনিট সদস্যরা। অক্সিজেন কম। শ্বাস নিতে ভালই বেগ পেতে হচ্ছে সবাইকে। চলছে ঘনঘন হাই তোলা। অভিনেতাদের দেখে যদিও সে কথা বোঝার উপায় নেই। বোঝার উপায় নেই আরও একজনকে দেখে। ভাবলেশহীন মুখে একের পর এক দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করে চলেছেন সিনেমাটোগ্রাফার শীর্ষ রায়।

শট ওকে। শ্যুটিং প্যাক আপ করে আবার লোকেশন বদল। পরিচালক জানান শ্যুটিং হবে এ বার আরেকটু নীচে নেমে।

তোফা তোফা তোফা...

বরফ ভাঙা রোদে তখন ঝিলমিল করছে জিরো পয়েন্ট উপত্যকা।

পরের শ্যুটিং সিধুর (রুদ্রনীল) নাচের দৃশ্যের। স্বপ্নের সিকোয়েন্সে সেই নাচের দৃশ্য। পরিচালক অ্যাকশন বলার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে ওঠে বিখ্যাত সেই গান, ‘তোফা তোফা...লায়া লায়া’। সাদা জ্যাকেট, সাদা প্যান্ট, লাল জুতো, গলায় মাফলার জড়ানো রুদ্রনীল দৌড়ে এসে কোমর দোলান গানের তালে। নায়িকাকে কোলে তুলে নেন। সেই দৃশ্য দেখে হাসির রোল পড়ে পরিচালক, বাকি অভিনেতা থেকে ইউনিটের সবার মধ্যে।

কনকনে ঠান্ডায় ইউনিটের সবাই তখন কম্বল হাতে দাঁড়িয়ে। শট ‘ওকে’ হতেই কম্বলে মুড়ে নেওয়া হয় নায়িকাকে। রুদ্রনীল বেরিয়ে আসতে আসতে বলেন, “এ ছবির পরিচালক ভাগ্যিস রাজ... নইলে।” গাড়িতে ওঠার ফাঁকে রুদ্রনীল বলেন, “ওকে কোলে তোলার সময় কিছুই টের পাইনি। ঠিক এ রকম হয়েছিল ‘কালবেলা’র শ্যুটিংয়ে। কোমর অবধি ঠান্ডা জলে নেমে সে দৃশ্যের শ্যুটিং। উত্তরবঙ্গের ঠান্ডায়। গৌতমদা (গৌতম ঘোষ) বলছেন, ‘নাম জলে’। তার পর পা কোথায়, আর কোমর কোথায়!”

ফিরতি পথে ইয়ুমথাংয়ে লাঞ্চ ব্রেক। হোটেলে রাতের আড্ডায় জানা গেল ইউনিটের কিছু সদস্য ফেরার সময় স্নো লেপার্ড দেখতে পেয়েছেন। স্থানীয়দের বিশ্বাস স্নো লেপার্ড দেখলে নাকি স্নো-ফল হয়। খুব ঠান্ডা পড়ে।”

এর চেয়েও বেশি ঠান্ডা!

ম্যাডামকে এক বাটি লঙ্কা দাও

রাত ন’টা। খাবার টেবিলে একে একে আবির, সোহম, শ্রাবন্তীরা।

শ্রাবন্তী প্লেটে রুটি নিতে নিতে বললেন, “এই সবে ফোলা রুটি দিল। এখন তো দেখছি ঠান্ডায় কাঠ।” আবির তখন নিজের প্লেটে মন দিয়েছেন। আচমকাই লেগপুলিং শুরু করলেন শ্রাবন্তীর, “এই যে, ম্যাডামকে এক বাটি কাঁচালঙ্কা দাও।” শ্রাবন্তী না কি কাঁচালঙ্কা খেতে দারুণ ভালবাসেন।

সোহম সবচেয়ে চুপচাপ। খাওয়া শেষে ফ্রুট কাস্টার্ড নিয়ে শ্রাবন্তী খুঁতখুঁতানি শুরু করলেন। “ইস্‌, কাস্টার্ড-য়ে কলা আমার একদম ভাল্লাগে না।” সেই শুনে টেবিলের এ-দিক ও-দিক থেকে শুরু হল মজার বাক্যবিনিময়। প্লেটে খাবার নিয়ে মিমিও তখন আড্ডায়। খুনসুটি শুরু করেন আবিরের সঙ্গে। প্রশ্ন করি, আপনি তো ব্যোমকেশ, ফেলুদা সব একসঙ্গে। তো পাহাড়ে ব্যোমকেশ হিসেবে এলেন, না ফেলুদা হিসেবে? মুচকি হেসে আবিরের উত্তর, “আমি এখানে শুধুই পাবলো।” পরমুহূর্তেই আবির পরিচালকের সঙ্গে ঢুকে পড়েন আলোচনায়। বিষয় পরদিনের শ্যুটিং।

ওরা ঠিক জানে রুমগুলোয় কারা আছে

শ্যুটিংয়ের দ্বিতীয় দিন। ঘড়িতে ৬.১৫।

সবার আগে নামলেন মিমি। শ্যুটিং কস্টিউমে পুরোপুরি তৈরি। রাজকে বললেন, “আমি কতক্ষণ রেডি হয়ে গেছি। কোথায় সব?” আগের দিন রাত থেকে হোটেলে ইলেকট্রিসিটি নেই। জেনারেটরই ভরসা। ইলেকট্রিক কেটলে চা না বানাতে পারার অনুযোগ কানে এল। রাজ হেসে বলেন, “আমরা তো আমাদের রুমে চা বানাতে পেরেছি। আসলে ওরা ঠিক জানে কারা আছে ওই রুমগুলোতে।” আজও ইয়ুমথাংয়েই ব্রেকফাস্ট ব্রেক।

ব্রেকফাস্ট করার ফাঁকেই আবিরের টিপস, “ঠান্ডায় হাত-পা গুলো মাঝেমধ্যেই স্ট্রেচ করতে হবে। তা হলে কিন্তু আর জমে গিয়ে কষ্ট হবে না।”

উলেন আইল্যাশ বেটার হত

গাড়ি থেকে নেমেই মেক আপে টাচ দিতে শুরু করলেন নায়িকারা। হেয়ার স্টাইলিস্ট মিমির চুল ঠিক করতে ব্যস্ত। ও দিকে লিপস্টিক লাগানোর ফাঁকে শ্রাবন্তী বলে ওঠেন, “আরে, লিপবামটা দাও। ঠোঁট ড্রাই হয়ে যাচ্ছে।” শ্রাবন্তীর আইল্যাশটা খুলে আসছিল বারবার। তা দেখে ব্যস্ততার মধ্যেও পরিচালকের পরামর্শ, “উলেন আইল্যাশ হলে বেটার হতো দেখছি।”

অনেক ঝগড়া, ঝামেলার পর আজ তিন নায়ক-নায়িকার নিজেদের একে অপরকে ভালবাসা স্বীকার করে নেওয়ার দিন। প্রথম শট আবির-শ্রাবন্তীর। বেশ কিছু উত্‌সাহী মানুষ এদিকে ভিড় জমিয়েছেন শ্যুটিং দেখতে। তাদের বারবার অনুরোধ করে লোকেশন ফাঁকা করতেই লেগে গেল বেশ অনেকটা সময়। ক্যান্সার আক্রান্ত পল্লবী (শ্রাবন্তী) খালি নিজের সেলফি তোলে আর ফেসবুকে পোস্ট করে।

শট ওকে। হঠাত্‌ই মিমি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শরীর গরম রাখতে এক চামচ মধু খেয়েছিলেন একটু আগেই। জানা গেল ব্রিদিং ট্রাবলও হচ্ছে নায়িকার। সঙ্গে ডাক্তারও নেই। রাজ তখন পরম মমতায় আগলাতে

ব্যস্ত মিমিকে। তড়িঘড়ি গাড়িতে উঠিয়ে দেওয়া হল তাঁকে। আরও জানা গেল শারীরিক অসুবিধাটা নাকি বেশ কিছু সময় ধরেই ভোগাচ্ছিল নায়িকাকে। কিন্তু হলে কী হবে! পরিচালক তো অত্যন্ত পেশাদার। শট ওকে না হওয়া পর্যন্ত ছাড়েননি নায়িকাকে। মিমিকে নিয়ে গাড়ি ছুটল ইয়ুমথাংয়ের দিকে। সেদিনের মতো শ্যুটিং প্যাক আপ।

আমরা স্নান করলে ওখানেই শ্যুটিং শুরু হয়ে যাবে

মিমি তখন অনেকটা ধাতস্থ। সদলবল নায়িকারা নেমে গেলেন এক স্থানীয় দোকানে। আজ ম্যাগি ব্রেক। পরপর অর্ডার নেওয়া হল। কেউ আন্ডা ম্যাগি তো কেউ এমনি। শ্রাবন্তীর আবদার ম্যাগিতে অনেক কাঁচালঙ্কাকুচি দিতে হবে। ধোঁয়া ওঠা ম্যাগিতে গল্প জমে ওঠে নায়িকাদের। শ্রাবন্তীর বন্ধু বলেন, “উধার এক হটস্প্রিং হ্যায়। সব কপড়া উতারকে নহা রহি হ্যায়।’ সঙ্গে সঙ্গে শ্রাবন্তীর উত্তর, “আমরা কি জামাকাপড় খুলে স্নান করব নাকি! তা হলে তো ওখানেই শ্যুটিং শুরু হয়ে যাবে।” হাসির রোল পড়ে যায়।

এ দিকে শ্রাবন্তী তখন মিমিকে ম্যাগি খাইয়ে দিচ্ছেন। রাতের আড্ডায় সেদিন আবির বলেন, “কমার্শিয়াল সিনেমায় রাজের মতো আমাকে খুব কম লোকই বুঝতে পারে। আমি খুব কম্ফর্টেবল ওর সঙ্গে কাজ করে।” সহমত রুদ্রনীলও।

পর দিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে দেখা অভিনেতাদের সঙ্গে। তিন অভিনেতাই আজ রওনা দিচ্ছেন কলকাতার দিকে। ব্রেকফাস্ট শেষে আবির তড়িঘড়ি হাঁটা লাগান ঘরের দিকে। আবিরের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিও গিয়েছে দিনকয়েক আগেই। বললেন, “দিন পনেরো পাহাড়েই কেটে গেল।” সোহমের দ্বিতীয় অ্যানিভার্সারিও গিয়েছে গতকালই। বিলেটেড অ্যানিভার্সারি জানাতে হেসে বলেন, “কালই তো জানালে পারতেন।”

অবশেষে এক ছুটে কলকাতা।

অফিস পালিয়েও রেহাই নেই যে। মুখ যতই গোমড়া হোক না কেন। মাইনাস থেকে প্লাস তাপমাত্রায় ফিরে ছ্যাঁকা লেগে গা যতই ঝলসে যাক না কেন...

ফিরতে তো হবেই!

বস যে অপেক্ষা করছেন...

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy