(বাঁ দিক থেকে) লীনা গঙ্গেপাধ্যায়, দেবলীনা দত্ত, সৌরভ চক্রবর্তী, সুদীপ্তা চক্রবর্তী। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
তারকা থেকে জনতা— এখনও বাড়িতে মেয়ে জন্ম নিলেই বয়োজ্যেষ্ঠরা বলেন, “লক্ষ্মী এল ঘরে।” লক্ষ্মী মেয়ে মানে নরম স্বভাবের। ধীরে কথা বলে। কারও সঙ্গে বিবাদে জড়ায় না। ধীরেসুস্থে হাঁটে। আরও কত কী! আর সঙ্গে বড় আশাও থাকে। সেই আশা সংসারে সমৃদ্ধির আশা। মনে করা হয়, নবজাতিকার আগমনে আরও সমৃদ্ধ হবে সেই পরিবার। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন ঘরে ঘরে তাই ধনদেবীর আরাধনা। তাঁকে ‘অচলা’ রাখার আন্তরিক প্রয়াস।
একুশ শতকেও পুরাণ বর্ণিত ‘লক্ষ্মী’ মেয়ের ধারণা কি তা হলে একই রয়ে গিয়েছে? ‘লক্ষ্মীমন্ত’ শব্দের অর্থ কি একটুও বদলায়নি?
রাজ্যের মহিলাদের নিয়ে তাঁর কাজ। কাহিনী-চিত্রনাট্যকার লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি ‘লক্ষ্মী’ বলতে কী বোঝেন? প্রচলিত অর্থে যাঁরা ‘অলক্ষ্মী’ তকমা পান তাঁরাই লীনার চোখে ‘লক্ষ্মী’। প্রযোজকের কথায়, “যুগ যুগ ধরে ‘লক্ষ্মী মেয়ে’রা সূর্যের দিকে তাকায় না। চলনে-বলনে শান্তশিষ্ট। মাথা নিচু করে হাঁটে। আমি এই প্রত্যেকটি কথার বিরোধিতা করি।” সেই জায়গা থেকে তাঁর মত, যত বেশি সূর্যের আলো গায়ে মাখবে, যত বেশি বাতাসের সঙ্গে মেলামেশা করবে ততই মানুষ তার বাইরের বাতাস এবং আলো থেকে নিজের মধ্যে টাটকা অক্সিজেন আর আলো শুষে নিতে পারবে। অকারণে মাথা নিচু করার কোনও প্রশ্নই নেই, আত্মসম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে চলাটাই দস্তুর। এ ভাবেই বাঁচতে হবে। লীনার চোখে, “আজকের দিনে ‘লক্ষ্মী’ মানেই শুধু গৃহলক্ষ্মী নয়। এখন নারীকে ঘর এবং বাইরে দু’দিক সামলাতে হবে। আমার ‘লক্ষ্মী’ কর্মস্থলেও সমৃদ্ধি আনবে। নিজে বিভেদ আনবে না, বিভেদের শিকারও হবে না।” কারও দয়ায় নয়, নিজের জোরে যে নারী নিজেকে প্রমাণিত করবে সে-ই আসল ‘লক্ষ্মীমন্ত’।
সেই দিক থেকে তথাকথিত সংজ্ঞা মেনে বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘অলক্ষ্মী’রাই কি বেশি সক্রিয়?
লীনা বলছেন, “বর্তমান পরিস্থিতির বিচারে আমি কিন্তু লক্ষ্মীর সংজ্ঞা দিইনি। তাই শুধুমাত্র বর্তমান পরিস্থিতিকে ধরলে ভাবনা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। শহর বা শহরতলি— সব জায়গাতেই মেয়েরা এখন বেশি সক্রিয়। প্রত্যেক বিষয়ে তাঁরা তাঁদের বক্তব্য সামনে আনছেন।” এই প্রসঙ্গে তিনি আরজি কর-কাণ্ডের উদাহরণ টেনেছেন। দাবি, গ্রামের মেয়েরা এই বিষয়ে হয়তো ততটাও সোচ্চার নন। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে ঘরে-বাইরে যা যা অন্যায় ঘটছে তার প্রতিবাদ তাঁরা জানাচ্ছেন। লীনা দেখেছেন, ক্রমশ শহর-গ্রাম নির্বিশেষে প্রচলিত ‘লক্ষ্মী’র সংজ্ঞা অনেকটাই বদলে দিতে পেরেছেন নারী নিজেই। এটা তাঁর কাছে আশার কথা।
শহরে যখনই অন্যায় ঘটে তিনি সকলের আগে প্রতিবাদী। আরজি কর-কাণ্ডে রাত দখল থেকে প্রতিবাদ মিছিল হয়ে ধর্নায় অবস্থান— সুদীপ্তা চক্রবর্তী, সারা ক্ষণ সক্রিয়। ‘লক্ষ্মী’পুজোর দিন তিনি মেয়েকে নিয়ে শিলচরে। অসমিয়া একটি ছবির ওয়ার্কশপ করাচ্ছেন। বাড়িতে পুজো নেই কোনও কালেই। তিনি নিশ্চয়ই ‘লক্ষ্মী মেয়ে’ সংজ্ঞার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রমী? প্রশ্ন রাখতেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে জবাব দিলেন, “আমার বর অভিষেক সাহা কিন্তু ‘লক্ষ্মী’। আক্ষরিক অর্থে লক্ষ্মীমন্ত। এই যে আমি মেয়েকে নিয়ে বাইরে। অভিষেক ঘর সামলাচ্ছে। অন্য সময় মেয়েকে সামলায়, আমাকেও!” অভিনেত্রী জানিয়েছেন, মেয়েকে রোজ তৈরি করে স্কুলে পাঠানো, অভিনেত্রীর বাইরে যাওয়ার ব্যাগ গোছানোর দায়িত্ব খুশিমনে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন তাঁর স্বামী। প্রয়োজনে স্ত্রী-সন্তানকে রেঁধেবেড়ে খাওয়াতেও আপত্তি নেই তাঁর। মেয়েদের ক্ষেত্রে? তাঁর কথায়, “যে মেয়ে নিজের সম্মান রাখতে জানে, মা-বাবার দেখাশোনা করে, গুরুজনদের যথাযোগ্য সম্মান জানায়, নিজের অধিকারবোধ সম্পর্কে সচেতন এবং সাহসী, সত্যি বলতে ভয় পায় না— তারাই আমার চোখে ‘লক্ষ্মী’ মেয়ে।” তিনি আরও যোগ করেছেন, যাঁরা এত দিন তথাকথিত ‘লক্ষ্মীমন্ত’র আড়াল সরিয়ে মুখর হয়েছেন, তাঁদের জন্য তাঁর একরাশ শুভেচ্ছা। তিনি মন থেকে এটাই চেয়েছিলেন।
সুদীপ্তার ‘লক্ষ্মীমন্ত’ বরের প্রসঙ্গে প্রযোজক-পরিচালক-অভিনেতা সৌরভ চক্রবর্তীর কাছে আনন্দবাজার অনলাইন প্রশ্ন রাখে, ছেলেরা কি আদৌ কি এই তকমা পায়? তাঁর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, “অলক্ষ্মী তকমা নারীর মতো পুরুষকেও শুনতে হয়। এই ধরনের মন্তব্য যথেষ্ট মর্মান্তিক।” সৌরভের ব্যাখ্যায়, “নারী হোক বা পুরুষ— এই ধরনের মন্তব্য যাঁদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় তাঁরা কিন্তু যথেষ্ট অস্বস্তিতে ভোগেন। ধরুন, বাড়ির তিনটি ছেলের মধ্যে এক জন এই বিশেষণে বিশেষিত। তিনি কিন্তু যথেষ্ট মনঃকষ্টে ভোগেন। প্রতি মুহূর্তে সজাগ থাকেন, বাকিদের সঙ্গে তিনি সমান পঙ্ক্তিভুক্ত নয় বলে।” তাঁর যুক্তি, এঁরা হয়তো তথাকথিত সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধির প্রতীক হয়ে উঠতে পারেন না।
সৌরভ ফিরে যান অতীতে। বলেন, “জেঠু-কাকুদের মুখে শুনেছি, সেই সময় পাড়ায় যে সমস্ত ছেলে রকে বসা বখাটে ছেলে হিসাবে পরিচিত বা ‘অলক্ষ্মী’ তকমা পেত, তারাই কিন্তু পড়শির বিপদ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম— সবেতে ঝাঁপিয়ে পড়ত।” তাই সৌরভের কাছে ‘লক্ষ্মী’ শব্দ আপেক্ষিক। যুক্তি, “যিনি উপকারী তিনিই লক্ষ্মী। স্বার্থে ঘা লাগলেই তিনি পর মুহূর্তে অন্যের চোখে অলক্ষ্মী হয়ে ওঠেন।”
সৌরভের কথার সুর চৈতি ঘোষালের বক্তব্যে। যে মেয়ের শিরদাঁড়া আছে, অভিনেত্রীর চোখে লক্ষ্মী সে-ই। চৈতির দাবি, “যে তার নিজের পাশাপাশি পারিপার্শ্বিকের উন্নয়নের কথা বলে, সুরক্ষা চায়, দানে নয়, নিজে কাজ করে নিজেকে প্রমাণ করে— সেই মেয়ে আমার চোখে লক্ষ্মী।” চারপাশে এত ‘অলক্ষ্মী’দের ভিড় যে, কাকে ছেড়ে কার কথা বলবেন ভেবে উঠতে পারেন না চৈতি।
এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে দেবলীনা দত্ত নিজেকে ‘অলক্ষ্মী’ তকমা দিয়েছেন। “লক্ষ্মী মেয়ে বলতে আমরা যা বুঝি সেটা আমি একেবারেই নই। কারণ, অলক্ষ্মীর যা যা বৈশিষ্ট্য সব ক’টাই আমার মধ্যে আছে। আমি মোটেই শান্ত নই। প্রতিবাদ করি কথায় কথায়। আমার প্রতিবাদ গলি থেকে রাজপথ— সর্বত্র। আমি এমন ধারার মানুষকেই লক্ষ্মী বা লক্ষ্মীমন্ত বলি।” তিনি জানিয়েছেন, ‘অলক্ষ্মী’ শব্দটা যথেষ্ট অপমানজনক। নারী-পুরুষ যার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হোক, প্রকারান্তরে তিনি বাকিদের চোখে ছোট হয়ে যান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy