কয়েক বছর আগেও ছবিটা ছিল অন্য রকম।
টালিগঞ্জে ‘এডিটিং’-এর প্রাথমিক কাজ মিটতে না-মিটতেই মুম্বই বা চেন্নাইয়ের টিকিট কেটে রাখতে হতো। শব্দের চূড়ান্ত মিশ্রণ বা ছবির মেজাজ অনুযায়ী নির্দিষ্ট ‘লুক’ তৈরির কাজটায় ভিন শহরের নামী ল্যাবরেটরিই ছিল ভরসা। দশকের পর দশক সেই পরম্পরা চলেছে। ডিজিটাল সিনেমা চালু হওয়ার পরেও মুম্বই, চেন্নাইয়ের পরিকাঠামো এগিয়ে ছিল। এখন কিন্তু অনেকে পোস্ট-প্রোডাকশনের কাজে কলকাতার কথাই আগে ভাবছেন।
মাঝ সেপ্টেম্বরে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ‘পিঙ্ক’-এর কথাই ধরা যাক! অমিতাভ বচ্চন অভিনীত এ ছবির চূড়ান্ত রূপটানের নেপথ্যে এই শহরের হাতযশ। অথচ ছবিটির শ্যুটিং কলকাতায় হয়নি। কিন্তু সুজিত ঠিক করে ফেলেন পোস্ট-প্রোডাকশনের কাজটা সারতে কলকাতাই যোগ্য।
কী করে এমন সাহস পেলেন? ‘ভিকি ডোনর’, ‘পিকু’র রূপকার হাসছেন, ‘‘বছর দুয়েক আগে বাংলা ছবি (‘ওপেনটি বায়োস্কোপ’) প্রযোজনা করতে এসেই বুঝে গিয়েছিলাম, এখানে কী মানের কাজ হচ্ছে!’’ ‘পিঙ্ক’-এর কাজ প্রধানত ‘সিঙ্ক সাউন্ডে’ হয়েছে। ফলে সংলাপ ডাবিংয়ের দরকার হয়নি। সম্পাদনা, সাউন্ড ডিজাইনিং থেকে কালারিং-এর কাজ সবই কলকাতায় হয়েছে।
‘পিঙ্ক’-এর ‘কালারিং যেমন গোল পার্ক এলাকার একটি স্টুডিওয় বসেই সেরেছেন ‘কালারিস্ট’ দেবজ্যোতি ঘোষ। তাঁর কাজে যারপরনাই খুশি সুজিত-অনিরুদ্ধরা। টালিগঞ্জে আড়াই দশকের পোড় খাওয়া এডিটর অর্ঘ্যকমল মিত্র বলছেন, ‘‘এখন যে কোনও ছবির চূড়ান্ত কালারিং বা সাউন্ডের কাজ সবটাই কলকাতায় সারা যায়। কিছু ক্ষেত্রে সাউন্ডের শেষ পালিশটালিশে একটু-আধটু মুম্বই যাওয়ার দরকার পড়ে।’’
সাউন্ড রেকর্ডিস্ট-কাম-ডিজাইনার দীপঙ্কর চাকী ওরফে জোজোর কিন্তু দাবি, ‘‘এখন কলকাতায় যা কাজ করছি, তার শতকরা আশি ভাগই বাইরের কাজ। এর মধ্যে মুম্বই ছাড়াও হলিউডেরও একটি কাজ করার সুযোগ হয়েছে।’’ নেপাল ও কলকাতার পটভূমিতে জেফ্রি ব্রাউনের ছবি ‘সোল্ড’-এর সাউন্ড রেকর্ডিং হয়েছিল এ শহরেই। এর আগে ‘কহানি’র সময়ে বিদ্যা বালন, নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকি ছাড়া বাকি শিল্পীদের ডাবিংয়ের কাজও কলকাতাতেই হয়। ‘পিকু’-র গানের রেকর্ডিং-মিক্সিংও এখানে। সুজয়ের প্রযোজনা ‘তিন’ কিংবা দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ডিটেক্টিভ ব্যোমকেশ বক্সী’র সাউন্ডের কিছু কাজও এ শহরে হয়েছে। ‘মাসান’, ‘আঁখো দেখি’, ‘এক্স: পাস্ট ইজ প্রেজেন্ট’-এর মতো ছবির সাউন্ডও কলকাতায় হয়েছে।
কলকাতার পোস্ট-প্রোডাকশন পরিকাঠামো ও কলাকুশলীদের দক্ষতা যে এখন মুম্বইয়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে তা মানছেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ও। ছবির আবহে কৃত্রিম ভাবে নানা কিসিমের শব্দ ফুটিয়ে তোলার কাজ যাঁরা করেন, সেই ফলি-আর্টিস্টদের নিয়ে তাঁর ছবি ‘শব্দ’ তৈরি করেছিলেন কৌশিক। তার সাউন্ড ডিজাইনিং-এর কাজ কলকাতাতেই তৈরি করেন জোজো ও অনির্বাণ সেনগুপ্ত। সাউন্ড বা এডিটিং-কালারিংয়ের মুশকিল আসানে এখন লেক গার্ডেন্স এলাকার কিছু স্টুডিওতেও জোরদার কাজ হচ্ছে।
কলকাতার এই পরিকাঠামো এবং কাজের উৎকর্ষ টালিগঞ্জের সীমিত বাজেটের ছবির জন্যও হাতে চাঁদ পাওয়ার সামিল। সৃজিত মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘মিশর রহস্য-এর পরে পোস্ট প্রোডাকশনের জন্য বাইরে যাওয়ার দরকারই পড়েনি।’’ তাঁর নতুন ছবি ‘জুলফিকর’-এর সব কাজও এখানেই হয়েছে। ‘প্রাক্তন’-এ চলন্ত ট্রেনের বাইরের দৃশ্য গ্রাফিক্স-এর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছিল এখানকারই একটি সংস্থা। শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘সামান্য বাজেটে এতটা উঁচু জাতের কাজ অন্যত্র অভাবনীয়।’’
তবে ‘চাঁদের পাহাড়’ সিক্যুয়েলের জন্য অবশ্য মুম্বই যাচ্ছেন কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘কৃত্রিম জীবজন্তু তৈরি (অ্যাসেট ক্রিয়েশন) বা কৃত্রিম ব্যাকগ্রাউন্ড (ম্যাট পেন্টিং) তৈরির কাজটার জন্য মুম্বইয়ে যেতেই হবে।’’ কলকাতায় কি এ ধরনের কাজ হয় না? গোল পার্ক এলাকার একটি স্টুডিও-র কর্ণধার অনুরাগ চিরিমার ও হরচরণ সিংহ বললেন, ‘‘এই ধরনের কাজে দক্ষতা অনেকটা চাহিদা ও জোগানের তত্ত্ব মেনে চলে। সাধারণ বাংলা ছবির যা বাজেট, তাতে গ্রাফিক্স খুব বেশি থাকে না।’’ তবে ধীরে ধীরে থ্রিডি গ্রাফিক্স-এর কাজ উন্নত করার জন্য পরিকাঠামো বাড়ছে়। চ্যালেঞ্জের মুখে ‘পারিব না’ এ কথাটি বলতে নারাজ টালিগঞ্জ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy