ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও অভিনয় করেছেন জয়শ্রী মুখোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
রথ এলেই কান্না পায় জয়শ্রীর। টেলি দর্শকরা ‘পিসিঠাম্মা’ নামে চিনলেও জয়শ্রী মুখোপাধ্যায় এক সময় চিৎপুরের মঞ্চ কাঁপানো নায়িকা। আসল নাম অবশ্য হীরা। বাড়ির সেই নাম কেড়ে নিয়েছিল যাত্রাপাড়া। অভিনয়ে নেমেই হীরা হয়ে যান জয়শ্রী। আর সেখান থেকে ‘পিসিঠাম্মা’ হয়ে ওঠার মাঝে অনেক দীর্ঘ আর রুক্ষ পথ।
সোমবার আবার রথযাত্রা। আবার কান্না পাচ্ছে জয়শ্রীর।
যাত্রাকে জীবন করেছিলেন। সেই যাত্রা দিয়েছে অনেক, আবার নিয়েও গিয়েছে। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য এখন টিভি ধারাবাহিকে টুকটাক কাজ করলেও ‘সর্বগ্রাসী’ যাত্রাতেই মন পড়ে থাকে তবু। একলা হলেই তিন দিক খোলা মঞ্চ টানে জয়শ্রীকে।
“রথ এলেই যাত্রার বুকিং শুরু হয়ে যেত। তখনই বুঝে যেতাম বছরটা কেমন যাবে। এর পর থেকে মহড়া আর গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো,” বলছিলেন জয়শ্রী। একসঙ্গে বলে গেলেন, সেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত জীবনের অনেক অনেক কথা। অনেক ওঠাপড়ার কাহিনি। কেমন করে মঞ্চকে ভালবেসে যাত্রায় ডুব দিলেন আবার যাত্রা কেমন করে ডুবিয়েছে তাঁকে। তবে সাঁতরে পারে ওঠার সুযোগটাও করে দিয়েছিল যাত্রাই। জয়শ্রীর কথায়, “যাত্রা একেবারে অন্য রকম। আমি থিয়েটার করেছি, এখন ক্যামেরার সামনে অভিনয় করি। কিন্তু দর্শককে এত কাছ থেকে পাওয়ার সুযোগ নেই কোথাও। যাত্রায় ভাল অভিনয় করতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে দর্শকের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। আবার উল্টোটা হলে বুঝতে পারা যায় কোথাও একটা খামতি হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আবার মনোনিবেশ করা যায়। হাততালির চেয়ে তো বড় পুরস্কার কিছু হয় না। সিরিয়ালের টিআরপি দিয়ে সেই আনন্দকে মাপা যায় না।”
‘নট্ট কোম্পানি’ থেকে ‘অগ্রগামী’— অনেক দলের হয়ে অভিনয় করেছেন। এখনও চিৎপুরে শোনা যায়, জয়শ্রীর অভিনয় করা ‘মেজদি’, ‘বড়দি’ পালার কথা। এক সময় পিএলটি-র সঙ্গে যুক্ত জয়শ্রী উৎপল দত্তের পরিচালনায় অভিনয় করেছেন ‘দিল্লি চলো’, ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ’ পালায়। আবার তিনিই হয়েছেন যাত্রা সম্রাট ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ধন্যি মেয়ে’। সেটা ছিল ‘প্রভাস অপেরা’-র পালা। বাংলার এ মাথা থেকে ওই মাথা ঘুরেছেন ‘নিলামে উঠেছে সিঁদুর’ পালার অভিনেত্রী হয়ে।
হীরার ছেলেবেলা কেটেছে উত্তর কলকাতার পাইকপাড়ায়। তার পরে দমদম ক্যান্টনমেন্টে। বাবা, মা ছাড়াও পাঁচ ভাইবোন মিলে বড় সংসার। ক্লাস এইটের পরে আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। ফুলের মালা বানিয়ে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করতেন হীরা। তবে শখের আবৃত্তি কখনও ছাড়েননি। সেই সূত্রেই আলাপ হয় নাট্য পরিচালক অমরনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। শুরু অভিনয়। অ্যামেচার নাটকে অভিনয় করতে করতেই একটি যাত্রা দলের কর্নেট বাদক খোকা মল্লিকের সঙ্গে পরিচয়। তার পরেই চিৎপুর যাত্রা। এর পরের পথ অনেক লম্বা। ১৯৬৫ সাল থেকে শুরু করে টানা ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। ৩৫০ টাকা মাস মাইনে থেকে শুরু। তারপর দরমার বেড়া, টালির চালের ঘর পাকা হল, বিয়ে হল, ছেলে, মেয়ে হল। “যখন আমি ‘ধন্যি মেয়ে’ করছি তখনও তো পেটে ছেলে। তার পরে ওদের মানুষ করতে গিয়ে অভিনয় থামাতে হল। তখন আর্থিক অবস্থা বেশ ভাল। কিন্তু বেশি দিন সুখ সইল না। আবার সংসার টানতে যাত্রায় যোগ দিতে হয়। অভিনয়ে ফিরতে আনন্দই পেয়েছি। কিন্তু সময়টা খুবই খারাপ গিয়েছে। অনেক লড়াই করতে হয়েছে।”
এখন যে খুব অর্থকষ্টে রয়েছেন তা অবশ্য নয়। ধারাবাহিকে অভিনয়ের জন্য মাঝে মধ্যেই ডাক পান। প্রয়োজন মতো ছেলে, মেয়েরাও সাহায্য করেন। কিন্তু এখনও মনে পড়ে সেই দিনগুলো। জয়শ্রীর স্বামী মধু বড়ালও যাত্রা-পাগল ছিলেন। অভিনেতা চিন্ময় রায়ের সঙ্গে ‘যুগ যাত্রা’ নামে একটা দল খোলেন। কিন্তু বেশি দিন চালাতে পারেননি। দল ভেঙে যায়। অনেক টাকা দেনা হয়ে যায়। সেই দিনের কথা মনে করে জয়শ্রী বলেন, “খারাপ সয়য় গেলেও আমার ভরসা ছিল মঞ্চ। ৮০ সাল নাগাদ আবার অভিনয় শুরু করি। বছর সাতেক হল আর পারি না।” বড় পর্দাতেও অভিনয় করেছেন জয়শ্রী। ভবেশ কুণ্ডুর ‘গুরু দক্ষিণা’ ছবিতে তাপস পালের মায়ের চরিত্রে ছিলেন। আবার হালফিলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন নিয়ে পরিচালক নেহাল দত্তের ‘বাঘিনী’ ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন। মমতার মায়ের চরিত্রে।
প্রবীণ অভিনেত্রী হিসেবে বছর দু’য়েক হল সরকারি ভাতাও পাচ্ছেন। সেই সব মিলিয়ে তেমন অর্থকষ্ট নেই কিন্তু যাত্রার জন্য মন কাঁদে এখনও। মনে হয় আবার মঞ্চে ফিরবেন। গাঁয়ের মাঠে ঝিঁঝির ডাককে হারিয়ে বেজে উঠবে কনসার্ট। আবার হাততালির মধ্যে দাঁড়িয়ে গেয়ে উঠবেন নটী জয়শ্রী। একই সঙ্গে মনে হয়, এই প্রজন্মও তাঁকে আসল পরিচয়ে চিনুক। ‘খড়কুটো’-র ‘পিসিঠাম্মা’ নয়, জয়শ্রী যে আসলে চিৎপুরের নটী। পোস্টারে তাঁর ছবি দেখেই তো একদিন অপেরার অধিকারীদের (ম্যানেজার) কাছে পালার বায়না করতে আসতেন গাঁ গঞ্জের নায়েকরা (আয়োজক)। সেটা তো শুরু হয় রথযাত্রার দিনেই। তাই তো রথ এলেই যাত্রা টানে জয়শ্রীকে। চোখের কোণে জমে জল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy