আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে মনখোলা আড্ডায় কৌশিক সেন। ফাইল চিত্র।
‘গোধূলি আলাপ’-এর সেটে কফির কাপ হাতে আনন্দবাজার অনলাইনের মুখোমুখি কৌশিক সেন। কী বলছেন ‘কাবেরী অন্তর্ধান’-এর মৃত সৈনিক?
প্রশ্ন: নতুন বছরটা কেমন বুঝছেন?
কৌশিক: আসলে নতুন বছর বলে কিছু হয় না। সবটা একই রকম থেকে যায়। চারপাশটা দেখলে মনখারাপই লাগে। দুর্নীতি, চিকিৎসার অভাব বা অনেক মানুষের না-খেতে পাওয়া— সবটা একই রয়ে গিয়েছে। এমন নয় যে, আমি সিনিসিজ়মে ভুগছি। কিন্তু এই বয়সে মনে হয়, মূর্খের মতো প্রত্যাশা রেখে লাভ নেই।
প্রশ্ন: শেষ কবে রেগে গিয়েছিলেন?
কৌশিক: (মৃদু হেসে) দেখে বোঝা যায় না, কিন্তু আমি খুবই রাগী। আমার দলের ছেলেমেয়েরা জানে, একটা জায়গায় আমি খুব আপসহীন, অভিনয় শেখানোর ক্ষেত্রে। প্রচুর নতুন ছেলেমেয়ে নিয়ে কাজ করতে হয় থিয়েটারে। সেখানে যেমন অনেকে খুবই সিনসিয়ার, তেমনই অনেক ফাঁকিবাজ ছেলেমেয়েও থাকে। তাদেরকে নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটা প্রোডাকশন নামাতে গেলে সব সময় ঠান্ডা মাথায় কাজ করা যায় না। শৃঙ্খলাপরায়ণ যারা, তাদের সঙ্গে ফাঁকিবাজদের এক লাইনে নিয়ে আসতে গেলে মাঝেমধ্যে মাথা গরম করতেই হয়।
প্রশ্ন: আর রোজকার ব্যক্তিগত জীবনে?
কৌশিক: সেখানে আমি সবটাই খুব ঠান্ডা মাথায় ডিল করি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শোনা একটা গল্প বলি এ প্রসঙ্গে। একজন বিখ্যাত কার র্যালি চ্যাম্পিয়নকে কেউ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘আপনি তো প্রতিযোগিতার সময় অত তীব্র গতিতে গাড়ি চালান, কিন্তু যখন ব্যক্তিগত জীবনে চালান, তখন কী মনে রাখেন?’’ তিনি বলেছিলেন, ‘‘কনসিডারেশন ফর আদার্স।’’ এই কথাটা আমার মনে গভীর ভাবে ছাপ ফেলে গিয়েছিল। সব সময় যে এটা সফল ভাবে করতে পেরেছি, তা অবশ্য নয়। তবে, চেষ্টা করেছি।
প্রশ্ন: আবার দুই কৌশিক এক জায়গায়। ‘কাবেরী অন্তর্ধান’-এ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
কৌশিক: কৌশিকের সঙ্গে অনেকগুলো কাজ করলাম। মাঝখানে দীর্ঘ দিন কাজ করিনি। টেলিভিশনের স্বর্ণযুগ যে সময়টাকে বলা হয়, তখন ওর সঙ্গে খুব ভাল ভাল টেলিফিল্ম করেছিলাম। কৌশিকের দ্বিতীয় ছবি ‘শূন্য এ বুকে’র নায়ক ছিলাম আমি। পরে ‘দৃষ্টিকোণ’ করেছি। ‘কাবেরী অন্তর্ধান’ ছাড়াও আর একটা ছবি আছে, অতিমারির আগেই শুট করা। ওর ছবির বিশেষ জোরের জায়গাটা হল চিত্রনাট্য। সংলাপ বলে আরাম পাওয়া যায়। রোজকার কথার একটা ছন্দ ও ধরতে পারে ওর সংলাপ। এটা অতনু (ঘোষ)-র মধ্যেও পেয়েছি। ঋতুপর্ণ (ঘোষ) পারতেন। কৌশিক নিজে খুব ভাল অভিনেতা বলে ওর ছবিতে নিশ্চিন্তে অভিনয় করা যায়। ভাল না লাগলে ও বলে, আর ও ভাল বললে সেটা নিয়ে আর দু’বার ভাবতে হয় না।
প্রশ্ন: কাবেরী আপনার কে হয়?
কৌশিক: কাবেরী আমার বোন। তার অন্তর্ধান নিয়েই একটা রহস্য তৈরি হচ্ছে ছবিতে। যদিও ছবিটা শুরু হচ্ছে আমার হত্যার ঘটনা দিয়ে। আমার চরিত্রটার মৃত্যু আর কাবেরীর অন্তর্ধান— দুটো মিলেই ছবিতে রহস্য ঘনিয়ে ওঠে। আমার চরিত্রটা ছবিতে পুরোটাই ফ্ল্যাশব্যাকে।
প্রশ্ন: কৌশিক সেন বলতেই যে শান্ত, সৌম্যকান্তি মানুষটার কথা মনে আসে, সেই মুখটা কিন্তু ‘একদিন প্রতিদিন’ থেকে একই আছে। এটা কী করে সম্ভব?
কৌশিক: আমি ঠিক জানি না। এমনিতে আমি শান্ত, সৌম্য মানুষ। তার মানে এই নয় যে, আমার ভিতরে গন্ডগোল নেই। কিন্তু একটা কথা আমি খুব নিশ্চিত করে বলতে পারি, যে ক’টা মাস নতুন নাটক গড়ে ওঠার প্রস্তুতিটা চলে, সেই সময়টা মানুষ হিসাবে আমি সবচেয়ে শুদ্ধ থাকি। ধরা যাক, যখন হ্যামলেট নিয়ে কাজ করছি, আমায় তো বিষয়টা বুঝতে হবে। শেক্সপিয়রকে বুঝতে হবে। তখন মানুষ হিসাবে নিজেকে ছাপিয়ে যেতে হয়। নিজের ভিতরের ত্রুটিগুলো তখন স্পষ্ট বোঝা যায়। শিল্প এই জায়গাটায় আমায় সাহায্য করে।
প্রশ্ন: আপনি তো বিপ্লবী। অভিনেতা কৌশিক আর বিপ্লবী কৌশিক— এই দুটো কি পরস্পরবিরোধী সত্তা?
কৌশিক: এই মূহূর্তে পশ্চিমবঙ্গ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে এই প্রতিবাদী, বুদ্ধিজীবী কথাগুলোর কোনও মানে নেই। আমি এটা শুনে শুনে ক্লান্ত। আমার বা আমাদের মতামত অনেকে নেন, এটা আসলে বাঙালি মধ্যবিত্তের সান্ধ্যকালীন বিনোদন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসলে সান্ধ্যকালীন বিতর্কে নেতারা চিৎকার করেন, আমাদের কথাগুলো সেখানে খানিকটা বৈচিত্র আনে। এর বেশি কিছু নয়। শেষ অবধি ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়ায় পক্ষ নেওয়া, দলীয় ছাঁচে ফেলা। এটা একটা অসুখের পর্যায় চলে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। দলীয় পরিচয়ের বাইরেও যে একটা পরিসর আছে, এটা বোঝাতে বোঝাতে আমি ক্লান্ত।
প্রশ্ন: কখনও মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পাশে, কখনও এসএসসি পরীক্ষার্থীদের পাশে থাকতে দেখা যায়। নিজেকে কি বাংলার সোনু সুদ মনে হয়?
কৌশিক: আসলে ছাত্রছাত্রীদের লড়াইয়ের মধ্যে একটা পবিত্রতা আছে তো। সম্প্রতি বেলেঘাটার নাট্যদলের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধেও আমি ভিডিয়োবার্তা দিয়েছি। এগুলো তো এড়ানো যায় না। তবে এটাও বুঝি, এতে আসলে কোনও লাভ হয় না। নিন্দার্থেই বলছি, রাজনীতি এত ‘পরিণত’ হয়ে গিয়েছে যে, আমার প্রতিবাদটাও সে ছাঁচে ফেলে দেবে। সে শাসক হোক বা বিরোধী।
প্রশ্ন: বাক্স্বাধীনতার প্রশ্নে এ রাজ্য কি অন্য রাজ্যের চেয়ে এগিয়ে? ‘পাঠান’ নিয়ে সম্প্রতি রাজ্যে রাজ্যে যা হল, বাংলায় কিন্তু তেমনটা দেখা যায়নি।
কৌশিক: আসলে এটা বাঙালির চরিত্রের ভিতরেই আছে। কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের দান নয় এটা। বাইরের আগ্রাসন সে মেনে নেয় না। সে হয়তো ভাবে, নিজের ছেলেকে বা মেয়েকে শাসন করে একটা কথা বললে তারা শুনবে। তার জন্য কোনও রাজনৈতিক সংগঠনের দাদাগিরি সে মানবে না। এই ঐতিহ্যটা থাকবে।
প্রশ্ন: ঋদ্ধি তো ছোটবেলা থেকে আপনাকে কাজ করতে দেখেছে। আপনি কী ভাবে ওকে গাইড করেন?
কৌশিক: সত্যি বলতে কী, ওকে অনেক বেশি গাইড করেছে রেশমি (স্ত্রী)। ওর জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে রেশমির ভূমিকা আছে। আর ও নিজেই এত পরিণত যে, আলাদা করে হাতে ধরে ওকে সে ভাবে শেখাতে হয়নি। যেখানে যা কিছু ভাল, ও নিতে চেষ্টা করেছে। ও আমাদের দু’জনের কাছ থেকেই শিখেছে। আর ওর সামনে আমরা কিছু লুকিয়ে বা ঢেকে রাখিনি। ফলে ওর জীবনবোধটাও অন্য রকম।
প্রশ্ন: থিয়েটারে খুব বেশি নিরীক্ষামূলক কাজ করতে আপনাকে দেখা যায় না, ঋদ্ধির উপরেই কি ভার ছেড়ে দিচ্ছেন?
কৌশিক: আসলে এই শিক্ষাটা আমার বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। থিয়েটারটা আমার কাছে জলভাতের মতো। ওটা ছাড়া বাঁচব কী করে? খুব আড়ম্বরে বিশ্বাস করি না। আমার প্রযোজনাগুলো দেখলে বোঝা যাবে, কতটা পরিশ্রম থাকে তাতে। আর ঋদ্ধির প্রসঙ্গে বলি, রেশমি যেমন ‘স্বপ্নসন্ধানী’ ছাড়া অন্য কোথাও অভিনয় করে না, আমি নিজেও নানা দলে কাজ করায় বিশ্বাস করি না। কিন্তু ঋদ্ধির ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি। ও তো আমার পরিচালনার ধরনটা জানে। আমি ওকে বলেছি, ভাল পরিচালকের ডাক পেলে অন্য দলে গিয়েও অভিনয় করতে। যেমন ও ‘মেফিস্টো’তে করে।
প্রশ্ন: ইদানীং কি মঞ্চে ক্লান্ত বোধ করছেন? তাই কি সিরিয়ালের দিকে ঝুঁকছেন?
কৌশিক: আসলে অভিনয়ের মাধ্যমের ক্ষেত্রে আমার নিজস্ব পছন্দ সে অর্থে নেই। অতিমারির পর তেমন ভাল কাজ পাচ্ছিলাম না বলে অনেক কাজ ছেড়েছি। সেই সময় ‘গোধূলি আলাপ’-এর অফারটা আসে।
প্রশ্ন: কৌশিক সেন কি শুধুই রোজগারের জন্য সিরিয়াল করেন?
কৌশিক: সকলেই তাই করে। সংসার তো চালাতে হবে। তবে, এই চরিত্রটা আমার পছন্দ হয়েছিল। মজা লেগেছিল। মেগা করতে করতে মাঝেমধ্যে একঘেয়েমি আসে। তখন থিয়েটারটা একটা মোটিভেশন হিসাবে কাজ করে।
প্রশ্ন: বেশি বয়সের নায়কের ভূমিকা পেলে কি খুশি হবেন?
কৌশিক: বলা হয়, সারা পৃথিবীতেই পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষেরা খুব ইন্টারেস্টিং চরিত্র হয়ে ওঠেন। ওটিটি-তে মাঝেমধ্যে তার প্রতিফলন দেখা যায়। বাংলা ছবি এখনও সবটা করে উঠতে না পারলেও এখন নানা ধরনের চরিত্র নিয়ে কাজ হচ্ছে। কেবল আবিরের মতো সুদর্শন অভিনেতা নয়, ঋত্বিকও দাপিয়ে কাজ করছে। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় মেজর অভিনেতা হয়ে উঠছে। ঋদ্ধি, ঋতব্রতও গুরুত্বপূর্ণ মুখ হয়ে উঠছে।
প্রশ্ন: জীবনে এমন কিছু আছে, যা না চাইতেই পেয়েছেন?
কৌশিক: জীবনে অনেক ক্ষেত্রেই এমন হয়েছে। যে আমি ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় মৃণাল সেনের ‘একদিন প্রতিদিন’-এ প্রথম ক্যামেরার মুখোমুখি হই, সেই আমিই পরিণত বয়সে তাঁর শেষ ছবির নায়ক হয়েছি— এটাও তো না চাইতেই পাওয়া। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সান্নিধ্যটাও আমার বড় প্রাপ্তি। তপন সিংহের মতো পরিচালকের একাধিক ছবিতে কাজ করেছি। এতে সবটা আমার কৃতিত্ব, তা বলব না। ভাগ্য হতে পারে, যোগাযোগ হতে পারে। তপনবাবু পর পর ওঁর ছবিতে সুযোগ দিয়েছেন, ওয়ার্কশপ করিয়েছেন— এগুলো জীবনের মূল্যবান অভিজ্ঞতা। ভাবা যায় না! খুব কম অভিনেতার জীবনে এমনটা হয়েছে যে, তপন সিংহ তাঁকে অভিনয় শিখিয়ে দিচ্ছেন। উনি যে কত বড় অভিনেতা ছিলেন, সেটা যাঁরা ওঁর কাছে অভিনয় শেখেননি, তাঁরা জানেন না।
প্রশ্ন: এমন কোনও প্রশ্ন, যেটা আমি না করলেও উত্তর দিতে চান।
কৌশিক: আমরা চলচ্চিত্রই করি, বা থিয়েটার— আমার মনে হয়, শিল্পীদের একটা নিজস্ব ভুবন আছে। আমাদের মধ্যে যোগাযোগটা কম। আগের থেকে অনেক বেশি পার্টি হয়, গেট টুগেদার হয়, আমি অবশ্য যেতে পারি না সর্বত্র, ওই রকম গোষ্ঠীগত হতে ভালও লাগে না, কিন্তু জানতে পারি। আমার মনে হয়, এ সব সত্ত্বেও আমরা খুব বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতাটা যত দ্রুত কাটে, তত ভাল।
প্রশ্ন: এই বিচ্ছিন্নতা কি কাজের ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে আসে?
কৌশিক: তা হয়তো নয়। কোনও অযাচিত কারণেই হয়তো। এটা কাটবে না, যদি আমাদের মধ্যে শৈল্পিক আদানপ্রদান না হয়। ঋদ্ধি একটা চমৎকার আইডিয়া দিচ্ছিল। অতনু, কৌশিক— এ রকম যারা চমৎকার স্ক্রিপ্ট লেখে, তারা যদি অন্যদের ছবির জন্যেও স্ক্রিপ্ট লেখে। পরমের (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়) ছবির জন্য যদি কৌশিক লেখে বা রাজের (চক্রবর্তী) ছবির জন্য অতনু। এই ধরনের শৈল্পিক বিনিময়টা বাড়াতে হবে। ধরা যাক, সৃজিতের কোনও ছবিতে আমার পার্ট নেই, কিন্তু ওর ছবির চারটে-পাঁচটা চরিত্রের অ্যাক্টিং ওয়ার্কশপ করানোর দায়িত্ব যদি ও আমায় দেয়, বা শাশ্বতকে (চট্টোপাধ্যায়) বলে পেশাদার ভাবেই নতুন ছেলেদের অভিনয় শেখাতে। এই রকম আদানপ্রদান দরকার। একটা লোকের মাথা থেকে সবটা বেরোতে পারে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy