কৌশিক সেন। —ফাইল ছবি।
দেশ জুড়ে ভোটের উত্তাপ। এখনও চার দফা ভোট বাকি রাজ্যে। ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে শেষ কথা বলবে কোন দল, সেই ফলাফল জানা যাবে ৪ জুন। আগামী পাঁচ বছরের জন্য সরকার গড়বে কে? সেই নিয়ে ভাবিত শাসক-বিরোধী দুই পক্ষই। সমাজ সচেতন, বা বলা ভাল রাজনীতি সচেতন শিল্পীরা এই মুহূর্তে সেই ছোঁয়া এড়িয়ে চলতে পারছেন না। ভোটের মুখে সাদা-কালো বোর্ডের মারপ্যাঁচের গল্প নিয়ে মুক্তি পেল ‘দাবাড়ু’। ছবিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন কৌশিক সেন। ছবির সাফল্য নিয়ে যতটা নিশ্চিত তিনি, ততটাই শঙ্কিত ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে। আনন্দবাজার অনলাইনের মাধ্যমে ভোটের মুখে দর্শকদের এক প্রকার অনুরোধই করলেন অভিনেতা।
প্রশ্ন: ‘দাবাড়ু’ ছবির সাদা-কালো বোর্ডে আপনার ভূমিকা কতটা?
কৌশিক: আমার চরিত্রটা ছবির ট্রেলারে দেখে খানিকটা অন্য রকমই ঠেকেছে। আমি ছবিটাকে যে ভাবে দেখেছি, তা একটা নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলের স্বপ্নপূরণের গল্প। শুধু সেই ছেলেটা নয়, তার পরিবারের একটা জার্নির গল্প। এই স্বপ্ন দেখার উড়ানের সময় নানা মানুষের আনাগোনা হয়। নানা মানুষ যুক্ত হয়। তবে বলতে পারি, আমার করা চরিত্রটা কিন্তু কাল্পনিক নয়, সূর্যশেখরের জীবনে এমন এক জন মানুষ সত্যি এসেছিলেন। বাকিটা দর্শক আবিষ্কার করুন।
প্রশ্ন: দাবা নিয়ে ছবি, আপনার কি দাবা খেলায় আগ্রহ রয়েছে?
কৌশিক: আমার অবসর কাটে বই পড়ে। থিয়েটার সংক্রান্ত বই পড়তে ভাল লাগে। তা ছাড়া কবিতার বই তো রয়েইছে। এ ছাড়াও অর্থনীতি, রাজনীতি ও ইতিহাস নিয়ে আগ্রহ রয়েছে। মাঝে মধ্যে মনখারাপ হয় এটা ভেবে যে, এত কিছু পড়ার আছে, সবটা পড়ে উঠতে পারছি না। অনেক রাত অবধি পড়াশোনা করি। তবু আফসোস থেকে যায়, অনেক কিছু না জেনেই পৃথিবী থেকে চলে যেতে হবে...
প্রশ্ন: সম্প্রতি সলমন রুশদির ‘নাইফ’ বইটি সাড়া ফেলে দিয়েছে, আপনি কি পড়েছেন?
কৌশিক: বিষয়টা আমি জানি। বইটা খুব শীঘ্রই পড়ে ফেলব। তবে এই মুহূর্তে যে বইটাতে ডুবে রয়েছি, সেটা রবীশ কুমারের ‘দ্য ফ্রি ভয়েস’। বাংলায় তর্জমা করলে হয়তো দাঁড়াবে 'উন্মুক্ত কণ্ঠ'। যেটা এই মুহূর্তে ভারতবর্ষে একেবারেই নেই।
প্রশ্ন: গত কয়েক বছরে আমরা দেখেছি, শিল্পী থেকে সাংবাদিকেরা বার বার নিশানায় এসেছেন, আক্রান্ত হয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে রক্ষাকবচ কী হতে পারে বলে মনে হয়?
কৌশিক: আসলে এটার কোনও রক্ষাকবচ নেই। অতিমারির পর থেকে দেখেছি, ঐশ্বর্য বা সম্পদ একেবারে দুই থেকে তিন শতাংশ মানুষের কুক্ষিগত হয়ে গিয়েছে। এটা তো স্বাভাবিক ভাবে হতে পারে না! এটা পরিকল্পনা করে ঘটানো হয়েছে আমাদের দেশে। এক দিকে, লক্ষ লক্ষ মানুষের চাকরি চলে যাচ্ছে। অন্য দিকে, দেশে চার থেকে পাঁচটা পরিবারের হতে বিপুল অর্থ জমছে। এটা কি স্বাভাবিক নাকি? আসলে এর পিছনে একটা রাজনৈতিক প্লট রয়েছে। যেটা আমাদের দেশে বিজেপি সরকার করছে। তাই শিল্পীদের তো বটেই, সাধারণ মানুষেরও কোনও রক্ষাকবচ নেই। সেই কারণেই এই সময়ে ‘দাবাড়ু’ ছবিটা গুরুত্বপূর্ণ। দাবা এমন একটা খেলা, যার সমষ্টিগত চরিত্র নেই। বরং তা একার লড়াই। এবং এই খেলাটার তেমন কোনও জৌলুসও নেই। স্পনসর পাওয়া যায় না। ছবিতে তো তেমন সংলাপও রয়েছে— এক রাজনৈতিক নেতা সৌর চরিত্রটিকে বলেছিল,‘‘দাবা খেলার জন্য বিদেশে পাঠাব! এ বার তো লোকে লুডো খেলতে চাইবে।’’ আসলে এই বোধটাই তো তৈরি হয়নি যে, দাবা আর লুডো এক জিনিস নয়। এটা আসলে নিজেকে নিজের অতিক্রম করার গল্প।
প্রশ্ন: আপনি এত ছবি করেছেন, কিন্তু কতটা সময় পর্দায় রয়েছেন, সেটা কি ভাবায় আপনাকে?
কৌশিক: ছোটবেলায় এসব ভাবনা আসত। তখন অপরিণত ছিলাম। এখানে আমার সচেতন কিছু সিদ্ধান্ত কাজ করে। প্রথমত, আমি আমার কেরিয়ার নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত নই। আমার ধ্যানজ্ঞান এখন থিয়েটার। আর যদি ভাবনার জায়গা হয়, সেটা ঋদ্ধি ও রেশমির কেরিয়ার নিয়ে। যদিও রেশমির অনেকটা বয়স হয়েছে। তবে ও যে মানের অভিনেত্রী, চলচ্চিত্রে আরও কাজ করা উচিত। তবে আমাদের তিন জনের মধ্যে অভিনেতা হিসেবে বেস্ট ঋদ্ধি। তাই আমাকে আজকাল যখন ছোট চরিত্রে কাস্ট করে, যদি না চরিত্রটা একেবারেই পাতে দেওয়ার যোগ্য না হয়, তা হলে অভিজ্ঞ অভিনেতা হিসেবে আমি কতটা দিতে পারব, সেটা বুঝতে পারলেই যত ছোট চরিত্র হোক, আমি প্রস্তাব গ্রহণ করি।
প্রশ্ন: শুধু কি চরিত্র, না কি অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কারণেও করতে হয়?
কৌশিক: হ্যাঁ, অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কারণে তো বটেই। আসলে ছোট চরিত্র করতে রাজি না হলে থিয়েটারটা করতে পারব না। কারণ আমাদের দেশে থিয়েটার করে খাওয়া যায় না। এ ছাড়াও আর একটা শিক্ষা আমার বাবা দিয়েছিলেন। সেটা আমার মনে হয় সব অভিনেতারই জানা উচিত। ছোট চরিত্র বলে কিছু হয় না, ছোট অভিনেতা হয়। চাইলে ছোট চরিত্রের মধ্যেই প্রসাদগুণ দেওয়া যায়।
প্রশ্ন: বর্তমানে সময়ে নানা রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে সিনেমা নিয়ে, অনেক সময় দেখা যাচ্ছে থিয়েটারের মতো করে সিনেমা হচ্ছে। আপনি কি ভাবছেন এ নিয়ে?
কৌশিক: একটাই প্রবণতা এখন হয়েছে বা বেড়েছে, সেটা হল থিয়েটারের দক্ষ শিল্পীরা সিনেমায় সুযোগ পাচ্ছেন। তাঁরা ধারাবাহিকে কাজ করছেন, ওটিটিতে সুযোগ পাচ্ছেন। কারণ তাঁরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিনেতা। আমাদের দেশে ফিল্ম স্কুলের এখনও অভাব রয়েছে। তাই অভিনেতা হওয়ার প্রস্তুতির শিক্ষা এক মাত্র থিয়েটার দেয়। আসলে থিয়েটার করা শিল্পীদের নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলতে হয়। যা আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করছে।
প্রশ্ন: তা হলে কি এটা ধরে নেওয়া যায়, থিয়েটার করছেন মানেই তিনি ভাল অভিনেতা?
কৌশিক: আমি মনে করি, তাঁরা অনেক বেশি প্রশিক্ষিত। বর্তমান সময়ে তো নতুন মুখের ছড়াছড়ি। দেখা যাচ্ছে, দেখতে মিষ্টি, কিন্তু অভিনয়টা পারেন না। এখন স্বল্প বাজেটে ও স্বল্প সময়ে কাজ হয়, যার ফলে একজন অভিনেতাকে প্রস্তুত করা সম্ভব হয় না।
প্রশ্ন: আগে তো একটা ট্যাবু ছিল থিয়েটারের শিল্পীদের নিয়ে। এখন কি পরিস্থিতি বদলেছে?
কৌশিক: অনেকটাই বদলেছে। তবে আমার মনে হয়, আমাদের ইন্ডাস্ট্রি এখনও অপরিণত। তারা থিয়েটারের শিল্পীদের নেবেও আবার তাঁদের থিয়েটার করতে বাধাও দেবে। একটা অমনোযোগী ইন্ডাস্ট্রিতে সেটাই সমস্যা। তা ছাড়াও অতিমারির পর থেকে অনিশ্চয়তা আরও বেড়ে গিয়েছে। ফলে কোনটা করলে সুবিধে, সেটা বুঝে উঠতে পারছে না। এক সময় মনে হচ্ছে, থিয়েটারের ছেলেমেয়েকে নিই, তা হলে কাজটা ভাল হবে। আবার তাঁদের নিয়ে নিরাপত্তাহীনতাও তৈরি হয়। থিয়েটারের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের রিহার্সালের জন্য ছাড়ার বিষয়টা নিয়ে অদ্ভুত একটা দোলাচল রয়েছে।
প্রশ্ন: আপনারা যখন টেলিভিশনে কাজ শুরু করেন, তখন কতটা সহযোগিতা পেয়েছিলেন?
কৌশিক: আমরা যখন শুরু করেছিলাম, বিভিন্ন পরিচালক-প্রযোজকেরা আকাশ থেকে পড়তেন... ‘রিহার্সাল’! সেটা আবার কী? শোয়ের দিন ছুটি দিচ্ছেন সে-ই ঢের। আমরা যখন টেলিভিশনে কাজ করছি, তখন একটা নব জোয়ার আসে। তখন সিনেমার যা অবস্থা, তাতে বুদ্ধিদীপ্ত ছেলে-মেয়েরা টেলিভিশনের দিকে ঝোঁকে। তবে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, অতনু ঘোষ, শিবু-নন্দিতাদি, এঁরা আবার থিয়েটারের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সুযোগ দিতে শুরু করলেন।
প্রশ্ন: বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির চেহারাটা কেমন?
কৌশক: এখন আসলে চিত্রটা একেবারে উল্টে গিয়েছে। ওটিটি কিংবা সিনেমায় দক্ষ শিল্পীদের সংখ্যা বেশি। টেলিভিশনের ক্ষেত্রে একটা জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আমার মনে হয়, যখন জলটা ঘোলা হয়ে যায়, তার পরই কিন্তু পরিষ্কার জল আসে।
প্রশ্ন: বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ান— এই আবেদন কি সমর্থন করেন?
কৌশিক: যে কোনও আর্জি প্রথমে সহজ ভাবেই বলা হয়। তার পর সেটা চর্চা হতে হতে বিকৃত জায়গায় পৌঁছে যায়। আমার মনে হয়, নিজেদের সংস্কৃতির ভাল হোক কিংবা না হোক, আবেদন করা ভুল নয়। আবার যখন অনুরাগ কাশ্যপ এসে ‘ঘটিয়া’ বলে যান, সেটা নিয়েও ভেঙে পড়ার কিছু নেই। তিনি এসে বাংলা সিনেমাকে নিয়ে চারটে কথা বললেন বলে নাকি কান্নারও দরকার নেই।
প্রশ্ন: মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির বক্স অফিস কালেকশন আশানুরূপ নয়, বাংলা ছবিতে কি নায়ক-নায়িকার অভাব রয়েছে?
কৌশিক: গোটা বিশ্বে সিনেমার একটা ক্রাইসিস চলছে। কে কেমন ছবি বানাবে, সেটা বুঝতে পারছে না।কেউ কেউ বলেন, অঞ্জন চৌধুরী, স্বপন সাহার ছবিকে কেন নিন্দে করা হয়? আমার কথা হচ্ছে, শুধু সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনের সঙ্গে তুলনা করলে চলবে না। আবার লাফ দিয়ে অঞ্জন চৌধুরী, স্বপন সাহায় নামারও দরকার নেই। মাঝের যে পরিচালকেরা ছিলেন... তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, রাজেন তরফদারের মতো করেও তো ভাবা যায়!
প্রশ্ন: উইন্ডোজ়ের সব ছবি দেখেন, ভাল লাগে?
কৌশিক: এক জন পেশাদার অভিনেতা হিসেবে আমি কখনই বলছি না উইন্ডোজ়ের সব ছবি আমার ভাল লাগে। তবে ওদের যেটা ভাল লাগে, সেটা সমাজ ও রাজনীতি সবটা নিয়ে ওদের একটা পড়াশোনা আছে। এই ‘দাবাড়ু’ ছবিটাতে সেই ছাপ রয়েছে।
প্রশ্ন: খেলাধুলো নিয়ে ছবি, তা-ও ক্রিকেট কিংবা ফুটবল নয়। কতটা আশাবাদী?
কৌশিক: আসলে এই ছবিটা তো ফেলুদা,ব্যোমকেশের মতো নয়, সামাজিক সুসম্পর্কের ছবি নয়। মানুষ গোয়েন্দা ছবি দেখতে দেখতে ক্লান্ত। একটা ভিন্ন স্বাদের ছবি। এখানে দীপঙ্কর দে ও চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তীর অভিনয় দেখার মতো। অন্য দক্ষ শিল্পীরা আছেন।
প্রশ্ন: ‘পুষ্পা ২’-এর মতো ছবি বাংলায় ডাব করা হচ্ছে, গান মুক্তি পাচ্ছে। এটা কি বাংলা ইন্ডাস্ট্রির জন্য ক্ষতিকারক?
কৌশিক: আমার মনে হয় এ ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন। মনে হয়, ‘পুষ্পা’র মতো ছবি ডাব করে বাংলায় আসা উচিত নয়। তবে যদি তুমি এই প্রতিযোগিতায় ঢুকে যাও, তা হলে ‘পুষ্পা’র মতো ছবিকে টেক্কা দেওয়ার মতো গল্প মাথা থেকে বার করতে হবে।
প্রশ্ন: চলতি নির্বাচন থেকে আপনি কী প্রত্যাশা করছেন?
কৌশিক: ভোটের থেকে এখন আর কেউ কিছু আশা করেন না বলেই এত কম ভোট পড়ে। আমি বিশ্বাস করি, ভারতীয় জনতা পার্টি কিংবা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ দেশের পক্ষে বড় বিপদ। ভারতের একজন নাগরিক হিসেবে আমি চাইব না এরা দেশে, কিংবা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসুক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy